সফলতা আসলে কী?
কে এম মাহমুদুল হক
জীবন সফল নাকি ব্যর্থ? প্রথমত এই হিসেব করাটাই আমার কাছে এক ধরনের দীর্ঘ আলোচনার বিষয় মনে হয়। কতগুলো প্রশ্ন এসে সামনে দাঁড়ায়। এই যেমন ধরুন জীবন সফল নাকি ব্যর্থ এই হিসেব কেন করতে হবে? সফলতা ব্যর্থতার হিসেব কি খুব বেশি জরুরি? ব্যর্থ হলে সে কেন ব্যর্থ হবে? আর সফল হলেই সে কেন সফল হবে? কোন কোন মানদণ্ডে সফলতা ব্যর্থতা নির্ণয় করা হবে? এটি কি একটি সার্বজনীন প্রক্রিয়া হবে? কে এই সফলতা ব্যর্থতা নির্ধারণ করবে? যিনি নির্ধারণ করবেন তার সে সর্বময় ক্ষমতার উৎস কী? জীবনের লক্ষ্য অর্জন করাই কি সফলতা? যে ব্যক্তির ইচ্ছে নেতিবাচক, তার ইচ্ছে পূরণ হওয়াটাও কি এক ধরনের সফলতা? আমিইবা কি এমন মহান ব্যক্তি যে সফলতা ব্যর্থতা নিয়ে কথা বলব? এরকম প্রশ্নের সারি হয়তো দীর্ঘতর হবে, সব প্রশ্নের উত্তর আপেক্ষিক বলে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা যেতে পারে কিংবা নিজের ইচ্ছেমতো সংজ্ঞায়ন করে কাটাকুটি করা যেতে পারে। এতকিছুর পরেও সমাজে নিজের ইচ্ছাই হোক আর পরের ইচ্ছাই হোক সফলতা ব্যর্থতার অস্তিত্ব থেকেই যায়। যে কোনো বিষয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে।
জ্ঞানকাণ্ডের একেবারে আদি থেকে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে সে বিতর্ক চলমান, একদিকে প্লেটো ও একদিকে অ্যারিস্টটল। একদিকে অভিজ্ঞতাবাদ অন্যদিকে যুক্তিবাদ। একদিকে ছুঁয়ে দেখার প্রবল ইচ্ছা (দেখা না দিলে বন্ধু কথা কইও না) অন্যদিকে ঐশ্বরিক ভালোবাসা বা ১৪ তলার উপরে যে ফুলের বাগান; সে ফুলের বাগানে বন্ধুর সাথে ভাবের লেনাদেনা। কখনো কখনো এরা একে অপরের বাইনারি। তবে এক, অভিন্ন, বাইনারি, বিপরীত, পরিপূরক যেভাবেই বলি না কেন, আমার কাছে মনে হয় কেবলই দুটি বহমান ধারা শত বিতর্কের পরেও যাদের অস্তিত্ব রয়ে গেছে। ঠিক এই জায়গায় এসে আমি আমার লেখা একটি কবিতার সারাংশ এভাবে তুলে ধরতে চাই- আক্ষরিক অর্থেই অঙ্কের খাতায় প্রবলভাবে সূত্রনির্ভর, যুক্তিনির্ভর বীজগাণিতিক ধারায় এক্স এর মান নির্ণয়ের জন্য আমরা যেমন একটি ‘ধরি’ কিংবা ‘মনে করি’ এর মতো ভাবের লেনদেন দিয়ে শুরু করি; তখনই বোধ করি যে এই ভাব-যুক্তির মিশেলেই আমাদের জীবন।
