ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

‘কিতাবে বন্দি’ সোনা চোরাচালানে মৃত্যুদণ্ডের বিধান

জাহাঙ্গীর আলম | প্রকাশিত: ০৮:২৭ এএম, ২৭ জুন ২০২৪

দেশে সোনা চোরাচালান কমছেই না। দীর্ঘদিন ধরেই চোরাচালানের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলো। তার মধ্যে ঝিনাইদহ, যশোর ও চুয়াডাঙ্গার ভারতীয় সীমান্ত অন্যতম।

বছরজুড়ে আকাশপথে দেশে প্রবেশ করছে চোরাচালানের বিপুল পরিমাণ সোনা। জলপথেও সোনা চোরাচালানের অভিযোগ আছে। অবৈধ পথে আসা সোনা বিভিন্ন সময় যেমন জব্দ করা হচ্ছে, আবার এসব চোরাকারবারি চক্রের সঙ্গে জড়িত অনেককে গ্রেফতারও করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে বরাবরের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে রাঘববোয়ালরা। আইনে সোনা চোরাচালানে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও তা এখনো ‘কিতাবেই বন্দি’।

বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির (বাজুস) তথ্য বলছে, দেশের জল, স্থল ও আকাশপথ ব্যবহার করে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ২০০ কোটি টাকার স্বর্ণালংকার ও সোনার বার চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশে ঢুকছে।

অন্যদিকে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্যানুযায়ী, সীমান্ত এলাকায় চোরাই পথে আসা সোনার চালান উদ্ধারের ঘটনা বাড়ছে। তবে আইনজ্ঞরা বলছেন, চোরাচালান রোধে সবার আগে আইনের প্রয়োগ করতে হবে। দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। চোরাকারবারিদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে চোরাচালানও কমে আসবে।

সোনা চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন ছাড়াও ১৯৬৯ সালের দি কাস্টমস অ্যাক্টে মামলা করা হয়। দশগুণ জরিমানা ছাড়াও এ আইনে রয়েছে ছয় বছরের কারাদণ্ডের বিধান। ২০১২-এর ২ ধারায় চোরাচালানকে মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে অপরাধী বা অপরাধে সহায়তাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা ও মালিকদের ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে বর্তমানে সোনা চোরাচালানকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনেই অধিকাংশ মামলা করা হচ্ছে।

২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত সোনা চোরাচালানের ১৫২টি মামলা তদন্তাধীন। এর মধ্যে ২০২৪ সালে শুধু রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় মামলা করা হয়েছে ৬৩টি

২০১৩ সালের ২৪ জুলাই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সোনার চোরাচালান আটক করেছিলেন শুল্ক গোয়েন্দারা। সেদিন শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকা ১২৪ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়।

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের বিজি-৭০২ ফ্লাইটের লাগেজে ওই সোনা পাওয়া যায়। যার দাম ছিল প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। এ ঘটনায় বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা করা হয়। তদন্ত শেষে বিমানের ১০ কর্মীসহ ১৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গত ১১ বছরেও এ মামলার বিচার কার্যক্রম শেষ হয়নি।

এর ঠিক নয় মাস পর ২০১৪ সালের ২৬ এপ্রিল দুবাই থেকে আসা একটি বিমানের সাতটি টয়লেট থেকে ১০৬ কেজি সোনা উদ্ধার করেন শাহজালাল বিমানবন্দরের শুল্ক কর্মকর্তারা। উদ্ধার সোনার দাম ছিল ৪৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ওই ঘটনায় গোয়েন্দা ও তদন্ত শাখার সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা মফিজউল্লাহ রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০১৭ সালে বাংলাদেশ বিমানের ১০ কর্মকর্তাসহ ২৫ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। তবে গত ১০ বছরেও মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম শেষ হয়নি।

শুধু ১২৪ বা ১০৬ কেজি সোনাই নয়, সোনা চোরাচালানের আলোচিত এমন অন্তত ৬০টি মামলা ঢাকার আদালতে বিচার শুরুর অপেক্ষায়। ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত সোনা চোরাচালানের ১৫২টি মামলা তদন্তাধীন। এরমধ্যে ২০২৪ সালে শুধু রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় মামলা করা হয়েছে ৬৩টি।

সোনা চোরাচালানের মামলাগুলোর বিচার হয় ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর আদালত ও বিশেষ ট্রাইব্যুনাল আদালতে। আদালতের তথ্য অনুসারে, আড়াই বছরে (২০২১ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত) ৯৩টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দশ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এসব মামলায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও রাষ্ট্রপক্ষ যথাযথ সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপনে ব্যর্থ হওয়ায় আদালতে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি হয় না, আসামিরা সর্বোচ্চ ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামিদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগে মামলা করা হয়েছে তার সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও সার্বিক বিবেচনায় আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হয়নি।

