আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল
সংস্কার শেষ পর্যায়ে, গণহত্যায় অভিযুক্তদের বিচার হবে নান্দনিক ভবনে
জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলাকালে সংঘটিত গণহত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। বিচারকাজ চালাতে ট্রাইব্যুনালের অবকাঠামোগত বেশ কিছু মেরামত করা হচ্ছে, যা শেষ হওয়ার পথে।
ভবনের মেরামত কাজ শেষ হলে নতুন আঙ্গিকে আগের পুরোনো ভবনে শুরু হবে বিচারকাজ। এতে বিচারিক প্রক্রিয়ায় গতি আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। নতুন বিচারক, প্রসিকিউশন, তদন্ত সংস্থা ও আসামিরা পাচ্ছেন নান্দনিক ভবন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সূত্রে জানা গেছে, গণহত্যা মামলার আসামি সাবেক মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাসহ অন্যদের আগামী ১৭ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির করার কথা রয়েছে। মেরামত করা পুরোনো ভবনে ওই দিন তাদের হাজির হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সেদিন ভবনের নতুন এজলাসে বসে বিচারকাজ চলবে।
ট্রাইব্যুনালের (পুরোনো) মূল ভবনের সংস্কারকাজ চলমান থাকায় আপাতত ভবন সংলগ্ন (অস্থায়ী) ট্রাইব্যুনালে চলছে বিচারিক কার্যক্রম।
- আরও পড়ুন
শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সরাতে বিটিআরসিকে নির্দেশ - শেখ হাসিনার বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারে নিষেধাজ্ঞা
- ‘আমুর পরামর্শে কারফিউ, কামরুলের নির্দেশে গুলি-গণহত্যা চলে’
- দণ্ডপ্রাপ্ত গোলাম সাব্বিরের জামিন আবেদন শুনানি ১২ ডিসেম্বর
- র্যাবের সাবেক দুই কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখালেন ট্রাইব্যুনাল
- ট্রাইব্যুনালের মামলায় কারাবাস পূর্ণ করে মুক্তি পেলেন শামসুল হক
এদিকে, মেরামত শেষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ভবন যে নান্দনিক রূপে দেখা যাবে তার ছবি প্রকাশ করে ফেসবুক পোস্ট দিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
এখন ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক সাদা ভবনটির নানামুখী সংস্কার কাজে ব্যস্ত শতাধিক মিস্ত্রি ও কর্মী। এছাড়া ট্রাইব্যুনাল সংলগ্ন বাগান নতুনভাবে সাজানো হচ্ছে। গণপূর্ত অধিদপ্তর থেকে এ সংস্কার কাজের সার্বিক তদারকি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে কয়েক দফায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সংস্কারকাজ পরিদর্শন করেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান। এর আগে সংস্থারকাজ পরিদর্শন করেন গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলীসহ সরকারের দায়িত্বশীল পর্যায়ের অনেকেই।
সবশেষ মেরামত কাজ পরিদর্শন শেষে গৃহায়ন ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান সাংবাদিকদের বলেন, শিগগির সংস্কারকাজ শেষে বিচারের স্থান পরিবর্তন করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, ট্রাইব্যুনালের ঐতিহাসিক সেই সাদা ভবনটির নানামুখী সংস্কার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন মিস্ত্রি ও কর্মীরা। কেউ কেউ চুনকাম করছেন। কেউ করছেন ঘষামাজার কাজ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যস্ত সময় পার করছেন তারা।
- আরও পড়ুন
- শাপলা চত্বরে গণহত্যায় শেখ হাসিনাসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
- মানবতাবিরোধী অপরাধে বিদেশিদেরও বিচার করতে পারবে ট্রাইব্যুনাল
- বিচারের শুদ্ধতার জন্য ট্রাইব্যুনালে আপিলের বিধান রয়েছে
- চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ পরামর্শক হলেন টবি ক্যাডম্যান
- ট্রাইব্যুনালের আইনে নয়, প্রয়োজন হলে ঐকমত্যের ভিত্তিতে দল নিষিদ্ধ
- জিয়াউল আহসানকে ‘বসনিয়ার কসাই’ কারাদজিচের সঙ্গে তুলনা
চুন মিস্ত্রি আবুল হোসেন বলেন, ‘আমাদের কাজ প্রায় শেষ দিকে। প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা পরিশ্রম করে যাচ্ছি।’ আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই সংস্থারকাজ শেষ হবে বলে মনে করেন তিনি।
সংস্কারকাজ শেষ হতে আরও সপ্তাহখানেক লাগতে পারে বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কাজ চলমান, এখন আর খুব বেশি সময় লাগবে না। শ্রমিকরা নিয়মিতভাবে কাজ করছেন। সংস্কারকাজের সিংহভাগ সম্পন্ন হয়েছে। টুকিটাকি কিছু কাজ বাকি আছে। ভেতরের চেয়ার, টেবিল ও আসবাবপত্র বসানোসহ বাকি কাজগুলো দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে বলে আশা করছি। হয়তো সপ্তাহখানেকের মধ্যে সংস্কারকাজ সম্পূর্ণ হয়ে যাবে।’
তাজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক মানের বিচার কার্যক্রম চলবে এমনভাবে ট্রাইব্যুনাল ভবনকে উপযোগী করে প্রস্তুত করা হচ্ছে। ভবনটি সংস্কারের আগে অনেকটাই জরাজীর্ণ ছিল।’
একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংঘটিত হত্যা, গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, আইনজীবী প্যানেল ও তদন্ত সংস্থা গঠন করা হয়। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর ১৪ অক্টোবর ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করা হয়। চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্টের বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদার। ট্রাইব্যুনালের সদস্য হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্টের বিচারপতি শফিউল আলম মাহমুদ এবং অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
