শিশুর পড়ালেখা শিখতে সমস্যা হওয়ার কারণ ডিসলেক্সিয়া নয় তো?
ডিসলেক্সিয়া গ্রীক শব্দ। এর অর্থ হলো শব্দ সংক্রান্ত সমস্যা। ডিসলেক্সিয়া এক ধরনের লার্নিং ডিজিবিলিটি। যেখানে শিশুটির পড়তে ও লিখতে সমস্যা হয়। আজ পর্যন্ত এর কারণ, নিরাময় ও প্রতিরোধের উপায় চিকিৎসা বিজ্ঞানে প্রমাণিত হয়নি। তবে দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে ও কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে শিশু চিকিৎসা নিলে সাফল্য অর্জন করতে পারে শিশু।
পৃথিবীতে অনেক সফল ব্যক্তি ডিসলেক্সিয়াতে আক্রান্ত ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তাদের মধ্যে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, নেপোলিয়ন, আলবার্ট আইনস্ট্যাইন, টমাস এডিসন, স্টিভ জবস অন্যতম।
সব শিশুর শেখার ধরন বা গতি একই রকম হয় না। পরিবেশ, আগ্রহ, শিশুর বুদ্ধিমত্তা লেখাপড়ার করার গতিকে প্রভাবিত করে। যদি শিশুটিকে পড়া ও লেখা শেখার ক্ষেত্রে স্ট্রাগল করতে দেখেন বা অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক বেশি বিলম্ব বা পিছিয়ে পড়তে দেখেন তাহলে সতর্ক হতে হবে। এমন ক্ষেত্রে শিশুর ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুর শব্দকে ব্যাখ্যা করতে, বানান করতে, নতুন শব্দ শিখতে, শব্দ পড়তেও লিখতে সমস্যা হয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুটির মস্তিষ্ক, লিখিত শব্দগুলোকে আলাদাভাবে প্রসেস করে।
ব্রেনের কাজের পার্থক্যের কারণের মধ্যে প্রথমেই আসে জেনেটিক বা বংশগত কারণ, ৫০-৬০ ভাগ ঝুঁকি থাকে। এছাড়া মস্তিষ্কের যে অংশটি ভাষা শেখার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করে সেখানে ইনজুরি বা ট্রমা হলে, মাতৃগর্ভে থাকাকালীন ব্রেনের বিকাশে ত্রুটি দেখা গেলে ডিসলেক্সিয়া হতে পারে।
অনেক গবেষকের মতে, কিছু ভারী মেটাল বা ধাতু যেমন মারকারী, মায়ের খাবার বা নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে প্রবেশ করে ব্রেনের ডেভেলপমেন্টের সমস্যা তৈরি করে। এছাড়া কিছু ড্রাগ বা অ্যালকোহল মস্তিস্কের গঠনের ত্রুটি করতে পারে।
কিছু ভিটামিনের অভাব যেমন জিংক, ম্যাগনেসিয়াম, ভিটামিন বি১২ ও ভিটামিন ডি এর অভাবে শিশুর এ ধরনের সমস্যা হতে পারে।
ডিসলেক্সিয়া নির্ণয়ে নির্দিষ্ট কোনো পরীক্ষা থাকে না। আক্রান্ত শিশুটি বিভিন্ন মাত্রায় থাকে, সবার আলাদা ধরনের উপসর্গ প্রকাশ পায়। ২-৫ বছর বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে এ সমস্যা বেশি দেখা যায়। তবে ৪ বছরের আগে সম্ভব নয় কারণ এর চেয়ে কম বয়সে পড়া বা পেন্সিল ধরে লেখা সম্ভব না।
প্রাইমারি স্কুলে গিয়ে নির্ণয় করা সহজ হয়। তখন দেখা যায় শিশুটি বযস উপযোগী সহজ ও সাধারণ শব্দ সহজে লিখতে পারে না, উচ্চারণ করতে ও উচ্চারণ মনে রাখতে সমস্যা হয়, সহজ দিকনির্দেশনা বুঝতে পারে না। বয়স অনুযায়ী ছড়া বলতে ও মনে রাখতে সমস্যা হয়।
অনেক ক্ষেত্রে দিকনির্দেশনা যেমন ডান বাম বুঝতে পারে না। পাঁচ বছরের বেশি বয়সের শিশুরা বয়স অনুযায়ী নতুন শব্দ শেখা, মনে রাখা, উচ্চারণ করতে না পারা ও শব্দ গঠনের মূল ব্যাপার শিখতে না পারার সমস্যা থাকে। অক্ষর, শব্দ ও সংখ্যার ক্রম অনুসরণ করতে পারে না।
কিছু বর্ণ উল্টো করে লেখা এক বর্ণের স্থলে অন্য বর্ণ লেখে। সময়ের সঙ্গে বিষয়গুলোর উন্নতি নয় বরং অবনতি হয়- যেমন বর্ণ বা অক্ষর d স্থলে b লিখে, m স্থলে w লিখে, ১ উল্টো করে 6 মতো লেখে। শব্দ গঠনে ধ্বনির ক্রম অনুসরণ করতে পারে না। যেমন tip স্থলে pit লিখে থাকে।
বোর্ড থেকে দেখে কিছু লেখা, ডিক্টেশন বা শ্রুতলিপি ফলো করতে পারে না। হাতের লেখা খুব খারাপ হয় বয়স অনুসারে। পেন্সিল ধরতেও সমস্যা হয় অনেক সময়। রিডিং পড়া, লেখার ক্ষেত্রে ধীরগতি পরিলক্ষিত হয়। শিশুরা এগুলো করতে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে।