দিন শেষে সফলতার আলোচনা যেহেতু থেকেই যায়, সেখানে আমি এভাবেই যুক্ত করব যে- প্রতিটি মানুষের এক ধরনের নিজস্বতা রয়েছে, এক ধরনের স্বকীয়তা রয়েছে, সেই স্বকীয়তার পূর্ণ বিকাশের মধ্য দিয়ে মানুষের জীবনকে রাঙিয়ে তোলাটাই সফলতা। সফল শব্দের প্রথম স যুক্ত ব দিয়ে আলোচনা করি তাহলে এই নিজস্বতা বা স্বকীয়তার বিষয়টি আরও বেশি স্পষ্ট হবে। অর্থাৎ স্ব ফল। স্বীয় কর্মফল। যে কর্ম সুন্দর ফল উপহার দেয়। আমার আপনার কর্মটি ফলযুক্ত, ফলবান হবে। মানুষের উপকারে আসবে। আমি আপনি নিজেও সেই ফল উপভোগ করবো। মাত্রই ক’দিন আগে মধুমাস বলে খ্যাত জৈষ্ঠ্যে আমরা ফল উৎসব করলাম। অনেকটা সেরকমই প্রতিটি ফলের নিজস্বতা আছে, তবু পরিপক্ব ফল আমাদের ভিন্ন ভিন্নভাবে স্বাদ উপভোগের সুযোগ করে দেয়। আমি বলবো পরীক্ষার ফল উৎসবের চেয়ে কর্মফল উৎসব তাই অনেক বেশি ফলবান। আমি তাই বলি হার্ভার্ড থেকে পড়ে এসে আপনি যদি বউ পেটান, দেওবন্দ থেকে পড়ে এসে যদি বোনের সম্পত্তি দখল করেন কিংবা তালাক আর পরিবার প্রথা ভেঙে দেওয়ার মাঝেই একমাত্র নারীমুক্তি চিন্তা করেন; তবে আমি বলবো এগুলো বিষফল, পৃথিবীর জন্য নিস্ফল।
উচ্চশিক্ষার প্রসারে জেলায় জেলায় উঁচু উঁচু বিল্ডিং তৈরি করে তার কার্নিশে ছোট ছোট ঘাস লাগিয়ে যদি ভাবি অক্সিজেনের স্বল্পতা দূর হবে, সফল মানুষের কারখানা তৈরি হবে। তবে আমি বলব এগুলো বিষফল, এগুলো নিস্ফল। কতগুলো কালো কালো হরফ স্মৃতিতে ধারণ করে অথবা পরীক্ষার খাতায় উগরে দিয়ে নজরুল সফল হননি, শুধু রাজনীতি করলেই সকলে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠে না, আঙুলের ইশারায় অর্ধপৃথিবী শাসন করলেই সবাই ওমর হয়ে ওঠে না, কেউ কেউ স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে। এমনটাও ভাবার কোনো কারণ নেই যে যুদ্ধে পরাজিত হলেই কেউ ব্যর্থ হয়ে যায়, ইতিহাস থেকে নাম মুছে যায়। তাহলে পৃথিবীজুড়ে ইমাম হাসান হোসেনের লক্ষ কোটি ভক্ত তৈরি হতো না। যদিও বা আজকাল সফল বলতে কার কত ভক্ত আছে, তা ঠিক করে দেয়।
আমরা লাইক কমেন্ট ভিউয়ের যুগে প্রবেশ করেছি। সত্যি বলতে আমরা এখন প্রবেশ করেছি বললে ভুল হবে। আমাদের খুব ছোটবেলা থেকেই এই ভুলগুলো শেখানো হয়। আমার তো মনে হয় যে ক্লাসে আমি আমার জীবনের লক্ষ্য, এইম ইন লাইফ রচনা লিখেছি ঠিক সেই মুহূর্তেই সফল হওয়ার পথে আমি বিচ্যুত হয়েছি। সেই মুহূর্ত থেকেই আমরা পুঁজিবাদী চিন্তা লালন করতে থাকি, চাকরির বাজার চিন্তা করি, কী হলে অনেক ‘টাকা ইনকাম’ করা যাবে তা চিন্তা করে লক্ষ্য নির্ধারণ করি। এছাড়াও খেয়াল করবেন, আমরা যারা ছোটবেলায় এইম ইন লাইফ রচনা লিখেছি। কেউ আসলে সে অর্থে বড় হয়ে পুরোদস্তুর তা হয়ে উঠতে পারেনি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা লিখেছি একটা, হয়েছে আরেকটা। এমনকি শুধু রচনা লেখাতেই সীমাবদ্ধ নয়, আমরা আদতেই যা হতে চেয়েছি শেষ পর্যন্ত তা হয়ে উঠতে পারিনি। তাহলে এই লক্ষ্য নির্ধারণ আসলে কতটুকু সফল মানুষ তৈরি করবে?
