ধূমপান না করলেও হতে পারে ফুসফুসের ক্যানসার, জানুন লক্ষণ
ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছেই। বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের মধ্যে চতুর্থ সর্বাধিক সাধারণ ক্যানসার হলো ফুসফুসের ক্যানসার। ধূমপায়ীদের মধ্যে এই রোগের ঝুঁকি বেশি। তবে ধূমপান ছাড়াও বিভিন্ন কারণে ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়তে পারে।
আজ বিশ্ব ফুসফুস ক্যানসার দিবস। প্রতিবছরের মতো এবারও বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে দিবসটি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপের অন্যতম ৮টি অফিসিয়াল পাবলিক হেলথ বিষয়ক দিবসের মধ্যে অন্যতম এই দিবস। এ দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো সারা বিশ্বে ফুসফুসের ক্যানসার ও এর প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করা।
আরও পড়ুন: ৫০ ধরনের ক্যানসার ধরা পড়বে এক টেস্টেই!
ক্যানসার কী?
বহুকোষী প্রাণীর শরীর অসংখ্য ছোট ছোট কোষের সমন্বয়ে তৈরি। এই কোষগুলো একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর মৃত্যুবরণ করে। আর এই পুরোনো মৃত কোষগুলোর স্থানে নতুন তৈরি হওয়া কোষ এসে জায়গা করে নেয়। সাধারণভাবে কোষগুলো নিয়ন্ত্রিতভাবে ও নিয়মমাফিক বিভাজিত হয়ে নতুন কোষের জন্ম দেয়।
তবে যখন এই কোষগুলো ক্যানসার সহায়ক অনকোজিন সক্রিয় হওয়ার কারণে অথবা ক্যানসার দমনকারী জিন নিষ্ক্রিয় থাকায় অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়তেই থাকে, তখনই ওই স্থানে মাংসের দলা অথবা চাকা দেখা যায়। যাকে বলা হয় টিউমার।
এই টিউমার বিনাইন কিংবা ম্যালিগন্যান্ট হতে পারে। ম্যালিগন্যান্ট টিউমারই ক্যানসার নামে পরিচিত। অর্থাৎ নিওপ্লাস্টিক বা টিউমার কোষ উচ্চহার বিশিষ্ট আক্রমণাত্মকতা, মেটাস্টাসিস ও শরীরের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা সম্পন্ন হলে তাকে ম্যালিগন্যান্ট টিউমার বা ক্যানসার বলে অভিহিত করা হয়।
আরও পড়ুন: অতিরিক্ত কাশি ও ক্লান্তি হতে পারে যে কঠিন রোগের লক্ষণ
ফুসফুসের ক্যানসার কী?
উপরোক্ত বিষয়গুলো ফুসফুসে সংঘটিত হলে তাকে বলা হয় ফুসফুসীয় ক্যানসার। শ্বাসতন্ত্রের যাবতীয় রোগের মধ্যে ফুসফুসের ক্যানসার সবচেয়ে মারাত্মক। আমাদের দেশে মরণব্যাধি ক্যানসারের সঠিক পরিসংখ্যান তেমন নেই।
ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যানসারের অনুমিত হিসাব অনুযায়ী, প্রতিবছর বাংলাদেশে ১ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যানসারে আক্রান্ত হন। আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রতি বছর মারা যান প্রায় ৯১ হাজার ব্যক্তি।
মৃত্যুবরণকারী ব্যক্তিগণ প্রধানত ফুসফুস, কোলোরেক্টাল, পাকস্থলী, লিভার, স্তন, খাদ্যনালী, প্যানক্রিয়াস ও জরায়ুমুখ ক্যানসারে ভুগেই মারা যান সবচেয়ে বেশি।
বাংলাদেশে শনাক্ত মোট ক্যানসার রোগীর প্রায় ১৬ শতাংশই ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত। ফুসফুসীয় ক্যানসার ফুসফুসের শ্বাসনালি, বায়ুথলি ও মিউকাস গ্ল্যান্ডের এপিথেলিয়াম ইত্যাদি যে কোনো কোষ থেকেই সৃষ্টি হতে পারে।
আরও পড়ুন: ফুসফুস ক্যানসারের ঝুঁকি জানা যাবে যে পরীক্ষায়
অনেক ক্ষেত্রে ক্যানসার শুধু ফুসফুসেই সীমাবদ্ধ না থেকে তা লসিকাগ্রন্থি ও অন্যান্য অঙ্গে (যেমন মস্তিষ্ক, হাড় ইত্যাদি) ছড়িয়ে পড়তে পারে। ক্যানসার কোষের ওপর নির্ভর করে ফুসফুসের ক্যানসারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
যেমন- স্মল সেল কারসিনোমা ও নন-স্মল সেল কারসিনোমা। নন-স্মল সেল কারসিনোমাকে আবার তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়- স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা (৩৫ শতাংশ), এডেনোকারসিনোমা (৩০ শতাংশ) ও লার্জ সেল কারসিনোমা (১৫ শতাংশ)।
এছাড়া ফুসফুসের অন্যান্য ধরনের ক্যানসারের মধ্যে এডিনয়েড সিস্টিক কারসিনোমা, লিম্ফোমা, সারকোমা প্রভৃতিদেখা যায়, যা মূলত দুর্লভ প্রকৃতির। সাধারণত শ্বাসনালীর গোড়ার দিকে স্কোয়ামাস সেল কারসিনোমা আর মাঝের দিকে স্মল সেল কারসিনোমা উৎপন্ন হয়। ফুসফুসীয় ক্যানসারের চিকিৎসার ভিত্তি হলো এই শ্রেণিবিভাগ।
আরও পড়ুন: সফুসের ক্যানসারের যে লক্ষণ ফুটে ওঠে মুখে
ফুসফুসের ক্যানসার কেন হয়?
