রোজায় স্বাস্থ্য-সম্মত সেহরি ও ইফতার
রোজা শুধু আত্মশুদ্ধির মাসই নয়, এ মাস আত্মনিয়ন্ত্রণেরও। নিজেকে একটি নির্দিষ্ট নিয়মে পরিচালিত করার মাধ্যমে শরীরে প্রতিষ্ঠিত হয় শৃঙ্খলা। রোজার সময় সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকার বিষয়টি শরীরের ওপর যে প্রভাব ফেলে, তা কাটিয়ে ওঠার জন্য এ সময়ে শরীরকে চালাতে হবে ভিন্ন নিয়মে। বিশেষ করে এ সময়ে খাবারদাবারে আনতে হবে বিশেষ পরিবর্তন। ঐতিহ্যগতভাবে আমরা সেহরি ও ইফতারে যেসব খাবার গ্রহণ করে থাকি সেগুলোর সবই যে যথাযথ তা কিন্তু নয়। এসব খাবারের মধ্যে কিছু খাবার রয়েছে যা স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আবার কিছু খাবার আছে যেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত কিংবা পুষ্টিকর খাবার হলেও সময়োচিত নয়।
রোজার সময় খাবারের বিভিন্ন দিক নিয়ে ‘ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রমাদান ফাস্টিং রিসার্চ’ জার্নালে প্রকাশিত ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির একদল গবেষকের গবেষণায় দেখা গেছে, রোজার সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোজাদারেরা অসুস্থ হয়ে পড়েন যথাযথ খাবার গ্রহণ না করার কারণে। বিশেষ করে অতিরিক্ত খাবার গ্রহণের কারণেই এই অসুস্থতা দেখা দিয়ে থাকে। এর সাথে অপর্যাপ্ত ঘুম শরীরকে কিছুটা বিপাকে ফেলে দেয়। রোজায় এই শারীরিক বিপত্তি এড়ানো খুবই সহজ বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা। রোজা রাখার পর সারা দিনের খাবার একসাথে খেতে হবে এ রকম মানসিকতা থেকেই এই বিপত্তি দেখা দেয়।
এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞের কথা হচ্ছে, এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, পাকস্থলীর একটি নির্দিষ্ট আয়তন ও খাবার ধারণের ক্ষমতা রয়েছে। শুধু এক দিন কেন, তিন দিন না খেয়ে থাকার পরও পাকস্থলী তার ধারণক্ষমতার বেশি খাবার গ্রহণ করতে পারবে না। সুতরাং বেশি খেলে বিপত্তি ঘটবেই। তাই এ ধরনের বিপত্তি এড়াতে গবেষকদের প্রথম উপদেশ হচ্ছে, সেহরি ও ইফতারে অতিভোজন পরিহার করা। দ্বিতীয় শরীর নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি স্বনিয়ন্ত্রিতভাবে রোজার সময় বিপাকক্রিয়ার হার কমিয়ে দেয় এবং শরীরে জমাকৃত চর্বি ক্ষুধা নিবারণে ব্যবহৃত হয়। রোজার সময় খাবারের ব্যাপারে বেশির ভাগ লোকই রুচিকর খাবার গ্রহণের দিকে বেশি মনোযোগী থাকে, কিন্তু সুষম খাবার বা ব্যালান্স ডায়েটের কথা মনে রাখেন না। রোজায় সুস্থ থাকার জন্য সব ধরনের খাবার মিলিয়ে খাদ্য তালিকা তৈরি করতে হবে। বিশেষ করে, আটা বা চাল, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার, মাছ, গোশত ও ডিম, শস্যদানা, শাকসবজি এবং সর্বোপরি ফলজাতীয় খাবার রাখা উচিত। সেহরি ও ইফতার উভয়ের পরই ফল খাওয়ার ব্যাপারে বিশেষভাবে উপদেশ দেয়া হয়েছে এই গবেষণায়। গবেষকেরা বলেছেন, রোজার খাবার যত সাধারণ হবে ততই ভালো। রোজা হচ্ছে বাড়তি ওজনসম্পন্ন লোকদের জন্য ওজন কমানোর উপায়। কিন্তু অতিভোজনের কারণে সে উদ্দেশ্য বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
