নারীর অগ্রগতি হলেও লিঙ্গ সমতা আজও প্রতিষ্ঠিত হয়নি
আফরোজা নাইচ রিমা
মানুষ স্বভাবতই স্বাধীনচেতা প্রাণি। পরাধীনতার নাগপাশ থেকে সবসময় চেয়েছে মুক্তি। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান জন্ম নিলেও পূর্ব পাকিস্তানের লোকজন হয়েছে নানা দিক থেকে বঞ্চিত। এভাবেই হয়েছে ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৯ এর গণ আন্দোলন পরবর্তীতে ও ৭১ এর মহান স্বাধীনতা আন্দোলন।
তবে তারও আগে ১৮৪৮ সালের ১৯-২০ জুলাই নিউইয়র্কে সর্বপ্রথম নারীদের অধিকার নিয়ে এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কে সোস্যালিস্ট পার্টি অব আমেরিকার উদ্যোগে নির্ধারিত সময় ও সমমজুরির দাবিতে ধর্মঘট পালন করেন নারী বস্ত্র শ্রমিকরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম নারী দিবস পালন করা হয়।
১৯১০ সালে জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে শ্রমজীবী নারীদের নিয়ে অনুষ্ঠিত কোপেনহেগেন সম্মেলনের পর ১৯ মার্চ অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডে নারী দিবস পালিত হয়। ১৯১৭ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নে নারীরা ভোটাধিকার পাওয়ার ফলে ৮ মার্চ সেখানে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে পালিত হতে থাকে।
তারপর থেকেই সমাজতান্ত্রিক দলগুলো কমিউনিস্ট শাসিত দেশগুলোয় ৮ মার্চ নারী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৭৫ সালে আন্তর্জাতিক নারী বর্ষ উপলক্ষে জাতিসংঘ দিবসটি প্রথম পালন করে। তারপর ১৯৭৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে ৮ মার্চকে নারী অধিকার ও বিশ্ব শান্তি দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।
সংবিধানের প্রস্তাবনায়, দ্বিতীয় অধ্যায়ের মূলনীতিতে, সংবিধানের তৃতীয় ভাগে, ২৭ নং অনুচ্ছেদে, ২৮(২) অনুচ্ছেদে, ২৮(৪) উপ-অনুচ্ছেদে, ৬৫(৩) অনুচ্ছেদে নারীর জন্য জাতীয় সংসদের আসন সংরক্ষিত রাখা হয়।
সংরক্ষিত আসনে ১৫ জন নারী সদস্য নিয়ে প্রথম সংসদের যে যাত্রা শুরু, পরবর্তীকালে তা পর্যায়ক্রমে বৃদ্ধি পেয়ে ৫০ জনে উন্নীত হয়। সংরক্ষিত আসনের ব্যবস্থা থাকলেও ৬৫(২) অনুচ্ছেদের অধীনে প্রত্যক্ষভাবে ৩০০ আসনে ও নারীর অংশগ্রহণের সমান সুযোগ আছে।
সংবিধানের পরিপ্রেক্ষিতে নারী-পুরুষ সমতা ওনারীর ক্ষমতায়নকে সুসংহত করার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত হয়। পরবর্তীতে বিশ্বের সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ২২টি লক্ষ্য ও ২৫টি অধিক্ষেত্রসহ ২০১১ সালে নারী উন্নয়ন নীতি পুনরায় গঠন করা হয়।
যেখানে গণমাধ্যমে নারী ও কন্যাশিশুর ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরাসহ জেন্ডার প্রেক্ষিত প্রতিফলিত হয়। প্রতিবন্ধী নারী ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী নারীর অধিকারের উপরও দেওয়া হয় বিশেষ নজর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে প্রাণে নারী-পুরুষের সমঅধিকারে বিশ্বাস করতেন। নারী-পুরুষ সমানভাবে এগিয়ে না এলে কোনো দেশের উন্নতি সম্ভব নয়, তিনি তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন- ‘নয়াচীনের মেয়েরা আজকাল জমিতে, ফ্যাক্টরিতে, কল-কারখানাতে, সৈন্য বাহিনীতে দলে দলে যোগদান করছে।
সত্য কথা বলতে গেলে, একটি জাতির অর্ধেক জনসাধারণ যদি ঘরের কোণে বসে শুধু বংশবৃদ্ধির কাজ ছাড়া আর কোনো কাজ না করে তাহলে সেই জাতি দুনিয়ায় কোনো দিন বড় হতে পারে না। নয়াচীনে পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার কায়েম হওয়াতে আজ পুরুষ জাতি অন্যায় ব্যবহার করতে পারে না নারী জাতির ওপর।
তিনি আরও লিখেন, ‘নয়াচীনের উন্নতির প্রধান কারণ পুরুষ ও নারী আজ সমানভাবে এগিয়ে এসেছে দেশের কাজে, সমানভাবে সাড়া দিয়েছে জাতি গঠনমূলক কাজে, তাই জাতি আজ এগিয়ে চলেছে উন্নতির দিকে।’ (আমার দেখা নয়াচীন, শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলা একাডেমি)