পড়া-লেখার কথা বললে তাদের মধ্যে তীব্র অনিহা দেখা যায়, তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়ে। সাধারণত এ ধরনের শিশুরা কোনো ঘটনা বা গল্প করার সময় সামঞ্জস্যতা বা ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারে না। যুক্তি ও বিচার বিশ্লেষক মূলক ধাঁধা, কৌতুক, পাজল বয়স অনুসারে বুঝতে পারে না।
প্রাইমারি ও প্রিপ্রাইমারি শিক্ষকদের অবশ্যই স্পেশাল লার্নিং ডিজেবিলিটি সম্পর্কে জানতে হবে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে ট্রেনিং নিতে ও দিতে হবে। তাহলেই তারা ডিসলেক্সিয়া আক্রান্ত শিশুদের সহায়তা করতে পারবে। প্রথম কাজই হবে শিশুটিকে অনুপ্রেরণা দেওয়া।
যেহেতু ডিসলেক্সিক শিশুদের পড়তে সমস্যা হয় তাই তাদের উচ্চস্বরে সবার সামনে দাঁড়িয়ে কিছু পড়া বা আবৃত্তি না করতে দেয়াই ভালো, এতে তারা বিব্রত হতে পারে। তাদের ভুল হলেও অন্যদের সামনে বলা যাবে না বা খারাপ মন্তব্য করা যাবে না।
ক্লাসের বাকি শিশুদের ইতিবাচক ব্যাখ্যা করতে হবে যেন শিশুটি অন্যদের আচরণ দেখে নিজেকে আলাদা না ভাবে। পড়া ভুলে গেলে শাস্তির প্রদান করা যাবে না বরং বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। মনে রাখার বিভিন্ন উপায় শিখিয়ে দিতে হবে যেমন- ক্যালেন্ডারে তারিখ, সময় দাগ দিয়ে রাখা, কালার পেন্সিল বা মার্কার দিয়ে টিক দিয়ে রাখা, পরিবারের অন্য সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক করে দিতে হবে।
পজিটিভভাবে তাদের কাছ থেকে কাজ আদায় করে নিতে হবে। ক্লাসে ডিসলেক্সিক কোনো শিশুর থাকলে তার প্রতি আলাদা মনোযোগ দিতে হবে। সহজ ও পরিষ্কারভাবে স্টেপ বাই স্টেপ বা ধারাবাহিকভাবে নির্দেশ দিতে হবে, সময় দিতে হবে, নির্দেশ মনে রাখা ও পালনে প্রয়োজনে বারবার বলতে হবে। মনে রাখতে হবে শিশুটি ইচ্ছাকৃত ভাবে কিছু করছে না, তার কোনো অপরাধ নেই।
ডিসলেক্সিক শিশুর বোর্ড থেকে কোন কিছু কপি করে খাতায় তোলাতে অসুবিধা হলে, তাকে সময় দিতে হবে, সামনে বসাতে হবে, প্রয়োজনে ফ্রেন্ডদের হেল্প করতে বলতে হবে। কোনো প্রশ্নের উত্তর লিখে দিতে না পারলে মুখে বলিয়ে আদায় করে নিতে হবে।
পরীক্ষার সময় আলাদা বর্ধিত সময় দেয়ার চেষ্টা করতে হবে। শিশুদের মনোযোগ ধরে রাখার জন্য ক্রিয়েটিভ বা মজার কোনো উপায় সাহায্য করতে হবে। নিয়মিত শিশুটির অগ্রগতি ও দিক নির্দেশনা নিয়ে অভিভাবকদের সাথে আলাপ আলোচনা করতে হবে।
বাবা মায়ের কর্তব্য বা ভূমিকা অপরিসীম ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত শিশুটির জন্য। তাড়াতাড়ি শনাক্তকরণ জরুরি। শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশের মাইলস্টোনগুলো জানতে হবে ও প্রফেশনালদের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে। খোলাখুলি কথা বলতে হবে, কুণ্ঠাবোধ করলে হবে না।
অন্যরা কি ভাববে, আমার শিশুকে অস্বাভাবিক বলবে, আমার প্যারেন্টিং এর দোষ দেবে, এগুলো ভাবলে হবে না। ছেলেমেয়ে আলসেমি করছে বা ফাঁকিবাজী করছে, ডিসিপ্লিন কড়াকড়ি করলে বা বয়স বাড়লে ঠিক হয়ে যাবে, এভাবে অবহেলা করা যাবে না।
ডিসলেক্সিয়ার সঙ্গে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বাবা-মার অনুপ্রেরণায় যথেষ্ট। গতানুগতিক পদ্ধতিতে লেখাপড়ার জন্য শুরুতে চাপ না দিয়ে শিশুর সঠিক স্কিলগুলো লক্ষ্য করুন।
ডেভেলপমেন্টাল মাইলস্টোন থেকে পিছিয়ে পড়া মানে সব সময় যে লার্নিং ডিজিবিলিটি হবে তা নয়। শিশুর জন্য অন্য সব প্রতিভা ও ভালো গুণগুলোর বিকাশের গুরুত্ব দিন।
পড়াশোনা শেখানোর বিশেষ পদ্ধতিগুলো জেনে নিন। শিশুকে সাহায্য করুন ও অনুপ্রেরণা দিন। সাফল্যের শুরুটা এখানেই। গ্রহণযোগ্যতা, স্নেহ, অনুপ্রেরণা ও সঠিক নির্দেশনাই যথেষ্ট, অন্য কিছুর দরকার নেই।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার; চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল।
প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ: ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ এন্ড হসপিটাল।
জেএমএস/জেআইএম