মাংস যেভাবে সংরক্ষণ করলে ভালো থাকবে দীর্ঘদিন
আর মাত্র কয়েকদিন পরেই ঈদুল আজহা। এই ঈদকে কোরবানির ঈদ বলা হয়ে থাকে। এই ঈদে সবাই তাদের সাধ্যমতো পশু কোরবানি দিয়ে থাকেন। কোরবানির মাংস গরীব-দুঃখীদের বিলিয়ে দেওয়ার পরেও নিজেদের খাওয়ার জন্য কিছু মাংস রেখে দেন কমবেশি সবাই। তবে টাটকা মাংস সংরক্ষণের ভুলে দীর্ঘদিন তা ভালো নাও থাকতে পারে।
মাংস সংরক্ষণের যদিও বিভিন্ন উপায় আছে। তবে বর্তমান কর্মব্যস্ত জীবনে সবাই রেফ্রিজারেটরেই মাংস সংরক্ষণ করতে পছন্দ করেন। অনেকেই মনে করেন, পলিথিন বা যেকেনো ব্যাগে ডিপ ফ্রিজে মাংস রেখে দিলেই তা মাসের পর মাস ভালো থাকে। আসলে সঠিক পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ করা না হলে, মাংসের পুষ্টিগুণ কমতে শুরু করে। যা হয়তো আপনি বুঝতে পারবেন না। এমনকি ভুল উপায়ে মাংস সংরক্ষণ করা হলে তা শরীরে বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে।
রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি বছর ৪৮ মিলিয়ন মানুষ খাবার সংরক্ষণের ভুলে নিজ ঘরের খাবার খেয়েই খাদ্য বিষক্রিয়ার ফলে অসুস্থ হয়ে পড়েন। মূলত খাদ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না হলে, পরবর্তীতে ওই খাবার খেয়ে আপনি যেকোনো সময় অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন।
মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) নির্দেশিকা অনুসারে, রেফ্রিজারেশন করা খাবারে দুই ধরনের ব্যাকটেরিয়া বৃদ্ধি পেতে পারে। এক, রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু। এই জীবাণুগুলো খুবই বিপজ্জনক। কারণ খাবারে বাসা বাঁধা এই জীবাণু খাদ্যজনিত অসুস্থতার কারণ। কাঁচা বা অপরিশোধিত খাবারে দ্রুত বৃদ্ধি পায় এই জীবাণু।
দুই, স্পাইলেজ ব্যাকটেরিয়া। এই ব্যাকটেরিয়া খাবার নষ্ট করে দেয়। এর ফলে খাবারের স্বাদ, চেহারা এবং গন্ধ পরিবর্তন হয়ে যায়। তবে এই ব্যাকটেরিয়া দ্বারা আপনার অসুস্থ করার সম্ভাবনা অনেক কম। তাই নিয়ম অনুযায়ী খাবার বা মাছ-মাংস সংরক্ষণ করা না হলে ফ্রিজে রাখলেও তাতে জীবাণু বাসা বাঁধতে পারে।
কোরবানি ঈদ আসলে সবার কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে যায়, কীভাবে টাটকা মাংস দীর্ঘদিন ভালো রাখা যাবে? মাংস সংরক্ষণের মূল উদ্দেশ্য হলো- মাংসকে জীবাণুমুক্ত রাখা, মাংসের স্বাদ ও গুণগত মান যতটা সম্ভব অক্ষুন্ন রাখা। এ ছাড়াও মাংসের পচন রোধ করা এবং মাংস দ্বারা খাদ্যবাহিত রোগ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করে আর্থিক ক্ষতি কমানো।
মাংস কীভাবে ফ্রিজে সংরক্ষণ করবেন?