সর্বস্তরে যাতে নারী অংশগ্রহণ করতে পারে সে জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার গ্রহণ করেছেন ১০ উদ্যোগ। এর মধ্যে নারীর ক্ষমতায়ন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া নারী-পুরুষের সমঅংশগ্রহণের ভিত্তিতে উন্নত, উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো যেন সমসমাজ গঠন করতে পারে এজন্য টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) এর ৫ নম্বর গোল-এ’ জেন্ডার সমতা অর্জন এবং নারী ও শিশুর ক্ষমতায়ন এর কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে জেন্ডার সমতা অর্জনের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে নানা প্রকল্প।
বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে হয়েছে উন্নয়নশীল দেশের রোল মডেল।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেছেন, ‘বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। বর্তমানে সংসদে ৭৩ জন নারী সংসদ সদস্য। এর মধ্যে ২৩ জন নির্বাচিত নারী সংসদ সদস্য। সংসদ নেতা, বিরোধী দলীয় নেতা, সংসদ উপনেতা, স্পিকারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে নারীরা সাফল্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।’
বিশ্ব অৰ্থনৈতিক ফোরাম প্রকাশিত ২০২০ বৈশ্বিক জেন্ডার অসমতা প্রতিবেদনে জেন্ডার পার্থক্য কমিয়ে আনায় সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ ০ দশমিক ৭২৬ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশ ১৫৩টি দেশের মধ্যে ৫০তম স্থান অধিকার করে নিয়েছে।
নারী আন্দোলনের দীর্ঘ পথপরিক্রমায় নারী সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি সাধিত হলেও জেন্ডার সমতার বিষয়টি এখনও পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি। এ চিত্র শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর সর্বত্র দৃশ্যমান। সমাজের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর (নারী) অংশগ্রহণ ছাড়া কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে সত্য। তবে তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রার একটুখানি হলেও নিচে অবস্থান করছে। শুধু তাই নয়, নারী নির্যাতন ও বঞ্চনাও উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা সম্ভব হয়নি। দেশের নারী সমাজ এখনো নানা ধরনের পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় নির্যাতন-বঞ্চনার শিকার।
শিল্পক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের বঞ্চনা একটি আলোচিত বিষয়। যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় কুসংস্কার, পারিবারিক জীবনে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের আধিপত্য, প্রথা, মান্ধাতার আমলের মনোকাঠামো ইত্যাদি নারী অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এসব অতিক্রম করার নিরন্তর প্রচেষ্টা চলছে দেশে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নেওয়া হচ্ছে নানা উদ্যোগ।
এদিকে ১৯৭১ সালে ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম পালিত হয় নারী দিবস। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আর্ন্তজাতিক স্বীকৃতি পায় নারী দিবস। সেই থেকে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।
৮ মার্চ ২০২২ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘টেকসই আগামীর জন্য জেন্ডার সমতাই আজ অগ্রগণ্য’ ইংরেজিতে ‘Gender equality today for a sustainable tomorrow’। ডিজিটাল বাংলাদেশ ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে বাংলাদেশের নারীরা সবক্ষেত্রে তাদের আলো ছড়িয়ে দিয়ে দেশকে আরো নব আলোকে নব ধারায় এগিয়ে নিয়ে যাবে এটাই হোক স্বাধীনতার ৫০ বছরের প্রত্যাশা।
লেখক: সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর।
জেএমএস/জেআইএম