বিশ্বব্যাপী পুরুষের মৃত্যুর প্রথম কারণ ফুসফুসের ক্যান্সার, আর নারীদের ক্ষেত্রে এটি দ্বিতীয় কারণ। গ্রামের চেয়ে শহরবাসীরাই ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হন বেশি। অবশ্য এর পেছনে যথাযথ কারণও বিদ্যমান- গ্রামের চেয়ে শহরে যানবাহন ও কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, বায়ুদূষণ, ধুলাবালি সবকিছুই অনেক বেশি।
অজৈব পদার্থের ক্ষুদ্র কণা বা আঁশ যেমন- এসবেস্টস, নিকেল, ক্রোমিয়াম ও জৈব পদার্থ যেমন- বেনজিন, বেনজোপাইরিন ইত্যাদি বায়ুর সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুসের ক্যানসার সৃষ্টি করতে পারে।
ফুসফুসের ওপর প্রতিনিয়ত অত্যাচারই এর জন্য দায়ী। ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ রোগীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপায়ী ও তামাকসেবী।
দিনে ২০টি করে ৪০ বছর সিগারেট খেলে ফুসফুসের ক্যানসার হওয়ার ঝুঁকি অধূমপায়ীর তুলনায়প্রায় ২০ গুণ বেশি। নিয়মিত ধূমপায়ীদের মধ্যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্মল সেল ক্যানসার হতে দেখা যায়। ফুসফুসের অন্যান্য ক্যানসারের তুলনায় এটি বেশি মারাত্মক ও অপেক্ষাকৃত দ্রুত শরীরের অন্যান্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: প্রচণ্ড কাশি হচ্ছে? ফুসফুসের ক্যানসার নয় তো!
আবার ফুসফুসের ক্যানসাররে আক্রান্ত রোগীর আত্মীয়ের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকিও অন্যদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, এই ক্যানসারের উৎপত্তিতে বংশগত প্রভাবও বিদ্যমান।
এছাড়া সিলিকোসিস, ইন্টারস্টিশিয়াল লাং ডিজিজ, সিস্টিক ফাইব্রোসিস, ক্রোনিক ব্রঙ্কাইটিস ইত্যাদি রোগগুলোতে ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকিও বেশ বৃদ্ধি পায়।
একই সঙ্গে শরীরের অন্য কোথাও ক্যানসার হলে সেই স্থান থেকে রক্তের মাধ্যমে দ্রুত ফুসফুসে ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকিও থাকে। যাকে বলা হয় ফুসফুসের সেকেন্ডারি কারসিনোমা। প্রায় ৪০ শতাংশ রোগীর ফুসফুসের ক্যানসার একদম শেষ পর্যায়ে গিয়ে ধরা পড়ে। এর কারণ হলো অবহেলা।
ফুসফুসের ক্যানসারের লক্ষণ কী কী?
ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম লক্ষণ হলো কাশি। কাশি যদি আট সপ্তাহের বেশি স্থায়ী হয় সঙ্গে বুকে ব্যথা থাকে তাহলে সাবধান হতে হবে। দুই-তৃতীয়াংশ রোগীর ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যানসারের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কাশি দেখা যায়। তবে কাশির সঙ্গে কফ তৈরি হবেই, এমন কোনো কথা নেই।
আরও পড়ুন: ফুসফুসে ক্যানসারের আগাম ৫ লক্ষণ
কারণ খুশখুশে কাশিও হতে পারে ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণ। কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠা ফুসফুস ক্যানসারের আরেকটি লক্ষণ। ধূমপায়ী পুরুষ রোগীদের ক্ষেত্রে এ লক্ষণটি আরও বেশি দেখা যায়। এছাড়া ক্যানসার কোষ শ্বাসনালির কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করে। তাই দেখা দিতে পারে শ্বাসকষ্টও।
তদুপরি দীর্ঘদিন গায়ে গায়ে জ্বর থাকা, হঠাৎ করে ডায়েট বা ব্যায়াম ছাড়াই প্রায় ৫ কেজি বা তার বেশি ওজন কমে যাওয়া, ঘনঘন নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়া, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে কর্কশ বা খসখসে হয়ে যাওয়া কণ্ঠস্বর বা কণ্ঠস্বরে হঠাৎ পরিবর্তন, দীর্ঘ সময়ব্যাপী ক্লান্তি বা অবসাদবোধ, দুর্বলতা, ক্ষুধামান্দ্য প্রভৃতিও হতে পারে ফুসফুসের ক্যানসারের লক্ষণ।
পাশাপাশি শরীরের বিভিন্ন অংশ, যেমন ঘাড়, পিঠ, বুক ও বাহুতে ব্যথা হতে পারে। যা কাশি দেওয়ার সময় আরো বেড়ে যায়। প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষের ফুসফুস ক্যানসার ধরা পড়ে বুক ও কাঁধের ব্যথা নির্ণয়ের মাধ্যমে।
ফুসফুসের ক্যান্সার শনাক্তকরণ
ফুসফুসের ক্যানসার শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে বুকে এক্স-রে করা হয়। মাইক্রোস্কোপের নিচে কফ বিশ্লেষণের মাধ্যমেও অনেক সময় ক্যানসার কোষের উপস্থিতি শনাক্ত করা সম্ভব। তবে ক্যান্সার শনাক্তের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো বায়োপসি।
আরও পড়ুন: চোখ ও ফুসফুসের ক্ষতিসহ বায়ুদূষণ কঠিন যে রোগের ঝুঁকি বাড়ায়
যেখানে অস্বাভাবিক কোষ বা টিস্যুর পর্যবেক্ষণ বা নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা হয়। প্রচলিত বায়োপসিগুলোর মধ্যে ব্রংকোস্কপি, মেডিয়াস্টিনোস্কপি, নিডল বায়োপসি ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
ফুসফুসীয় ক্যানসারের চিকিৎসা শুরু করার আগে ক্যানসার কোন পর্যায়ে আছে- তা নির্ণয় করা হয়। ক্যানসারের ধরন, অবস্থান ও আকার, স্টেজিং, গ্রেডিং ও রোগীর শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসার পরিকল্পনা করা হয়।
ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধের উপায়
ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। এজন্য সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে হবে ও খাবারের তালিকায় নিয়মিত তাজা ফলমূল ও শাকসবজি রাখতে হবে। উচ্চ ক্যারোটিনয়েড ও সালফোরাফেনযুক্ত খাবার যেমন- গাজর, কমলা, ক্যাপসিকাম, বাঁধাকপি, ব্রকোলি ক্যানসারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
আরও পড়ুন: নারীদের যে ক্যানসারের ঝুঁকি বেশি
তবে ফুসফুসের ক্যানসার প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো ধূমপান না করা ও তামক সেবন থেকে বিরত থাকা। এমনকি ধূমপায়ীর নিকটে অবস্থান করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। শিল্প কারখানা ও গাড়ির কালো ধোঁয়া নির্গমন গ্রহণযোগ্য মাত্রায় কমিয়ে আনা জরুরি।
বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন- ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম, অ্যাসবেস্টস ইত্যাদি এড়িয়ে চলাও বুদ্ধিমানের কাজ। আবার ফুসফুসের প্রদাহজনিত রোগ যেমন- যক্ষ্মা, নিউমোনিয়া ভালো হয়ে যাওয়ার পর ফুসফুসের আক্রান্ত স্থানে ক্যানসার দেখা দিতে পারে। তাই এ বিষয়ে যথাসম্ভব সতর্ক থাকা আবশ্যক।
৫০ বছরের বেশি বয়সী ব্যক্তি যদি ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে প্রতিদিন ২০টির বেশি সিগারেট ব্যবহার করেন, তাহলে তাদের ফুসফুসের ক্যানসারের জন্য স্ক্রিনিং করা উচিত। প্রাথমিক পর্যায়ে রোগটি ধরা পড়লে চিকিৎসার মাধ্যমে মৃত্যুহার অনেকটাই কমিয়ে আনা যায়। ফুসফুসের নিরাপত্তা অনেকাংশেই নিজের হাতে।
লেখক: এমবিবিএস (ঢাকা মেডিকেল কলেজ), বিসিএস (স্বাস্থ্য), মেডিকেল অফিসার,
উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ডুমুরিয়া, খুলনা।
জেএমএস/এমএস