এমনকি আমি এটাও বলি যে, মনে করি আমার জীবনের লক্ষ্য দেশের রাষ্ট্রপতি হওয়া। রাষ্ট্রপতি হওয়ার জন্য কতগুলো ধাপ অতিক্রম করতে হয় এবং আমি সে ধাপগুলো ক্রমান্বয়ে অতিক্রম করলাম এবং শেষ পর্যন্ত গিয়ে সর্বশেষ যে ধাপ রাষ্ট্রপতি সেটি হয়ে গেলাম। এটি যদি একটি মই বা সিঁড়ি হয়, তাহলে সর্বশেষ যে ধাপটি রয়েছে আমি সেটিতে আসীন হলাম। প্রশ্ন হলো যেদিন থেকে আমি সর্বশেষ ধাপে আসীন হলাম, তার পরদিন হতে আমার জীবনের আর কোলো লক্ষ্য নেই। কারণ আমি তো আমার লক্ষ্য অর্জন করে ফেলেছি। আমার জীবন কি এখানেই শেষ? এর পরের দিন থেকে আমি আসলে কী করবো? ধরে নিলাম একটা নির্দিষ্ট বছর রাষ্ট্রপতি থাকলাম। তারপর কী হবে? আমার জীবন কি থেমে যাবে? নির্দিষ্ট সময় রাষ্ট্র পরিচালনার পর আমি যদি অন্যায় করি, তখনও কি আমি সফলদের কাতারে থাকবো? থানা মাত্রিক ক্যাটাগরিতে ক্রাইটেরিয়াতে সফলতার কথা আমরা শুনতে পাই। যার যত নেটওয়ার্ক আছে; সে তত বেশি সফল। যার যত পাবলিকেশন আছে; সে তত বেশি সফল- এমন কথা আমরা হরহামেশাই শুনি।
মনে করি প্রথম বাক্যটির ক্ষেত্রে একজন মানুষের তেমন কোনো নেটওয়ার্কই নেই কিন্তু সে ঘরে বসে অনেক গবেষণার পরে মানব কল্যাণে কাজে লাগে এমন একটি আবিষ্কার করলেন। সে ক্ষেত্রে তিনি বেশি সফল নাকি অনেক মানুষের সাথে পরিচয় যার আছে কিন্তু তিনি মানুষের কল্যাণে কোন কাজ করেন না, তিনি বেশি সফল? আবার দ্বিতীয় বাক্যটির ক্ষেত্রে এমন একজন মানুষ যার অনেক অনেক পাবলিকেশন আছে, যিনি উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে দেশে ফিরে এসেছেন কিন্তু তিনি তার নিজের শিক্ষার্থীদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন এমনকি আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিয়েছেন, তিনি বেশি সফল নাকি একজন পলান সরকার সফল? আমি তাই বলি যে, মানুষের জীবনে ভালো থাকা আর ভালো রাখাটা মুখ্য। নিজে ভালো থাকতে গিয়ে অন্যের ভালো থাকাকে নষ্ট করা যাবে না। বরং অন্যের ভালো থাকাটাকে গুরুত্ব দিয়ে সে লক্ষ্যে কাজ করার আনন্দ যিনি বেশি উপভোগ করবেন তিনিই বেশি সফল। আমি ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার পুলিশ হতে চাই কারণ আমি দেশসেবা করতে চাই, ব্যাপারটি এমন না হয়ে বরং আমি কিছু হতে পারি আর না পারি মানুষের সেবা আমি করবোই, এটিই আমাদের ব্রত হওয়া উচিত।