আইন আছে, কার্যকারিতা নেই

তবে গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ধরনের নজরদারি ও সতর্কতা সত্ত্বেও দিন যত যাচ্ছে সোনা চোরাচালান তত বাড়ছে। একইসঙ্গে আড়ালে থেকে যাচ্ছে চোরাকারবারিরা। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়ায় সোনা চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। আইনে সোনা চোরাচালানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান থাকলেও কোনো সোনা চোরাকারবারির বিরুদ্ধে এ ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার নজির স্থাপন করা হচ্ছে না। এতে চোরাকারবারিরা অবৈধ পথে সোনা আনতে উৎসাহিত হচ্ছেন।

আরও পড়ুন

হীরা বা সোনা পাচারকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ অন্য আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে অভিযোগ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

তবে মামলাগুলো দ্রুত শেষ না হওয়ায় এবং প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত না হওয়ায় দিন দিন এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা। তাদের মতে, অপরাধীদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হলে সোনা চোরাচালান অনেকটাই কমে আসবে।

আইনজ্ঞরা বলছেন, আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে সোনা চোরাচালানের আসামিরা বের হয়ে যাচ্ছেন। আইনের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনলে দেশ থেকে সোনা চোরাচালান কমে আসবে।

পরিসংখ্যান যা বলছে

বাজুসের দাবি, প্রতিদিন জল, স্থল ও আকাশ পথে অন্তত আড়াইশ কোটি টাকার সোনার অলংকার চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে আসছে। এর মধ্যে সোনার অলংকার ছাড়াও সোনার বার, ব্যবহৃত পুরোনো জুয়েলারি ও হীরার অলংকার, যা বছর শেষে দাঁড়ায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বেশি।

বিজিবির তথ্য মতে, ২০২৩ সালে সীমান্তে প্রায় ১০২ কোটি টাকার সোনা জব্দ করা হয়। ২০১৪ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিজিবি দেশের সীমান্ত অঞ্চল থেকে প্রায় ৯২৬ কেজি সোনা জব্দ করে। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত বিজিবি সীমান্ত এলাকা থেকে জব্দ করেছে প্রায় ২৮ কেজি সোনা।

গত ১০ বছরে শুল্ক গোয়েন্দা, কাস্টম হাউজ, বিজিবি, পুলিশ ও বিমানবন্দরের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন সারাদেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করে। এর মধ্যে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন গত কয়েক বছরে ১৩১ কেজি সোনার বার জব্দ করে।

প্রতিদিন দেশের জল, স্থল ও আকাশপথে অন্তত আড়াইশ কোটি টাকার সোনার অলংকার চোরাচালানের মাধ্যমে দেশে আসছে। এর মধ্যে সোনার অলংকার ছাড়াও আসছে সোনার বার, ব্যবহৃত পুরোনো জুয়েলারি ও হীরার অলংকার, যা বছর শেষে দাঁড়ায় ৯১ হাজার ২৫০ কোটি টাকার বেশি।- বাজুস

দেশের অর্থপাচার প্রতিরোধে কাজ করা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) তথ্য মতে, এসব সোনা বৈধপথে আনা হলে সরকারের ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব আদায় হতো।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, গত ১০ বছরে (২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত) অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা সারাদেশে অভিযান চালিয়ে ২ হাজার ৫৮৩ কেজি সোনা জব্দ করেন। জব্দ সোনার বাজারমূল্য প্রায় ১ হাজার ৩৪২ কোটি টাকা। এসব ঘটনায় হওয়া মামলায় ২৮৮ জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

ঢাকার আদালত সূত্রে জানা যায়, ঢাকা মহানগরে ২০১৯ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সোনা জব্দের ঘটনায় হওয়া ১৮৭টি মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন। এর মধ্যে ২০১৯ সালে ৭৪টি, ২০২০ সালে ৩৯টি এবং ২০২১ সালে ৭৪টি মামলা হয়। ২০২১ থেকে ২০২৪ সালের মে পর্যন্ত ১৫২টি সোনা চোরাচালানের মামলা তদন্তাধীন।

এর মধ্যে ২০২৪ সালে শুধু রাজধানীর বিমানবন্দর থানায় মামলা করা হয়েছে ৬৩টি। এছাড়া ২০১৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আসামি খুঁজে না পাওয়ায় ২০টি সোনা চোরাচালান মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে পুলিশ।

