ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

নিষিদ্ধ স্প্রের বিষক্রিয়ায় অকালে ঝরে দুই শিশুর প্রাণ

জাহাঙ্গীর আলম | প্রকাশিত: ০৯:৪৬ পিএম, ১৬ মার্চ ২০২৪

 পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিসের চেয়ারম্যানসহ চারজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট
 পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবহারে চেয়ারম্যান ও এমডির মারাত্মক অবহেলা
 মিথ্যা আশ্বাসে দেরিতে চিকিৎসা, অতঃপর দুই শিশুর মৃত্যু: কৃষি সম্প্রসারণ
 ঘরে ঢোকার পর শারমিন ও তার দুই সন্তান বমি করেন

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় পরিবার নিয়ে থাকতেন ব্যবসায়ী মো. মোবারক হোসেন তুষার। গত বছরের ২ জুন তার বাসায় তেলাপোকা নিধনের কীটনাশক স্প্রে করে ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড নামের একটি পেস্ট কন্ট্রোল সার্ভিস কোম্পানি। পরে বিষক্রিয়ায় তার স্কুলপড়ুয়া দুই শিশুসন্তান মারা যায়। এ ঘটনায় মোবারক হোসেনের করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান (৩৭) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ফরহাদুল আমিন (৩৩)সহ চারজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দিয়েছে ডিবি পুলিশ।

চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, বাদীর বাসায় কীটনাশক স্প্রেতে অ্যালুমিনিয়াম ফসফেটসহ যে ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তা বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেই নিষিদ্ধ স্প্রে ব্যবহারের ফলে দুই শিশু বিষাক্ত পয়জনে মাল্টি অর্গান ফেল করে মারা যায়।

সম্প্রতি ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সমীর চন্দ্র সূত্রধর ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ চার্জশিট দাখিল করেন। চার্জশিটভুক্ত অন্য দুই আসামি হলেন- প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ মোসলেহ উদ্দিন শামীম (৩০) ও স্প্রে ম্যান মো. টিটু মোল্লা (৩৭)। তাদের মধ্যে প্রধান আসামি মোসলেহ উদ্দিন পলাতক থাকায় আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

আরও পড়ুন

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও ডিবি পুলিশের পরিদর্শক সমীর চন্দ্র সূত্রধর জাগো নিউজকে বলেন, মামলা দায়েরের পর আমি কৃষি মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট সংগ্রহ করি। তদন্তে দেখা গেছে, নিষিদ্ধ ওষুধের বিষক্রিয়ায় দুই শিশু মারা যায়। সাক্ষ্য-প্রমাণে দণ্ডবিধির ৩০৪-ক ধারায় অপরাধ প্রাথমিকভাবে সত্য বলে প্রতীয়মান হওয়ায় চার আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালেতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

গ্রেফতার আশরাফুজ্জামান ও ফরহাদুল
গ্রেফতার আশরাফুজ্জামান ও ফরহাদুল

মামলার বাদী মোবারক হোসেন তুষার জাগো নিউজকে বলেন, আমার দুই সন্তানকে আর কোনো দিন ফিরে পাবো না। আমি আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যেন অন্য কাউকে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়।

পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবহারে চেয়ারম্যান ও এমডির মারাত্মক অবহেলা
মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, প্রতিষ্ঠানটি (ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেড) কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে পেস্ট কন্ট্রোল করার অনুমোদন পায়। লাইসেন্স অনুযায়ী বড় পোশাক কারখানা (গার্মেন্টস), বীজগুদাম বা অনাবাসিক এলাকায় পেস্ট কন্ট্রোল করা যাবে। কিন্তু আসামিরা বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, লাইসেন্সে বাসাবাড়িতে পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবহারের কোনো অনুমোদন ছিল না। এছাড়া পেস্ট কন্ট্রোল করার বিষয়ে লাইসেন্সে কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং এমডির তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনার কথা উল্লেখ থাকলেও তারা দায়িত্বে অবহেলা করেছেন।

বাদীর বাসায় কীটনাশক স্প্রেতে অ্যালুমিনিয়াম ফসফেটসহ যে ধরনের উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে তা বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। সেই স্প্রে ব্যবহারের ফলে দুই শিশু বিষাক্ত পয়জনে মাল্টি অর্গান ফেল করে মারা যায়।

চার্জশিটে আরও বলা হয়, ডিসিএস অর্গানাইজেশনের চেয়ারম্যান আশরাফুজ্জামান ও এমডি ফরহাদুল আমিনের সঙ্গে কথা বলে কর্মচারীরা বাদীর বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল করেছেন। তবে চেয়ারম্যান ও এমডি কর্মচারীদের সঠিক দিকনির্দেশনা না দেওয়া এবং তাদের মারাত্মক অবহেলায় বাদীর বাসায় অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট ব্যবহার করা হয়। এতে বিষক্রিয়ায় বাদীর দুই সন্তানের মৃত্যু হয়েছে।