ব্যক্তি জীবনে কারো জীবনকে অনুসরণ করে নয়, কারও মতো হতে হবে তা নয়। নিজের জীবনকে সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ করার মধ্য দিয়েই আপনি আপনি হয়ে উঠুন। নিজেকে জানান দিন। যেমনটি বলা হয়- পৃথিবীতে যেহেতু এসেই পড়েছিস দাগ কেটে যা। আপনার জীবনকে রাঙিয়ে তুলুন আর আপনার কর্মের মধ্য দিয়ে অন্যের জীবনে সুন্দর বয়ে আনুন। যেমনটি করে ফুল পাখি মৌমাছিরা।
তারপরও যেহেতু আমাদের সমাজে শিক্ষাব্যবস্থা প্রচলিত; সেহেতু যদি কেউ আমায় প্রশ্ন করেন যে, শিক্ষাজীবনে আমি কীভাবে সফল হতে পারি, তাহলে আমি বলবো, নিবিষ্ট মনে কাজ করুন। পূর্ণ বিকশিত হওয়া পর্যন্ত কাজটি চালিয়ে যান এবং সর্বশেষ, আপনার শিক্ষাকে মানব কল্যাণে কাজে লাগাবার জন্য লোকে কী বললো সেদিকে খেয়াল না করে যা যা করণীয় আপনি তাই তাই করুন। ছাত্রাবস্থায় মজা করুন কিন্তু সেই মজা আপনার এবং অন্যের জীবনে সাজা হিসেবে যেন ফিরে না আসে। মোটিভেশন শুনে শুনে রাত কাটিয়ে দিয়ে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় সস্তা বেসনের ফুলে ফেপে ওঠা প্রলেপ থাকে ভেতরে কিছু থাকে না। তাই শিখতে এসে মোটিভেশন না খুঁজে প্রতিটি অবস্থা থেকেই কিছু না কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করুন এবং সেটিকে কাজে লাগিয়ে সামনের দিনের কৌশল নির্ধারণ করুন। দিনশেষে কাজটা আপনাকেই করতে হবে। স্বীয় তাড়না না থাকলে বাইরের প্রবর্তনা খুব বেশিদূর নিয়ে যাবে না।
যদি কেউ কর্মজীবনের কথা বলেন তাহলে আমি বলব যে, সহকর্মীকে সহযোদ্ধা ভাবুন। সহকর্মী আপনার শত্রু নয়। আপনি তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবেন না। বরং আপনি সহযোগিতায় এগিয়ে যাবেন। আমি প্রায়ই বিভিন্ন যুদ্ধের ছবি দেখে মুগ্ধ হই। বুলেটের আঘাতে সহযোদ্ধা মারা গেছেন। তবু কত সম্মানের সাথে তাকে দাফন করা হয়। তার স্মৃতি চিরকাল বয়ে বেড়াবার জন্য একটা জিনিস সঙ্গে নিয়ে রাখা হয়। পরিবারের কাছে তার শেষ চিঠি পৌঁছে দেওয়ার জন্য নিজেই দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। অথচ আমরা আমাদের কর্মপরিবেশে দেখি একজন মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তেই তাঁর নামে কুৎসা রটনা করে অন্যের কোলে হাসিতে ঢলে পড়তে। কর্মক্ষেত্রে আমি বলবো ‘অ্যাক্ট’ করুন তবু ‘রিঅ্যাক্ট’ করবেন না।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।
এসইউ/এএসএম