মাঙ্কিপক্সের বিস্তার রোধে কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি
মাঙ্কিপক্স বা এমপক্স হলো মাঙ্কিপক্স ভাইরাসঘটিত এক বিশেষ ধরনের সংক্রামক বসন্ত রোগ। মাঙ্কিপক্স ভাইরাস একটি ডিএনএ (ডাবল স্ট্র্যান্ডেড) জুনোটিক বা প্রাণীজাত ভাইরাস, যা প্রাথমিকভাবে প্রাণী থেকে মানবদেহে সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে। বিশেষ করে ইঁদুরের মতো ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাধ্যমে এই ভাইরাস দ্রুত বিস্তৃত হয়। তবে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলেও মানবদেহে সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে। শ্বাসনালি, শরীরের কোনো ক্ষত, নাক কিংবা চোখের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানবদেহে প্রবেশ করে। এমনকি আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক থেকেও সুস্থদেহে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এটি পক্সভিরিডি পরিবারের অর্থোপক্সভাইরাস গণের অন্তর্গত। এই গণের অন্যান্য সদস্য হলো মানুষের গুটিবসন্ত সৃষ্টিকারী ভ্যারিওলা ভাইরাস, গোবসন্ত সৃষ্টিকারী কাউপক্স ভাইরাস, গুটিবসন্তের ভ্যাকসিন উৎপন্নকারী ভ্যাকসিনিয়া ভাইরাস প্রভৃতি। মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের রয়েছে দুটো উপপ্রজাতি। একটি হচ্ছে মধ্য আফ্রিকা ক্লেড—এ উপপ্রজাতি দ্বারা আক্রান্তে মৃত্যুহার ১০% পর্যন্ত হতে পারে। আরেকটি উপপ্রজাতি হচ্ছে পশ্চিম আফ্রিকা ক্লেড—এ উপপ্রজাতি দ্বারা আক্রমণে মৃত্যুর ঘটনা তেমন দেখা যায়নি। অন্যদিকে সমজাতীয় রোগ গুটিবসন্ত পৃথিবী থেকে ইতোমধ্যে বিদায় নিয়েছে এবং জলবসন্তে মৃত্যুহার নগণ্য।
মাঙ্কিপক্স নিয়ে জনমনে আতঙ্ক ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর একটি বড় কারণ হলো নিকটবর্তী কিছু দেশে ইতোমধ্যে থাবা বসিয়েছে এই ভাইরাস। অনেকেই আবার মাঙ্কিপক্সকে চিকেনপক্স ভেবে ভুল করেন। কারণ বর্তমান সময়ে সাধারণত জলবসন্ত বা চিকেনপক্সেরই প্রাদুর্ভাব বেশি এবং গুটি বা জলবসন্তের মতো মাঙ্কিপক্সের লক্ষণও অনেকটাই কাছাকাছি। দুটিই ভাইরাসঘটিত হলেও কিন্তু আলাদা সংক্রামক রোগ—সংক্রমণের তীব্রতা, ভাইরাসের ধরন সবই ভিন্ন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতোমধ্যে চলতি বছরের ১৪ আগস্ট মাঙ্কিপক্স নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা জারি করেছে। আফ্রিকার বাইরে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ইত্যাদি অঞ্চলে ইতোমধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে এমপক্স। এর আগে ২০২২ সালের জুন মাসে মাঙ্কিপক্স নিয়ে একইভাবে বৈশ্বিক জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়েছিল।
দ্য আফ্রিকা সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের তথ্যমতে, ২০২৪ সালের শুরু থেকে জুলাই পর্যন্ত ১৪,৫০০ জন মানুষ ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছেন এবং এ সময় মারা গেছেন অন্তত ৪৫০ জন। তথ্যমতে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অংশে চলতি বছর ১১-১৫ জন মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত ব্যক্তির সন্ধান পাওয়া গেছে।
মাঙ্কিপক্স প্রথমবারের মতো শনাক্ত হয় ১৯৫৮ সালে। ওই বছর ডেনমার্কে গবেষণাগারে পোষা বানরের মধ্যে এটি মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। প্রথমে এটি বানরের মধ্যে আবিষ্কৃত হওয়ায় রোগটির নাম হয় ‘মাঙ্কিপক্স’। তবে গবেষণায় পরে প্রমাণিত হয় যে, এই রোগের মূল বাহক হলো বিশেষ ধরনের শিকারি ইঁদুর গাম্বিয়ান পোউচড র্যাট এবং ডরমাইস নামের আফ্রিকান রডেন্ট বা ইঁদুর এবং কাঠবিড়ালির মতো বিভিন্ন রকমের ছোট স্তন্যপায়ী প্রাণী। মানুষের মধ্যে প্রথম মাঙ্কিপক্স সংক্রমণের ঘটনা ঘটে ১৯৭০ সালে কঙ্গোতে। তখন সেখানের একটি অঞ্চলে ৯ বছর বয়সী ছেলের মধ্যে মাঙ্কিপক্স শনাক্ত হয়। প্রথমদিকে মানব সমাজে রোগটির প্রাদুর্ভাব মূলত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার ১১টি দেশে সীমাবদ্ধ ছিল। পরে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, সিঙ্গাপুরসহ অন্য দেশেও এ রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যেতে থাকে। তবে সেসমস্ত ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তিদের আফ্রিকার দেশসমূহে ভ্রমণের ইতিহাস অথবা উক্ত দেশসমূহ থেকে আমদানিকৃত প্রাণীর সংস্পর্শে আসার ইতিহাস ছিল।