মিথ্যা আশ্বাসে দেরিতে চিকিৎসা, অতঃপর দুই শিশুর মৃত্যু
মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেছেন, অধিদপ্তর থেকে পাওয়া লাইসেন্সে যেসব স্থানে পেস্ট কন্ট্রোল করার নির্দেশনা আছে সেসব স্থান ছাড়া বাসাবাড়িতে তা ব্যবহার করে লাইসেন্সের শর্ত ভঙ্গ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। বাসাবাড়িতে পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবহার করা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। তথাপি অ্যালুমিনিয়াম ফসফেট ব্যবহার করায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

আরও পড়ুন

আসামি মোসলেহ উদ্দিন তার কোম্পানির চেয়ারম্যান ও এমডির সঙ্গে কথা বলে মামলার বাদীকে জানান, পেস্ট কন্ট্রোল করার কারণে কোনো ধরনের সমস্যা হবে না এবং চিকিৎসারও তেমন প্রয়োজন নেই। এমন মিথ্যা আশ্বাসের কারণে বাদী তার ছেলে-মেয়েকে সঠিক সময়ে চিকিৎসা দিতে পারেননি। চিকিৎসায় দেরি হওয়ায় মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

লাইসেন্স অনুযায়ী বড় পোশাক কারখানা (গার্মেন্টস), বীজগুদাম বা অনাবাসিক এলাকায় পেস্ট কন্ট্রোল করা যাবে। কিন্তু আসামিরা বাসায় পেস্ট কন্ট্রোল করেছেন। প্রকৃতপক্ষে, লাইসেন্সে বাসাবাড়িতে পেস্ট কন্ট্রোল ব্যবহারের কোনো অনুমোদন ছিল না

উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইংস, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কর্তৃক মতামতে উল্লেখ করেছে, পেস্ট কন্ট্রোল করা স্থানে ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টা পর্যন্ত বাতাস চলাচলের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। অথচ আসামি মোসলেহ উদ্দিন বাদীকে সঠিক তথ্য না দিয়ে পেস্ট কন্ট্রোল করার মাত্র ৩-৪ ঘণ্টা পরই বাসায় অবস্থান করা যাবে বলে মৌখিকভাবে জানান। তিনি বাদীকে মিথ্যা তথ্য দেওয়ায় দুই শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে ব্রিফ করেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ
ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরে ব্রিফ করেন ডিবিপ্রধান হারুন অর রশীদ

ঘরে ঢোকার পর শারমিন ও তার দুই সন্তান বমি করেন
মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, গত ২ জুন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার মোবারক হোসেন তুষারের বাসায় তেলাপোকা নিধনের কীটনাশক দেন ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেডের কর্মীরা। তারা জানান ৩-৪ ঘণ্টা পর বাসায় প্রবেশ করা যাবে। কীটনাশক দেওয়ার ৯ ঘণ্টা পর মোবারক তার স্ত্রী শারমিন জাহান ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাসায় যান। বাসায় গিয়ে যথারীতি তারা ঘুমিয়ে পড়েন। নিজের কেনা নতুন ফ্ল্যাটে ঘটনার সপ্তাহ দুই আগেই পরিবার নিয়ে উঠেছিলেন মোবারক হোসেন।

তেলাপোকা নিধনের কীটনাশক দেন ডিসিএস অর্গানাইজেশন লিমিটেডের কর্মীরা। তারা জানান ৩-৪ ঘণ্টা পর বাসায় প্রবেশ করা যাবে। কীটনাশক দেওয়ার ৯ ঘণ্টা পর মোবারক তার স্ত্রী শারমিন জাহান ও তিন ছেলেমেয়েকে নিয়ে বাসায় যান। বাসায় গিয়ে যথারীতি তারা ঘুমিয়ে পড়েন

৩ জুন সকাল ৭টায় শারমিন ও তার দুই সন্তান বমি করে। তখন আসামি মোসলেহ উদ্দিনকে ফোন করা হলে তিনি জানান, কীটনাশকে এলার্জি ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা হবে না। পরে চিকিৎসকের পরামর্শে ওষুধ খাওয়ালে দুই সন্তান সাময়িক সুস্থবোধ করে। ওইদিন রাতে তারা সবাই ঘুমিয়ে পড়েন।

পরদিন ৪ জুন ভোর ৪টার দিকে ছোট ছেলে শাহির মোবারত জায়ান (৯) অসুস্থবোধ করে। তখন রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে বড় ছেলে শায়ান মোবারত জাহিন (১৫) অসুস্থবোধ করলে তাকেও ওই হাসপাতাল নেওয়া হয়। পরে তাকে আইসিইউ নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ওইদিনই রাত ১০টার দিকে তারও মৃত্যু হয়। তবে বিষক্রিয়া মারাত্মক না হওয়ায় মোবারক-শারমিন দম্পতি ও তাদের একমাত্র মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি।

এ ঘটনায় ৫ জুন ‘দায়িত্বে অবহেলাজনিত’ মৃত্যুর অভিযোগে ব্যবসায়ী মোবারক হোসেন তুষার বাদী হয়ে রাজধানীর ভাটারা থানায় মামলা করেন।

জেএ/এমকেআর/জেআইএম