শিশুদের মাঙ্কিপক্স থেকে দূরে রাখার উপায়
বিশ্বজুড়ে মাঙ্কিপক্সের বিস্তার, বিশেষ করে ইউরোপের দেশগুলোতে এর প্রভাব বেশি দেখা যাচ্ছে। আমেরিকা থেকে অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। স্মলপক্সের মতো অতটা তীব্র নয় মাঙ্কিপক্স। দুটি রোগই ভাইরাসের এক একটি ধরন থেকে শরীরে দানা বাঁধে।
মূলত আফ্রিকায় এই মাঙ্কিপক্স দেখা যায়, আফ্রিকার বৃষ্টিঅরণ্যে এর মূল উৎস। তবে আফ্রিকায় যারা ভ্রমণ করেননি, তাদের মধ্যেও মাঙ্কিপক্সের উপস্থিতি বর্তমানে লক্ষ্য করা গেছে।
মাঙ্কিপক্সের চলমান প্রাদুর্ভাব নিশ্চিত করা হয়েছিল ৬ মে একজন ব্রিটিশ নাগরিকের মাধ্যমে। যিনি নাইজেরিয়া ভ্রমণ করে এসেছিলেন। ৪ মে যুক্তরাজ্যে ফেরত এসে তিনি লক্ষণ প্রকাশ করেন।
২৬ মে বিশ্বব্যাপী মাঙ্কিপক্সের সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে এবং প্রতিদিন বাড়ছে। যা ২১টি দেশে এরই মধ্যে পৌঁছে গেছে। ইউরোপীয় সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল থেকে সর্বশেষ এ তথ্য পাওয়া গেছে। যদিও শিশুদের মধ্যে মাঙ্কিপক্সের সংক্রমণ এখনো দেখা যায়নি।
মাঙ্কিপক্স হলো মাঙ্কিপক্স ভাইরাস দ্বারা সৃষ্ট একটি রোগ। ১৯৫৮ সালে ল্যাবে বানরের মধ্যে আবিষ্কৃত হলে এরকম নাম পাওয়া যায়। ভাইরাসটি সেই ভাইরাসের মতো, যা স্মলপক্স সৃষ্টি করে। তবে এটি কম সংক্রামক এবং সাধারণত হালকা রোগের কারণ।
মাঙ্কিপক্স একটি অর্থোপক্সভাইরাস, মাঙ্কিপক্স ভাইরাস পক্সভিরিডে পরিবারের অর্থোপক্সভাইরাসগণের অন্তর্গত। অর্থোপক্সভাইরাস জেনাসে ভ্যারিওলা ভাইরাস (যা গুটিবসন্তের কারণ), ভ্যাক্সিনিয়া ভাইরাস (গুটিবসন্ত ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত) ও কাউপক্স ভাইরাসে অন্তর্ভুক্ত।
মাঙ্কিপক্স বেদনাদায়ক হয় অনেকাংশে। মাঙ্কিপক্সের কারণে জ্বর, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, যেহেতু শরীর এই লক্ষণগুলোর সাথে লড়াই করে, লিম্ফ্যাডেনোপ্যাথি, বা বর্ধিত লিম্ফ নোড, প্রাথমিক লক্ষণগুলোর পরে দেখা দেয়।
এ উপসর্গগুলো তখন ফুসকুড়িতে পরিণত হয় যা প্রায়ই হাত, পা, মুখ, মুখ বা এমনকি যৌনাঙ্গে দেখা যায়। এই ফুসকুড়িগুলো উত্থিত প্রদাহ বা বেদনাদায়ক পুঁজ-ভরা লাল প্যাপিউলে রূপান্তরিত হয়। ফুসকুড়ি সমান দাগ হিসাবে শুরু হয় যা বড় হয়, পরে তরল দিয়ে পূর্ণ হয় ও ফোসকা হয়ে যায়।
খসখসে দাগ অথবা হালকা বা গাঢ় ত্বকের অংশগুলো স্ক্যাব পড়ে যাওয়ার পরেও থাকতে পারে। একবার সমস্ত স্ক্যাব পড়ে গেলে একজন ব্যক্তি আর সংক্রামক থাকে না। সাধারণত আক্রান্তরা ২-৪ সপ্তাহের মধ্যে ভালো বোধ করে। কিন্তু কখনো কখনো ভাইরাস একজন ব্যক্তিকে গুরুতর অসুস্থ করে তুলতে পারে।
স্মল পক্স ও মাঙ্কি পক্সের পার্থক্য
মাঙ্কিপক্সের ফলে গ্ল্যান্ড বা লিম্ফ নোড বড় হওয়ার প্রবণতা থাকে। দুটি ক্ষেত্রেই সঙ্গে থাকে জ্বর। সাধারণত এ রোগটি এমন লোকেদের মধ্যে ঘটে যারা সংক্রামিত প্রাণীর সংস্পর্শে এসেছে, কামড় বা স্ক্র্যাচ দিয়ে সংক্রমিত হতে পারে, বা কম রান্না করা প্রাণীর মাংস গ্রহণ করলেও হতে পারে।
মাঙ্কিপক্স আক্রান্তের সর্দি, কাশি থেকে এই রোগ ছড়িয়ে যায়। আক্রান্তের সঙ্গে অনেকক্ষণ মুখোমুখি কথা বললে এই রোগ ছড়িয়ে যেতে পারে। সঙ্গমের থেকেও এই রোগ ছড়াচ্ছে বলে গবেষকরা মনে করছেন। এছাড়া ভাইরাস রয়েছে এমন কোনো জিনিস, বা পোশাক, ভাইরাস আক্রান্তের রক্ত থেকে ছড়িয়ে যায় এই রোগ।
স্মলপক্স বা গুটিবসন্তের সাথে তুলনা করলে, মাঙ্কিপক্সে মৃত্যুর হার তুলনামূলকভাবে কম। সিডিসি কর্মকর্তাদের মতে, এর ক্ষেত্রে মৃত্যুর হার ৪ শতাংশেরও কম।
