রায় পর্যবেক্ষণে আদালত
বিদেশে যারা সেকেন্ড হোম গড়েছে, তারা দেশকে ভালোবাসে না
অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকের (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে) ২২ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। অপর ১৩ আসামির সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়।
রায়ের পর্যাবেক্ষণে বিচারক বলেন, বিদেশে যারা অবৈধভাবে সেকেন্ড হোম গড়েছে, তারা আসলে দেশকে ভালোবাসে না। প্রকৃতপক্ষে আমাদের দেশকে ভালোবাসতে হবে এবং মুক্তির চেতনা নিয়ে অর্থপাচারকারীদের প্রতিহত করতে হবে। অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদারের মতো অর্থপাচারকারীদের কোনো আদর্শ নেই। তারা আদর্শ লালন করে না। তবে তারা অবৈধভাবে সম্পদের পাহাড় গড়ে তাদের অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে। প্রকৃতপক্ষে তারা দেশ ও জাতির শত্রু। জাতীয় স্বার্থ ও দেশের চলমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে তাদের সমবেতভাবে প্রতিহত করতে হবে।
‘ফলস্বরূপ, অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদার রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে কোনো প্রকার ছাড় পাওয়ার যোগ্য নন। এটি অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট এখনও মুলতুবি রয়েছে যদিও এটি অনেক আগেই কানাডায় পাঠানো হয়েছিল। উন্নত দেশগুলোর সহযোগিতা ছাড়া কোনো রাষ্ট্র একা অর্থ পাচার প্রতিরোধ করতে পারে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কার্যকর সহযোগিতা এবং আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে আমাদের দেশে অর্থ পাচারের অপরাধ প্রতিহত করা যেতে পারে।’
রোববার (৮ অক্টোবর) ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে পি কে হালদারের দুদক আইনের ২৭ (১) ধারা ১০ বছরের কারাদণ্ড ও মানিলন্ডারিং আইনে ১২ বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুই ধারার সাজা আলাদাভাবে চলবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তাকে ২২ বছরের কারাভোগ করতে হবে। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ৫২ মামলার মধ্যে এটি প্রথম মামলার রায়। বাকি ৫১ মামলা এখনো তদন্তাধীন।
আরও পড়ুন: ৩৮ কোটিতে বিক্রি হয়ে গেলো পি কে হালদারের কুমিরের খামার
অন্যদিকে আসামি অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারী, সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধাক, লিলাবতী হালদার (পি কে হালদারের মা), পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রিতিশ কুমার হালদার, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় ও স্বপন কুমার মিস্ত্রিকে পৃথক দুই ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুদক আইনের ২৭ (১) ধারা তিন বছরের কারাদণ্ড ও মানিলন্ডারিং আইনে চার বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। দুই ধারার সাজা একসাথে চলবে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন। অর্থাৎ তাদের চার বছর কারাভোগ করতে হবে।
রায়ের পর্যাবেক্ষণে বিচারক বলেন, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর থানার দিঘিরজান গ্রামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার। তার মা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষিকা ছিলেন। বুয়েট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার পরিবর্তে সম্পদ গড়ার নেশায় মত্ত হন। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার তার মা, আপন ভাইসহ ঘনিষ্ঠজনের সহযোগিতায় অসংখ্য নামি-বেনামি প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে পাহাড়সম অবৈধ সম্পদ অর্জন করে।
পর্যাবেক্ষণে বিচারক আরও বলেন, একজন মেধাবী নাগরিক তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে জাতি গঠনের যেরূপ ভূমিকা রাখতে পারে, ঠিক অন্যদিকে অপরাধ চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে তখন সে জাতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার তার উজ্জল দৃষ্টান্ত। মানুষ ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের কাছে দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থ অনেক বড় ছিল। আমরা যেন নিজের সামান্য ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মানিলন্ডারদের সহযোগী না হই।