যা বলা হয়েছে বিশেষ ক্ষমতা আইনে

সোনা চোরাচালানীদের বিষয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ এর (খ) এর (১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আপাতত বলবৎ কোনো আইন দ্বারা বা আইনের অধীনে আরোপিত বিধিনিষেধ বা নিষেধাজ্ঞা ভঙ্গ করে বা আপাতত বলবৎ কোনো আইনের অধীন আদায়যোগ্য শুল্ক বা কর ফাঁকি দিয়ে (ক) পাট, স্বর্ণ বা রৌপ্যের বাঁট, স্বর্ণ বা রৌপ্য নির্মিত দ্রব্য, মুদ্রা, খাদ্যদ্রব্য, ওষুধ, আমদানি করা পণ্যদ্রব্য, অথবা অন্য কোনো পণ্যদ্রব্য বাংলাদেশের বাইরে নেয় বা (খ) বাংলাদেশের ভেতরে কোনো পণ্যদ্রব্য আনয়ন করেন তবে তিনি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অনধিক চৌদ্দ বৎসর ও অন্যূন দুই বৎসর সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন।

এ আইনের ২৫ এর (খ) এর ২ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি আপাতত বলবৎ কোনো আইন দ্বারা বা আইনের অধীন বাংলাদেশে আনয়ন করা নিষিদ্ধ এরূপ পণ্যদ্রব্য বিক্রয় করেন বা বিক্রয়ের জন্য প্রস্তাব বা প্রদর্শন করেন বা বিক্রয়ের জন্য তা দখলে বা নিয়ন্ত্রণে রাখেন তাহলে তিনি অনধিক সাত বৎসর, কিন্তু এক বৎসরের কম নয়- এমন কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

মানি লন্ডারিং প্রমাণ হলে যে সাজা হবে

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২ ধারায় চোরাচালানকে মানি লন্ডারিংয়ের সম্পৃক্ত অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে অপরাধী বা অপরাধে সহায়তাকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা ও মালিকদের ১২ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

এছাড়া মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ এর ২৩ ও ২৫ ধারায় ওই অপরাধ প্রতিরোধে বিএফআইইউ সার্কুলারের নির্দেশনাগুলো লঙ্ঘন করলে ব্যাংক ও জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বা জড়িত কর্মকর্তা বা পরিচালককে বিএফআইইউ আর্থিক জরিমানা, লাইসেন্স বাতিলসহ বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে।

আরও পড়ুন

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, সোনা পাচার হয় হুন্ডির মাধ্যমে। আগে প্রবাসীরা রেমিট্যান্স পাঠাতো আর এখন সোনা পাঠায়। আমাদের রিজার্ভ সংকটের একটা বড় কারণ সোনা পাচার। এর পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা এপিবিএন ও কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ জড়িত।

কারণ, ব্যাগেজ রুলস অনুযায়ী একজন যাত্রী ২৩৪ গ্রাম সোনা বৈধ পন্থায় নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু ওই যাত্রী বৈধ পন্থার আড়ালে এপিবিএন ও কাস্টমসের কিছু অসৎ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে অতিরিক্ত সোনা দেশে নিয়ে আসেন। এসব সোনার টাকা হুন্ডির মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়।

তিনি আরও বলেন, দেশের স্থলবন্দরগুলো দিয়েও প্রচুর পরিমাণ সোনা পাচার হয়। সরকারের উচিত জড়িত কর্মকর্তাদের ওপর নিয়ন্ত্রণ বাড়ানো এবং তাদের আইনের আওতায় আনা। তবেই সোনা পাচার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। একই সঙ্গে গ্রামগঞ্জে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যারা সোনা পাচার ও হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তাদের রেড মার্ক করে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা উচিত।

বাজুসের লিগ্যাল অ্যাডভাইজর তুহিন হাওলাদার জাগো নিউজকে বলেন, সোনা ও হীরা চোরাচালানে জড়িতদের ধরতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর জোরালো অভিযান পরিচালনা করতে হবে। অভিযান পরিচালনা করে মূল অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে। অপরাধীরা কোনোভাবেই যেন আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বের হয়ে যেতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে।

সোনা পাচার হয় হুন্ডির মাধ্যমে। আগে প্রবাসীরা রিমিট্যান্স পাঠাতো আর এখন সোনা পাঠায়। আমাদের রিজার্ভ সংকটের একটা বড় কারণ সোনা পাচার। এর পেছনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা এপিবিএন ও কাস্টমস কর্মকর্তাদেরও কেউ কেউ জড়িত।- আইনজীবী আল মামুন রাসেল