রোজায় দীর্ঘ সময় উপবাস থাকতে হয় বলে সেহরিতে কমপ্লেক্স কার্বোহাইড্রেট বা জটিল শর্করা গ্রহণ করা উচিত। এই জটিল শর্করা ধীরগতিতে হজম হয় এবং হজম হতে প্রায় ৮ ঘণ্টা লাগে। ফলে দিনের বেলায় ুধা কম অনুভূত হয়। জটিল শর্করাজাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে শস্যদানা বা বীজজাতীয় খাবার, অপরিশোধিত বা ননরিফাইনড আটা, ময়দা এবং ঢেঁকিছাঁটা চাল। অন্যদিকে পরিশোধিত শর্করা দ্রুত হজম হয়ে যায় এবং রক্তে দ্রুত গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে শরীরকে চাঙ্গা করে তোলে। এ ধরনের খাবার হজমে সময় নেয় তিন-চার ঘণ্টা। তাই এ ধরনের খাবার ইফতারে গ্রহণ করা উচিত বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রমাদান ফাস্টিং রিসার্চ জার্নালে। দ্রুত হজম হয় এ ধরনের শর্করাজাতীয় খাবারের মধ্যে রয়েছে রিফাইনড ময়দা ও চিনিজাতীয় খাবার। খেজুর হতে পারে ইফতারের একটি অন্যতম খাবার। খেজুর হচ্ছে চিনি, তন্তু বা ফাইবার, শর্করা, পটাশিয়াম এবং ম্যাগনেশিয়ামের উৎস। ইফতারে দু-তিনটি খেজুরই শরীরকে দ্রুত চাঙ্গা করে দিতে পারে; তবে সাথে পানি পান করতে হবে প্রচুর। রোজায় ভাজাপোড়া খাবার প্রায় সবারই প্রিয়, কিন্তু এই ভাজাপোড়াজাতীয় ইফতারি গ্রহণের ফলেই অনেক রোজাদার শারীরিক অস্বস্তিতে ভোগেন বলে উল্লেখ করেছে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রমাদান ফাস্টিং রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণালব্ধ নিবন্ধ।
নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভাজাপোড়া খাবার, অতি মসলাযুক্ত খাবার এবং অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার গ্রহণের কারণে অনেকেই রোজা রেখে অবশেষে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তবে রোজার পর এদের বেশির ভাগই ক্রমান্বয়ে সুস্থ হয়ে ওঠেন। হঠাৎ করে একসাথে এসব খাবার গ্রহণের ফলে বদহজম, বুকজ্বলা এবং ওজন বৃদ্ধির সমস্যা দেখা দেয়। রোজা রাখার সময় যাতে এসিডিটি দেখা না দেয় তা প্রতিরোধের জন্য আশযুক্ত খাবার, শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এই জাতীয় খাবার পাকস্থলীর মাংসপেশির সঙ্কোচন-প্রসারণপ্রক্রিয়া বাড়িয়ে দিয়ে পেট ফাঁপা যেমন প্রতিরোধ করে তেমনি খাবারগুলোকে ভেঙে ুদ্রাতিুদ্র অংশে পরিণত করে। এতে খাবার সহজেই হজম হয়ে যায়। ফলে এসিডিটি দেখা দেয়ার প্রবণতা হ্রাস পায়।
ইফতারের পর ঘুমানোর আগ পর্যন্ত শরীরে সারা দিনের পানিস্বল্পতা এবং শরীরকে দূষণমুক্ত করার জন্য প্রচুর পরিমাণ পানি গ্রহণের কথা বলা হয়েছে এই নিবন্ধে। সেহরির পর অনেকেই চা পান করে থাকেন। চা অনেক উপকারী, এ কথাও প্রায় সবার জানা। কিন্তু এই নিবন্ধে গবেষকেরা সেহরির পর চা পান থেকে বিরত থাকতে বলেছেন, একটি ভিন্ন কারণে। গবেষকেরা বলছেন, চায়ের মধ্যে রয়েছে ক্যাফেইন। এই ক্যাফেইন প্রস্রাবের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে শরীরে খনিজ লবণ ও পানিস্বল্পতা দেখা দিয়ে থাকে। এই পানিস্বল্পতা রোজাদারের জন্য কাম্য নয়, বরং সেহরির পর কলা খাওয়া যেতে পারে। কলায় রয়েছে পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম এবং কার্বোহাইড্রেট। তবে কলা কারো কারো ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য করে থাকে। সে ক্ষেত্রে আঁশজাতীয় খাবার সাথে খেলে আর কোনো সমস্যা দেখা দেয়ার কথা নয়। রোজায় সুষম খাবার পরিমাণমতো গ্রহণ করলেই শরীর সুস্থ থাকবে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সুষম খাবার খেয়ে রোজা রেখে ইফতারের আগে হাত-পা সঞ্চালনজাতীয় হালকা ব্যায়াম এবং সময়মতো নামাজ আদায় করলেই অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা রোজা থেকে ওজন কমানোর সুযোগ পাবেন বলেও উল্লেখ রয়েছে এই নিবন্ধে।