এর আগে গত ৪ অক্টোবর রাষ্ট্র ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম রায় ঘোষণার জন্য ৮ অক্টোবর দিন ধার্য করেন। ওইদিন যুক্তি উপস্থাপনের সময় কারাগারে থাকা চার আসামি অবন্তিকা বড়াল, শংখ বেপারী, সুকুমার মৃধা ও অনিন্দিতা মৃধাকে আদালতে হাজির করা হয়। পি কে হালদারসহ ১০ আসামি পলাতক। তারা হলেন- লিলাবতী হালদার (পি কে হালদারের মা), পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, প্রিতিশ কুমার হালদার, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায় ও স্বপন কুমার মিস্ত্রি। এ মামলায় ১০৬ সাক্ষীর মধ্যে ৯৯ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
আরও পড়ুন: প্রথম মামলায় পি কে হালদারের ২২ বছরের কারাদণ্ড
২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী। মামলার এজাহারে বলা হয়, পি কে হালদার বিভিন্ন অবৈধ ব্যবসা ও অবৈধ কার্যক্রমের মাধ্যমে জ্ঞাত আয়ের উৎসের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ ২৭৪ কোটি ৯১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৫৫ টাকার অবৈধ সম্পদ নিজ দখলে রেখেছেন। এছাড়া ওই অর্থ আড়াল করতে বিদেশে পাচার করে মানি লন্ডারিং আইনেও অপরাধ করেন তিনি।
মামলাটি তদন্ত শেষে ১৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন দুদকের উপ-পরিচালক সালাহউদ্দিন। ২০২২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন আদালত।
চার্জশিটে বলা হয়েছে, গত ১০ বছরে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নামে-বেনামে ৯৩৩ কোটি টাকার জমি, ফ্ল্যাট ও হোটেল ক্রয় করেন পি কে হালদার। এর মধ্যে জমি কিনেছেন ৬ হাজার ৭৯০ শতাংশ। এই সম্পদের বাজারমূল্য প্রায় ৩৯১ কোটি ৭৫ লাখ ৮১ হাজার ১২ টাকা। নিজের নামে তিনি জমি কিনেছেন ৪ হাজার ১৭৪ শতাংশ। দলিলে এসব জমির দাম ৬৭ কোটি ৯৪ লাখ ২০ হাজার ৯৩০ টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত বাজারমূল্য প্রায় ২২৮ কোটি টাকা। এছাড়া ধানমন্ডিতে তার নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
চার্জশিটে আরও বলা হয়, পি কে হালদার তার নিকটাত্মীয় পূর্ণিমা রানী হালদারের নামে উত্তরায় একটি ভবন নির্মাণ করেন, যার দাম প্রায় ১২ কোটি টাকা। পূর্ণিমার ভাই উত্তম কুমার মিস্ত্রির নামে তেজগাঁও, তেজতুরী বাজার ও গ্রিন রোডে ১০৯ শতাংশ জমি কেনেন, যার বাজারমূল্য ২০০ কোটি টাকা। পি কে হালদার কাগুজে কোম্পানি ক্লিউইস্টোন ফুডসের নামে কক্সবাজারে দুই একর জমির ওপর র্যাডিসন নামে আটতলা হোটেল নির্মাণ করেন, যার বাজারমূল্য প্রায় ২৪০ কোটি টাকা তার খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী ও অনঙ্গ মোহন রায়ের নামে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে ৪০৪ শতাংশ জমি কেনেন, যার দাম প্রায় ১৬৭ কোটি টাকা।
কলকাতার অনতিদূরে অশোকনগরসহ পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় অভিযান চালিয়ে ২০২২ সালের ১৪ মে পি কে হালদারকে গ্রেফতার করে ভারতের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি। একই সঙ্গে তার ভাই প্রাণেশ হালদার, স্বপন মিস্ত্রি ওরফে স্বপন মৈত্র, উত্তম মিস্ত্রি ওরফে উত্তম মৈত্র, ইমাম হোসেন ওরফে ইমন হালদার এবং আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদারসহ বাকি অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা হয়।
গত ১১ জুলাই অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কলকাতার আদালতে চার্জশিট জমা দেয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। অর্থপাচার আইন-২০০২ এবং দুর্নীতি দমন আইন- ১৯৮৮’র বিভিন্ন ধারায় অভিযুক্তদেরর নামে চার্জ গঠন করা হয়।
বর্তমানে পি কে হালদারসহ পাঁচ পুরুষ আসামি রয়েছেন প্রেসিডেন্সি কারাগারে। আর একমাত্র নারী আসামি আমানা সুলতানা ওরফে শর্মী হালদার রয়েছেন আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে।
জেএ/এমআরএম/জেআইএম