‘সোনা ও হীরা চোরাচালান প্রতিরোধে বাজুসকে সম্পৃক্ত করে পৃথকভাবে সরকারি মনিটরিং সেল গঠন করতে হবে। ব্যাগেজ রুল সংশোধনের মাধ্যমে সোনার বার আনা বন্ধ করতে হবে। ট্যাক্স ফ্রি সোনার অলংকারের ক্ষেত্রে ১০০ গ্রামের পরিবর্তে তা কমিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ গ্রাম করতে হবে। একই ধরনের অলংকার দুটির বেশি আনা যাবে না এমন আইন করতে হবে। একই সঙ্গে একজন যাত্রী বছরে শুধু একবার ব্যাগেজ রুলসের সুবিধা নিতে পারবে, এমন বিধানও চালু করতে হবে। তবেই সোনা চোরাচালান অনেকটা কমে আসবে। দেশেরও রাজস্ব আহরণ বাড়বে।’ যোগ করেন তিনি।

ঢাকার আদালতে সোনা চোরাচালানের একাধিক মামলার আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সোনা চোরাচালানকারীদের গ্রেফতারের পর বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দেওয়া হয়। মামলার অনেক সাক্ষী ঠিকভাবে আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসেন না।

এ কারণে বিচারকাজ দিনের পর দিন ঝুলে থাকে। এক পর্যায়ে বিচারক মামলার বিচার কার্যক্রম সমাপ্ত করে রায় ঘোষণা করেন। সাক্ষ্যের অভাবে বিচারক অনেক সময় দোষীদের সাজা দিতেও পারেন না। আবার অনেক ক্ষেত্রে সাক্ষীরা জেরার সময় সঠিকভাবে উত্তর দিতে পারেন না। এছাড়া তদন্তে মূল পরিকল্পনাকারীরা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।

তিনি আরও বলেন, সোনা চোরাচালানের মামলাগুলোতে মূল অপরাধীদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে। সাক্ষীদের সময়মতো আদালতে সাক্ষ্য দিতে আসতে হবে। সোনা চোরাচালানের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে বিশেষ ক্ষমতা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। আইনের অধীনে প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনলে চোরাচালান অনেকটাই কমে আসবে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, আসামিদের শাস্তি দেওয়ার এখতিয়ার আদালতের। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের জন্য চেষ্টা করি। আদালত সাক্ষীদের সাক্ষ্য, মামলার আলামত, আসামিদের বয়সসহ সার্বিক বিষয়ে বিবেচনা করে রায় ঘোষণা করেন।

বিচারকের রায়ের বিরুদ্ধে তো সমালোচনা করা যায় না। সোনা চোরাচালান মামলা যদি প্রমাণিত হয় তাহলে তো সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়া উচিত। এটা তো আদালতের এখতিয়ার কাকে ১০ বছর, কাকে ২০ বছর, কাকে যাবজ্জীবন বা মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেবেন। আদালত অনেক সময় বয়সের বিবেচনায় সাজা কম দেন। মামলায় হয় সাজা হবে না হয় খালাস হবে। এ দুইয়ের মাঝখানে কোনো পথ নেই। সাজা দেওয়াটা আদালতের এখতিয়ার। বিচারক অনেক সময় রায়ের পর্যবেক্ষণে লেখেন অনুকম্পা দেখিয়ে মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন।

তিনি আরও বলেন, সোনা চোরাচালানের মামলাগুলো বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। এসব আদালতে দায়িত্বে থাকেন আমাদের অতিরিক্ত পিপিরা। যখন গুরুত্বপূর্ণ মামলা থাকবে তখন তো তারা আমাকে জানাবেন। অনেক সময় তারা আমাকে জানান না। আমাকে জানালে আমি চিন্তা করতাম মামলায় আপিল করা যাবে কি না। আপিলের গ্রাউন্ড না থাকলে আপিল করার প্রয়োজন নেই।

আবার অনেক সময় রায়ের তথ্য অতিরিক্ত পিপিরা আমাকে জানান না। তাদের উচিত সোনার যে মামলায় রায় হলো বা যেসব গুরুত্বপূর্ণ মামলার সাক্ষী চলছে তা আমাকে জানানো। আমাদের যারা আইন কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের আরও সচেতন হতে হবে।বিষয়গুলো আমি দেখবো। দেশ থেকে সোনা চোরাচালান রোধ করতে হবে। এটা আমাদের দেশের জন্য ক্ষতিকর। এ বিষয়টা আমাদের সিরিয়াসলি দেখতে হবে। আদালত যদি মনে করেন রাষ্ট্রপক্ষের দুর্বলতা আছে তাহলে আমাদের নির্দেশনা দেবেন। পর্যবেক্ষণে তা লিখে দেবেন রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতা ছিল। তাহলে আমরা বুঝতে পারবো আমাদের দুর্বলতা কী আছে।

জেএ/এমকেআর/এসএইচএস/এএসএম