২০২২ সাল থেকে ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, পূর্ব এশিয়া, অস্ট্রেলিয়াতে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগী পাওয়া যেতে থাকে, যারা মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার রোগ উপদ্রুত অঞ্চলে ভ্রমণ কিংবা সে দেশের মাঙ্কিপক্সবাহক কোনো প্রাণীর সংস্পর্শেও আসেননি। অর্থাৎ বর্তমানে রোগটি আর কেবল আফ্রিকাতেই সীমাবদ্ধ নেই। আর এটিই বিজ্ঞানীদের চিন্তার কারণ। কোনো কোনো জনস্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ধারণা করছেন, হয়তো আগেই ইউরোপ বা উত্তর আমেরিকার মতো অঞ্চলে মাঙ্কিপক্সের উপস্থিতি ছিল। এখন কোনো অজানা কারণে তা হঠাৎ করে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু চলতি বছর পাকিস্তান এবং মধ্যপ্রাচ্যেও মাঙ্কিপক্সের অস্তিত্ব শনাক্ত হয়েছে এবং আমাদের দেশ থেকে অনেক ব্যক্তিই মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা, ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় বিভিন্ন প্রয়োজনে যাতায়াত করেন; সুতরাং বাংলাদেশ যে ঝুঁকিমুক্ত—এ কথা বলার কোনো অবকাশ নেই।
আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত ও লালারসের নমুনা পরীক্ষার মাধ্যমে শরীরে মাঙ্কিপক্স ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয় সম্ভব। বাংলাদেশে রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে এ ধরনের নমুনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। মাঙ্কিপক্সের সুপ্তিকাল সাধারণত ৬-১৩ দিন, তবে তা সর্বনিম্ন ৫ দিন থেকে সর্বোচ্চ ২১ দিন পর্যন্ত হতে পারে। মাঙ্কিপক্স ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথমে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, মাথাব্যথা, অবসাদগ্রস্ততা, মাংসপেশিসহ গা-হাত-পায়ে ব্যথার মতো প্রাথমিক উপসর্গ দেখা দেয়। ধীরে ধীরে শরীরের বিভিন্ন লসিকা গ্রন্থি ফুলে ওঠে। ত্বকে ছোট ছোট অসংখ্য গুটি, ফুসকুড়ি বা লাল দাগ দেখা যায়। এ ধরনের গুটি বা ফুসকুড়ি চামড়ার বেশ নিচ থেকেই উৎপত্তি হয়—এজন্য জলবসন্তের ফুসকুড়ির তুলনায় এমপক্সের ফুসকুড়ি বেশ স্ট্যাবল বা শক্ত ধরনের হয়। ক্রমেই সেই গুটি ক্ষত হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কোনো ব্যক্তি মাঙ্কিপক্স দ্বারা একের অধিকবার সাধারণত আক্রান্ত হন না। অর্থাৎ কোনো ব্যক্তি মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার পর সারাজীবনের জন্য আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদী রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে ওঠে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত রোগীর দেহে রোগ-লক্ষণ দেখা না দেওয়া পর্যন্ত সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্য কারো মধ্যে ভাইরাসটি ছড়ায় না। শরীরে ফুসকুড়ি (ভেসিকল বা পাস্তিউল) দেখা দেওয়া থেকে শুরু করে ফুসকুড়ির খোসা (ক্রাস্ট) পড়ে ক্ষত হওয়া পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তি হতে রোগটি ছড়াতে পারে।