রোজার এই মাসে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান রোজা রাখবেন, এটাই স্বাভাবিক। অসুস্থতার কারণে অনেকেই হয়তো রোজা রাখতে পারেন না ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও। আবার অনেকে আছেন যারা হাইপারটেনশন, অ্যাজমা, পেপটিক আলসার কিংবা ডায়াবেটিসের মতো রোগকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে। এ ধরনের ব্যক্তিদের অনেকেই ইচ্ছা থাকার পরও রোজা রাখতে পারছেন না সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে। বিশেষজ্ঞদের মধ্যে যেসব রোগ ওষুধের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় সে ক্ষেত্রে খুব সহজেই রোজা রাখা সম্ভব। এসব রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা চাইলেই রোজা রাখতে পারেন বলে জানিয়েছেন ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রমাদান ফাস্টিং রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে গবেষকেরা বলেছেন, বিভিন্ন রোগের জন্য ব্যবহৃত ওষুধগুলো পরিবর্তন করে নিলেই রোজা রাখার পাশাপাশি রোগ নিয়ন্ত্রণ বা নিরাময় সম্ভব। ধরা যাক, কারো শ্বাসতন্ত্রের রোগ হয়েছে। এই রোগের জন্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক দেয়ার দরকার পড়লে, রোগী রোজা রাখতে চান এ কথাটি জানিয়ে দিলেই ডাক্তার রোগীকে যথার্থভাবে কার্যকর এমন ওষুধ দিয়ে দিতে পারবেন যা দিনে মাত্র দু’বার বা একবার খেতে হবে। এভাবে প্রতিটি রোগের ক্ষেত্রেই ডাক্তারকে আগেভাগে রোজা রাখার ইচ্ছার বিষয়টি জানিয়ে দিলেই সে অনুযায়ী ওষুধ নির্বাচন করার সুযোগ রয়েছে। বাজারে এখন অনেক ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক রয়েছে। এখন আর সেই দিন নেই যে, একটি মাত্র ওষুধই হাতে আছে আর সেটি খেতে হবে দৈনিক তিন থেকে চারবার। অ্যান্টিবায়োটিক ছাড়া পেপটিক আলসারের রোগীর জন্য প্রযোজ্য ওষুধের ক্ষেত্রেও একই কথা। এখন অনেক ওষুধ আছে যেগুলো এসিডিটি নিয়ন্ত্রণের জন্য দৈনিক একবার খেলেই চলে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের বেলায়ও একই ব্যবস্থা অবলম্বন করা যায়।
তবে কথা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে ওষুধ পরিবর্তন করার সময় অবশ্যই নিয়মিত চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকতে হবে। কারণ ওষুধ পরিবর্তনের ফলে রক্তচাপ খুব সহজে নিয়ন্ত্রণে নাও আসতে পারে। তাই উচ্চ রক্তচাপের রোগী যারা নিয়ন্ত্রিত বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খেয়ে রক্তচাপকে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তারা যদি রোজা রাখার জন্য নতুন শিডিউলে ওষুধ গ্রহণ করতে চান সে ক্ষেত্রে সপ্তাহখানেক আগে থেকে নতুন শিডিউলের ওষুধ গ্রহণ করে ট্রায়াল দিতে হবে। ট্রায়ালে যদি দেখা যায় নতুন ওষুধে সহজেই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তাহলে রোজা রাখা সহজ হবে। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রেও অবলম্বন করতে হবে একই রকম সতর্কতা। যেসব ডায়াবেটিক রোগী বিশেষ খাবার এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তাদের জন্য রোজা রাখা খুব সহজ ও উপকারী বলে উল্লেখ করা হয়েছে ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব রমাদান ফাস্টিং রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত নিবন্ধে। তবে যারা মুখে ওষুধ গ্রহণের মাধ্যমে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখছেন তারাও চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী রোজা রাখতে পারবেন, তবে ব্যায়াম করার ব্যাপারে সতর্ক হতে হবে, যাতে করে ব্যায়ামের ধকল বেশি হয়ে না যায়। আর ইনসুলিন গ্রহণকারী রোগীরাও রোজা রাখতে পারবেন; তবে এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শক্রমে ব্যবস্থা নিতে হবে।