শুধু গরু বা খাসি নয় মুরগির মাংসও আপনি রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করতে পারেন। হিমশীতল এবং খাদ্য সুরক্ষার বিষয়ে ইউএসডি’র নির্দেশিকা হলো, মাংস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে তা যেন, শূন্য ডিগ্রি ফারেনহাইট (-১৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড) এ জমাট বাঁধে। এর ফলে ব্যাকটেরিয়া, ইস্টসহ ক্ষতিকর জীবাণুগুলো নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়। পাশাপাশি খাবার নষ্ট করে যেসব এনজাইম, সেগুলোর কার্যক্রমও ধীর হয়ে যায়।
এফডিএ’র পরামর্শ অনুযায়ী, এভাবে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় মাংস সংরক্ষণ করে আপনি ৪-১২ মাস পর্যন্ত খেতে পারবেন। তবে মাংসের সাইজগুলো একটু বড় করে রাখতে হবে। অন্যদিকে কিমাজাতীয় গরু বা খাসির মাংস ৩-৪ মাসের বেশি হিমায়িত করা উচিত নয়। অন্যাদিকে রান্না করা মাংস আপনি হিমায়িত করে ২-৩ মাস পর্যন্ত খেতে পারবেন। এর বেশি হলে খাবারের পুষ্টিগুণ কমতে শুরু করবে।
মাংসে যতটা কম চর্বি থাকবে; তা বেশিদিন সংরক্ষণ করা যাবে। তাই মাংস সংরক্ষণের আগে অবশ্যই চর্বি সরিয়ে রাখতে হবে। আবার মাংস কাটার ধরন যেন বেশি মোটা না হয়, স্লাইস করে রাখলে বেশি ভালো থাকবে। মাংস সংরক্ষণ করতে অবশ্যই জিপলক ব্যাগ ব্যবহার করা উচিত। অবশ্যই মাংস ছোট ছোট প্যাকেটে সংরক্ষণ করবেন। অনেকেই বড় প্যাকেট করে থাকেন, বারবার সেই প্যাকেট ভিজিয়ে পরিমাণমতো মাংস রেখে আবারও ওই প্যাকেট ফ্রিজে রেখে দেন। এমনটি করলে মাংস নষ্ট হয়ে যাবে।
তবে সেই ব্যাগ যেন খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন প্লাস্টিক ব্যাগ বা বক্স ব্যবহার করবেন না। সবচেয়ে ভালো হয় ভ্যাকিউম-সিল্ড ব্যাগ ব্যবহার করা। মাংসের পুষ্টিমান ও স্বাদ ভালো রাখতে চাইলে গরুর মাংস ৮-১২ মাস এবং যেকোনো ধরনের মুরগির মাংস ৩-৬ মাসের বেশি ফ্রিজে সংরক্ষণ করা উচিত নয়। মাংস সংরক্ষণের আগে প্রয়োজন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নভাবে মাংস কাটা, ধোয়া এবং সঠিক পাত্র ব্যবহার করা।
শুধু ফ্রিজে রেখে নয়, আরও যেসব উপায়ে মাংস সংরক্ষণ করতে পারবেন-
ড্রাইং পদ্ধতি: অতীতে যখন ফ্রিজের ব্যবহার ছিলো না; তখন পুরোনো এই পদ্ধতিতে মাংস রোদে বা চুলায় জ্বাল দিয়ে ৭০-৮০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় সম্পূর্ণ পানি শুকিয়ে নিতে হয়। এই পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণ খুবই কম খরচে করা যায়। এক্ষেত্রে মাংসের চর্বি ফেলে দিয়ে পাতলা করে কেটে ভ্যাকিউম-সিল্ড করে ফ্রিজে ১ বছর পর্যন্ত রাখা যায়।
স্মোকিং পদ্ধতি: এটিও একটি পুরোনো পদ্ধতি। যেখানে হট স্মোকিং অর্থাৎ ৩০০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় মাংস পোড়ানো হয়। আর কোল্ড স্মোকিং পদ্ধতিতে ১২-২৪ ঘণ্টা স্মোকিং আগুনে ৮৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় পোড়াতে হয়। এর ফলে তাপের ধোঁয়ায় মাংসের মাইক্রোবসগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এই পদ্ধতি সাধারণত মাংস ব্যবসায়ীরা ব্যবহার করে থাকেন।
সল্টিং বা লবণ পদ্ধতি: এই পদ্ধতিতে লবণ, কিউরিং লবণ, মসলা এবং ব্রাউন চিনি অথবা খাবার লবণ, সোডিয়াম নাইট্রেট ও সোডিয়াম ল্যাকটেট দিয়ে মাংস মেখে ২৪ ঘণ্টা রেখে ফ্রিজে ১ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। এই পদ্ধতি টিএফডিএ অনুমোদিত। সল্টিং পদ্ধতিতে মাংস সবচেয়ে বেশি টাটকা এবং পুষ্টিগুণসম্পন্ন হয়ে থাকে। মাংসের অক্সিডেটিভ ও মাইক্রোবিয়াল পচন প্রতিরোধ এই পদ্ধতিতে সবচেয়ে ভালো হয়।
ক্যানিং পদ্ধতি: মাংস সংরক্ষণের আরও এক পদ্ধতিকে থার্মাল স্টেরিলাইজেশন বলে। এক্ষেত্রে মাংস প্রায় ২৫০ ডিগ্রি ফারেনহাইট তাপমাত্রায় ড্রাই করে ঠান্ডা করা হয়। এরপর কাচের জার বা বয়ামের মুখ আটকে তাতে এই মাংস প্রায় এক বছর রাখা যায়। এই পদ্ধতিতে মাংস সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মাংস কাটা, রান্নার আগে সিমিং, তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, ঠান্ডা করা ইত্যাদি বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে।
সূত্র: হেলথলাইন
জেএমএস/এমএস