অন্যদিকে চিকেনপক্স হলে শরীরে লালচে রঙের ঘামাচি বা র্যাশের মতো গুটি বের হয়। শরীরে ব্যথা, কাঁপুনি দিয়ে জ্বর ইত্যাদি লক্ষণে চিকেনপক্সের সঙ্গে মাঙ্কিপক্সের মিল আছে। চিকেনপক্সের ভাইরাস শরীরে ঢুকলে ৫-৭ দিনের মধ্যে শরীরে ফুসকুড়ি হয়। সেটা ধীরে ধীরে পানিভরা ফোসকার আকার নেয়। ফুসকুড়িগুলো খুবই নরম প্রকৃতির হয়ে থাকে। পরে কিছু ক্ষেত্রে ফোসকায় কিছুটা পুঁজের মতো তৈরি হয়। ৭-১০ দিন পর থেকে ফোসকা শুকাতে থাকে। জলবসন্তের ক্ষেত্রে সাধারণত হাতের তালু বা পায়ের তালুতে খুব বেশি ফুসকুড়ি হয় না। মাঙ্কিপক্সের ক্ষেত্রে জ্বরের তাপমাত্রা ১০৩ ডিগ্রি পর্যন্ত হতে পারে। সাধারণত জ্বরের ৩ দিনের মধ্যে শরীরে ফুসকুড়ি দেখা দেয়। ফুসকুড়ি মুখ থেকে শুরু হয়ে পর্যায়ক্রমে হাতের তালু, পায়ের তালুসহ শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ফুসকুড়ি তৈরি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই এর ভেতরে পুঁজ জমতে থাকে—এজন্য সময়ের সাথে ফুসকুড়িগুলো সাদাটে ধরনের হতে থাকে। মাঙ্কিপক্সকে এজন্য হোয়াইট পক্সও বলা হয়ে থাকে। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে পুরোপুরি সুস্থ হতে ২-৪ সপ্তাহ সময় লাগে। ফুসকুড়িগুলো পরে ত্বকে দাগের সৃষ্টি করতে পারে। চিকেনপক্স ও মাঙ্কিপক্সের লক্ষণগুলোর মধ্যে আরেকটি প্রধান পার্থক্য হলো মাঙ্কিপক্সের কারণে লসিকাগ্রন্থিগুলো ফুলে যায়।
মাঙ্কিপক্স থেকে আক্রান্ত ব্যক্তির নিউমোনিয়া, মস্তিষ্কে প্রদাহ, সেপসিস ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জটিলতা তৈরি হতে পারে। এমপক্স প্রতিরোধের জন্য মাঙ্কিপক্সের বিরুদ্ধে কার্যকর নির্দিষ্ট নিজস্ব কোনো টিকা নেই। তবে গুটিবসন্তের টিকা মাঙ্কিপক্স প্রতিরোধে প্রায় ৮৫ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু গুটিবসন্তের ভ্যাকসিনের সরবরাহ এখন সীমিত। কারণ বিশ্বব্যাপী রোগটি নির্মূল হয়েছে। তবে আশার কথা হলো বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভ্যাকসিনের উৎপাদন বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এই টিকার প্রথম চালান ইতোমধ্যে কঙ্গোতে পৌঁছে গেছে। এ যাবৎ মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসার জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো ওষুধও প্রচলিত ছিল না। রোগ-লক্ষণ অনুযায়ী মাঙ্কিপক্সের চিকিৎসা করা হয়। যেমন জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন, জলপট্টি নেওয়া ইত্যাদি। সাম্প্রতিক বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, কিছু অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ ব্যবহারে মাঙ্কিপক্সের তীব্রতা কিছুটা হ্রাস পায় এবং এসব ওষুধ প্রয়োগে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। এ ক্ষেত্রে রোগীদের দুটি ভিন্ন অ্যান্টি-ভাইরাল ওষুধ ব্রিনসিডোফোভির ও টেকোভিরিমাট দেওয়া হয়। তবে গবেষকদের দাবি, টেকোভিরিমাটে কার্যকর ফল পাওয়া গেলেও ব্রিনসিডোফোভির সেভাবে সফল হয়েছে, তা এখনই বলা যাবে না।
মাঙ্কিপক্সের বিস্তার রোধ করার জন্য কিছু বিষয় মেনে চলা জরুরি, যেমন- আক্রান্ত বা সন্দেহভাজন ব্যক্তির সরাসরি সংস্পর্শে আসা থেকে বিরত থাকা, আক্রান্ত ব্যক্তি এবং সেবা প্রদানকারী উভয়েরই মাস্ক ব্যবহার করা, সাবান পানি দিয়ে কমপক্ষে ৩০ সেকেন্ড সময় নিয়ে নিয়মিত হাত ধুয়ে ফেলা, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত দ্রব্যাদি সাবান বা জীবাণুনাশক বা ডিটারজেন্ট দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা, বিভিন্ন বন্দর বিশেষত বিমানবন্দরগুলোতে অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা, আক্রান্ত জীবিত বা মৃত বন্যপ্রাণী অথবা প্রাকৃতিক পোষক (যেমন ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশ) থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা। তবে সাধারণত গৃহপালিত প্রাণী (যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি, মহিষ) থেকে এ রোগ ছড়ায় না। এমপক্স সচেতনতায় ইতোমধ্যে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শরীরে মাঙ্কিপক্সের কোনো লক্ষণ দেখা দিলে অথবা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এলে অথবা সংক্রমিত দেশ ভ্রমণের ২১ দিনের মধ্যে এই লক্ষণ দেখা দিলে হটলাইন নম্বর ১৬২৬৩ বা ১০৬৫৫ নম্বরে যোগাযোগ করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার, মেডিসিন, খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, খুলনা।
এসইউ/এএসএম