শিশুদের মধ্যে মাঙ্কি পক্সের সংক্রমণ এখনো পর্যন্ত বিশেষ দেখা যায়নি। তবে প্রাপ্তবয়স্কের তুলনায় শিশুদের মধ্যে মাঙ্কিপক্সের উপসর্গ খানিক আলাদা। শিশুদের জ্বরের তাপমাত্রাটা অনেকে বেশি হয় ও বেশি দিন স্থায়ী হয়। জ্বরের ৩-৪ দিনের মাথায় গায়ে ফুসকুড়ি দেখা দেয়।
এটি ধীরে ধীরে বড় হয়ে ফুলে যেতে থাকে। প্রচণ্ড মাত্রায় ক্লান্তি ও দুর্বলতা থাকে। তবে শিশুদের মধ্যে মাথা ব্যথার মতো কোনো উপসর্গ দেখা যায় না। মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত হলে শিশুদের মধ্যে আর্দ্রতার অভাব দেখা যায়। সে সময় বেশি করে তরল খাবার খাওয়ানো উচিত।
শিশুদের মাঙ্কিপক্স থেকে দূরে রাখতে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা মেনে চলতে হবে। যেমন- খাবার ভালো করে সেদ্ধ করে নিতে হবে, খেয়াল রাখতে হবে শিশু যেন হাত না ধুয়ে খাবার না মুখে দেয় বা সঠিক ভাবে স্যানিটাইজার মাখিয়ে ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুয়ে নেয়।
রাস্তার বিড়াল, কুকুর দেখলেই শিশুরা তাদের ছোঁয়ার চেষ্টা করে, যেহেতু পশু থেকে যেহেতু এই রোগ ছড়ায় ফলে শিশুদের এ ধরনের কাজ থেকে বিরত রাখতে হবে।
ফুসকুড়ি আছে এমন ব্যক্তির সংস্পর্শে শিশুকে আসতে না দেওয়াই ভাল। অনেক দিন ধরে জ্বর, সর্দি-কাশিতে ভুগছেন এমন ব্যক্তির কাছ থেকেও শিশুকে দূরে রাখতে হবে।
গবেষকদের মতে,শরীরে রক্ত ও লালারসের নমুনা পরীক্ষা করলে শরীরে মাঙ্কি পক্সের উপস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব। সন্দেহজনক ব্যক্তির রক্ত বা লালারসের নমুনা ভাইরোলজিতে পরীক্ষার জন্য পাঠাতে হবে।
গবেষকদের মতে সাধারণত ৭-৪ দিনের মধ্যে রোগমুক্তি ঘটলেও অনেক ক্ষেত্রে ৫-২১ দিনও লাগতে পারে। তাই এমন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেলে তার সংস্পর্শে আসা লোকজনকেও চিহ্নিত করে ২১ দিন পর্যন্ত আইসোলেশনে রাখতে হবে।
২ সপ্তাহের মধ্যে নিজে থেকেই সেরে ওঠে বেশিরভাগ রোগী। অল্প থাকতেই বা লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসায় সেরে ওঠে মাঙ্কিপক্স। তবে প্রয়োজনে ওষুধের দরকার পড়ে। ২০১৮-২০২১ সালের মধ্যে ব্রিটেনে মাঙ্কিপক্সে আক্রান্ত সাতজন নিয়ে গবেষণা চালানো হয়।
গবেষণার সমীক্ষা সম্প্রতি ল্যানসেট পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়। এই গবেষণা অনুযায়ী বলা হয় এমন কিছু ‘অ্যান্টি ভাইরাল’ ওষুধ আছে যা প্রয়োগ করলে মাঙ্কিপক্সের উপসর্গগুলোকে প্রশমিত করা সম্ভব। শুধু তা-ই নয়, এসব ওষুধের প্রয়োগ করে রোগীরা দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছেন বলে দাবি গবেষকদের।
এক্ষেত্রে রোগীদের উপর দুটি ভিন্ন অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ- ব্রিনসিডোফোভির ও টেকোভিরিমাট (TPOXX নামেও পরিচিত) হলো একটি অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ, যা ইউনাইটেড স্টেটস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (FDA) দ্বারা অনুমোদিত, প্রয়োগ করে আশানুরূপ ফলাফল পেয়েছেন গবেষকরা।
মাঙ্কিপক্সের এখনো কোনো প্রতিকার নেই। মাঙ্কিপক্স সেলফ লিমিটিং রোগ মানে এটি চিকিৎসা ছাড়াই ভালো হতে পারে। তবে কিছু ওষুধ এটির প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ করতে ও রোগের বিস্তার রোধ করতে ব্যবহার করা হয়।
মাঙ্কিপক্সের প্রাদুর্ভাব রোধ করতে স্মলপক্স ভ্যাকসিন, সিডোফোভির, এসটি ২৪৬ ও ভ্যাক্সিনিয়া ইমিউনোগ্লোবিউলিন ব্যবহার করা যেতে পারে।
লেখক: কনসালটেন্ট, নিউরোডেভলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট এন্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল; প্রাক্তন অটিজম বিশেষজ্ঞ, ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল।
জেএমএস/এএসএম