গত ৫ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ পান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। প্রসিকিউশন টিমের অন্য প্রসিকিউটররা হলেন মিজানুর রহমান, অ্যাডভোকেট গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম, বি এম সুলতান মাহমুদ, এস এম মঈনুল করিম, মো. নুরে এরশাদ সিদ্দিকী, আবদুল্লাহ আল নোমান, মো. সাইমুম রেজা তালুকদার, শাইখ মাহদী, তারেক আবদুল্লাহ এবং তানভীর হাসান জোহা (ডিজিটাল ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ)।
- আরও পড়ুন
- সংরক্ষণের জন্য বিচার প্রক্রিয়ার অডিও-ভিডিও ধারণ করা যাবে
- কাঁদলেন গুলশানের সাবেক ওসি, বললেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিলেন
- মামুন-জিয়াউলসহ আরও ৬ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার দেখানো হলো
- রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে শাস্তির সুপারিশ দিতে পারবে ট্রাইব্যুনাল
- যারা স্বৈরাচার হওয়ার কথা ভাবছেন আজকের দিনটি তাদের জন্য শিক্ষণীয়
- শেখ হাসিনা কোথায়, জানতে চাইলেন ট্রাইব্যুনাল
অন্যদিকে, ১০ জন কর্মকর্তার সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়। যেখানে তদন্ত সংস্থার কোঅর্ডিনেটর পদে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক মো. মাজহারুল হককে এবং কো–কোঅর্ডিনেটর পদে অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরীকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তদন্ত সংস্থার অন্য কর্মকর্তারা হলেন ঢাকার অ্যান্টি-টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর, পিবিআই সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহা. মনিরুল ইসলাম, ঢাকায় পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জানে আলম, ঢাকার ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুলের সহকারী পুলিশ সুপার সৈয়দ আবদুর রউফ, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. ইউনুছ, রাজশাহীর চারঘাট মডেল থানার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মাসুদ পারভেজ, পুলিশের রেঞ্জ রিজার্ভ ফোর্স (আরআরএফ) ঢাকার পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মুহাম্মদ আলমগীর সরকার ও সিআইডির ঢাকা মেট্রো উত্তরের পরিদর্শক (নিরস্ত্র) মো. মশিউর রহমান।
গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন অফিসে শতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। এছাড়া গুমের অভিযোগ জমা পড়েছে বেশ কয়েকটি। গত ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার দলের সাধারণ সম্পাদক ও মন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৪৬ জনের বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।
গত ২৭ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক ১০ মন্ত্রী, দুই উপদেষ্টা, অবসরপ্রাপ্ত এক বিচারপতি ও সাবেক এক সচিবকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো হয়। আগামী ১৭ ডিসেম্বর তাদের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয়। অন্য মামলায় গ্রেফতার হয়ে কারাগারে থাকা যাদের ট্রাইব্যুনালে হাজিরের নির্দেশ দেওয়া হয় তারা হলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান, শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী ফারুক খান, রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান ও তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও সাবেক স্বরাষ্ট্র সচিব জাহাংগীর আলম।
জুলাই-আগস্টের গণহত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সাবেক পুলিশ প্রধানসহ আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে এক মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে নির্দেশ দিয়েছেন ট্রাইব্যুনাল। একইসঙ্গে তাদের ট্রাইব্যুনালের মামলায় কারাগারে রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গত ২০ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন।
এই মামলার পরবর্তী শুনানির জন্য আগামী ১৯ ডিসেম্বর দিন ধার্য করা হয়। আট কর্মকর্তার মধ্যে রয়েছেন সাবেক সেনা কর্মকর্তা জিয়াউল আহসান, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, ঢাকা জেলার সাবেক পুলিশ অতিরিক্ত সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুরের সাবেক উপকমিশনার (ডিসি) মো. জসিম উদ্দিন মোল্লা, ঢাকার সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুর ইসলাম, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান, গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক এবং ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।
এর আগে গত জুলাই-আগস্টে গণ অভ্যুত্থানের সময় দেশে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে ট্রাইব্যুনালে উল্লেখ করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। এরপর তিনি ট্রাইব্যুনালের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তের জন্য দুই মাস সময় চান। ট্রাইব্যুনাল গত ১৯ নভেম্বর এক মাস সময় মঞ্জুর করে আগামী ১৭ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে গ্রেফতার–সংক্রান্ত অগ্রগতি প্রতিবেদনও সেদিন জানাতে নির্দেশ দেন ট্রাইব্যুনাল।
এফএইচ/এমএমএআর/জেআইএম