ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

জন আস্থা ধ্বংস করেছে গত তিনটি সংসদ নির্বাচন: হাইকোর্ট

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৯:৫১ এএম, ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির পর বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে জনগণের আস্থার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। ওই তিনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো ও নির্বাচনী ব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে বলে রায়ে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপসহ বেশ কিছু বিষয়ে আনা সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুল আংশিক যথাযথ (অ্যাবসোলুট) ঘোষণা করে দেয়া ঐতিহাসিক রায়ে হাইকোর্টের বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এমন পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন।

রায়ে আদালত বলেন, সংবিধান হচ্ছে একটি দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্য সব আইনই সংবিধানের নিরিখে হওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট হচ্ছে সংবিধানের অভিভাবক। যে কোনো আইনের বৈধতা নিরূপণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের রয়েছে।

হাইকোর্ট আরও বলেন, সংবিধান কেবল অতীত ও বর্তমানকে নিরূপণ করে না। এটা ভবিষ্যতেরও দিশারী। একইভাবে সংবিধান কেবল একটি দালিলিক বিষয় নয়, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সংবিধান একটি জাতির ভিত্তি এবং মৌলিক নির্দেশকও। একই সঙ্গে তা বিকাশমান এবং পরিবর্তনশীল।

আরও পড়ুন

রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, সাংবিধানিক ও আইনগত পরিবর্তন সংবিধানের মৌলিক কাঠামো অনুযায়ী করতে হবে। সেজন্য আইন বিভাগকে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর মাধ্যমে আইন বিভাগ বা সংসদের ক্ষমতাকে সীমিত করা হয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করা হয়েছিল।

এছাড়া হাইকোর্ট রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন,পঞ্চদশ সংশোধনী আপিল বিভাগের ত্রয়োদশ সংশোধনীর সংক্ষিপ্ত রায়ের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। একমাত্র গণভোটের মাধ্যমে সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং মৌলিক কাঠামোতে পরিবর্তন আনা যায়।

গণতন্ত্র হচ্ছে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। গণতন্ত্র বিকশিত হয় একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মূল সংবিধানে না থাকলেও একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচনের অভিপ্রায়ে ১৯৯৬ সালে তা সংবিধানে যুক্ত করা হয়েছিল। ফলে এই ব্যবস্থাটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোরই অংশে পরিণত হয়েছে। কারণ, এই ব্যবস্থা বিলুপ্তির পর বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪) জনগণের আস্থার কোনো প্রতিফলন ঘটেনি। এই তিনটি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক কাঠামো এবং নির্বাচনী ব্যবস্থার পাশাপাশি জনগণের আস্থাকে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।

যে কারণে সর্বশেষ সরকারকে জনগণের আন্দোলনের মুখে বিতাড়িত হতে হয়েছে। সরকারকে বিতাড়িত করতে গিয়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই না, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জনগণের আকাঙ্ক্ষা হচ্ছে একটি নতুন গণতন্ত্র, নতুন স্বাধীনতা নতুন বাংলাদেশ, যা একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে।

রায়ে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না উল্লেখ করে হাইকোর্ট বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার জাতীয় সংসদের। সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। সংবিধানে চার মূলনীতি, নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোটদান, জাতির জনক, সাতই মার্চসহ কিছু উল্লেখযোগ্য বিষয় সংসদের সিদ্ধান্তের জন্য ‘রেখে দিয়েছেন’ হাইকোর্ট।

তবে রায়ে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি-সংক্রান্ত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের এই ধারা দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। এছাড়া পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট।

আরও পড়ুন

রায়ে হাইকোর্ট বলেন, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তি-সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ ধারা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে বাতিল ঘোষণা করেছেন। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল হয়েছে।

হাইকোর্টের তার রায়ে সংবিধানের ৭ক, ৭খ ও ৪৪ (২) অনুচ্ছেদ বাতিল করেছেন। যেখানে ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ এবং ৭খ অনুচ্ছেদে মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা হয়েছে।

এর আগে পৃথক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা নিয়ে জারি করা রুলের রায় ঘোষণা করার জন্য ১৭ ডিসেম্বর দিন ঠিক করেন হাইকোর্টের একই বেঞ্চ।

গত ৪ ডিসেম্বর একই বেঞ্চে এ সংক্রান্ত শুনানি শেষ হয়। আদালতে এদিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল ও শাহরিয়ার কবির।

২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী বিল পাস হয় এবং রাষ্ট্রপতি ২০১১ সালের ৩ জুলাই তাতে অনুমোদন দেন। ওই সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

এছাড়া জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ করা হয়, সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল এবং রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়।

এই সংশোধনী বাতিলের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেছিলেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্টজন। গত ১৯ আগস্ট হাইকোর্ট রুল জারি করেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, জানতে চাওয়া হয় রুলে।

পরে এই রুল সমর্থন করে সহায়তাকারী (ইন্টারভেনার) হিসেবে যুক্ত হন জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও গণফোরাম প্রমুখ। এছাড়া মো. মোফাজ্জল হোসেন নামের এক মুক্তিযোদ্ধাও রিট করেন।

শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য তুলে ধরেন।

এফএইচ/এমএমএআর/এমএস