পাঁচ বছরের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও হত্যা করা হয়েছে
প্রধান বিচারপতিকে নিয়ে খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম বলেছেন, জামায়াত যে অভিযোগ করেছে, বিএনপি যে অভিযোগ করেছে, তাদের আন্তর্জাতিক লবিস্ট গ্রুপ যে সুরে কথা বলছে, একই সুরে কথা বলেছেন প্রধান বিচারপতি। প্রকারান্তরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করলেন তিনি। শুধু তাই নয়, এই বক্তব্য ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বছরের বিচারকে প্রশ্নবিদ্ধ ও হত্যা করা হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে ৪৫ বছরে অনেক বিচারপতি এসেছেন আর গেছেন, কিন্তু কেউ তার মতো এত অতিবক্তব্য দেননি দাবি করেছেন খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে বিলিয়া মিলনায়তনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ‘একাত্তরের গণহত্যাকারীদের বিচারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: সরকার, বিচারবিভাগ ও নাগরিক সমাজের করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি এ দাবি জানান।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত মীর কাসেম আলীর আপিলের পুনঃশুনানি দাবি করেন কামরুল ইসলাম। এই আপিলের শুনানিতে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের কাজ নিয়ে প্রধান বিচারপতির অসন্তোষ প্রকাশের মধ্যদিয়ে রায়ের ইঙ্গিত মিলছে বলে দাবি করেন সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল।
খাদ্যমন্ত্রী বলেন, এই মামলার রায় কী হবে, তা প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্যে আদালতে বক্তব্যের মধ্যদিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি। তার বক্তব্যের মধ্যে এটা অনুধাবন করেছি, এই মামলায় আর মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, এই প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা ২২টি মামলা নিষ্পত্তি করেছে। এর মধ্যে চার জনের দণ্ড কার্যকর হয়েছে। এই প্রসিকিউশন টিমই সাকা চৌধুরীর মামলায় কাজ করেছে। তখনতো কোনো সমস্যা হয় নাই। এখন কেন প্রশ্ন উঠলো? আমি জানিনা আমার কথাগুলো আদালত অবমাননার মধ্যে পড়ে কি-না। তবে সত্য কথা বলতে আমি ভয় পাই না। সত্য নির্ভয়ে বলতে হয়।
তিনি আরো বলেন, আমি মীর কাশেমের ট্রাইব্যুনালের পুরো রায় পড়েছি। আমি যতটুকু দেখেছি আমার কাছে মনে হয়েছে মামলাটি সঠিকভাবেই হয়েছে। প্রধান বিচারপতি যখন প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন আমি তখনই পুরো রায়টি পড়লাম। আমি কোথাও ত্রুটি খুঁজে পাইনি। আর ওই ট্রাইব্যুনালেতো তিনজন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারকই বিচার করেন। তারাওতো কোনো ত্রুটি পাননি।
কামরুল বলেন, বাংলাদেশে ৪৫ বছরে অনেক বিচারপতি এসেছে আর গেছে, কিন্তু কেউ তার মতো এত অতিবক্তব্য দেয়নি। তার অতিকথনে সুধীসমাজের মানুষেরা জিহ্বায় কামড় দিচ্ছেন। তাই তাকে অতিকথন থেকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। আর তা না হলে সরকারকে নতুন করে বিকল্প চিন্তা ভাবনা করা উচিত বলে আমি মনে করছি।
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম প্রধান বিচারপতির সঙ্গে একই সুরে কথা বলা শুরু করেছেন- এ মন্তব্য করে খাদ্যমন্ত্রী বলেন, তার দায়িত্ব হচ্ছে রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনা করা। কিন্তু তিনিও প্রধান বিচারপতির সুরে কথা বলছেন। কোথায় যাবো?
অ্যাটর্নির বিষয়ে কামরুল বলেন, তিনি বেশি বুঝেন। তিনি বলেছেন, এই বক্তব্য দেয়া হয়েছে বলেই রায় অন্যরকম হবে এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। তবে আমি বলবো, প্রধান বিচারপতি প্রকাশ্য আদালতে যা বলেছেন, এর পর হয় তিনি আসামিকে খালাস দেবেন নয়তো সাজা কমিয়ে দেবেন, না হয় মামলা পুনঃবিচারে পাঠাবেন। মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার আর কোনো উপায় নেই তার।
তিনি আরো বলেন, প্রধান বিচারপতি সুরে আমাদের অ্যাটর্নি জেনারেলও প্রসিকিউশনের সমালোচনা করছেন। তিনি আপিল মামলায় প্রসিকিউটরদের সহায়তা নেন না। আমার আইনজীবী পেশার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে চাই, যে আইনজীবী বলবে তিনি অনেক জানেন, তিনি আসলে কিছুই জানেন না।
খাদ্যমন্ত্রী আরও বলেন, আমরা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব হচ্ছে, প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে নতুন করে শুনানি হওয়া উচিত। প্রধান বিচারপতিকে বাদ দিয়ে একটি বেঞ্চ হোক, সেই বেঞ্চে আপিলের শুনানি হোক। একই সঙ্গে অ্যাটর্নি জেনারেলকেও শুনানি থেকে বাদ দিতে হবে বলেও মন্তব্য করেন সাবেক এই আইন প্রতিমন্ত্রী।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী অ্যাডভোকেট মোজাম্মেল হক বলেন, এখন সংকটময় মুহূর্ত চলছে। প্রধান বিচারপতি প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থার প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন। আর এখন যদি রায়টা মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকে তাহলে টবি ক্যাডম্যানরা বলতে থাকবেন আমরা চাপ সৃষ্টি করেই এই রায় নিয়েছি। আর রায় যদি বিপরীত হয় তাহলে আমরা মানবো না। এটা একটা বড় সংকট। তিনি বলেন, এই সংকট আমাদের সৃষ্টি।
মন্ত্রী বলেন, আমিও একজন ছোট বিচারক ছিলাম। ১২ বছর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ২৪ বছর পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে অনেক বিচার করতে হয়েছে। আমার জীবনে কোনো রায়ের আগে কোনো মন্তব্যই করিনি।
তিনি বলেন, আমার মনে কষ্ট হয়, প্রধান বিচারপতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকেও যদি রায়ের আগেই মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে মন্তব্য করেন তাহলে জাতি কোথায় যাবে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বলেন, বিচারপতিরাও আইনের ঊর্ধ্বে নয়। আমাদের সংবিধানে স্পষ্ট বলা আছে, রাষ্ট্রের প্রধানও আইনের ঊর্ধ্বে নন, তাকেও ইম্পিচমেন্ট করার সুযোগ আছে। তাই প্রধান বিচারপতিও আইনের ঊর্ধ্বে নন। মন্ত্রী বলেন, আইন সবার জন্য সমান। তিনি যে সংকট সৃষ্টি করেছেন এখন সেই সংকটের সমাধান তাকেই করতে হবে। মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা নিয়ে প্রধান বিচারপতি যে বক্তব্য দিয়েছেন তার বক্তব্য প্রত্যাহার করতে। আর সেটা তিনি প্রত্যাহার না করলে পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর বিষয়টি তার ভেবে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন সরকারের এই মন্ত্রী।
তিনি আরো বলেন, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের কথা বলা হচ্ছে, তারা ১৮ দিনে বিচার শেষ করেছে। সেটা ন্যায় বিচার। আর আজ আমরা পাঁচ বছর ধরে সবার বক্তব্য শুনতেই যাচ্ছি, আসামিরাও সাফাই সাক্ষী দিচ্ছে। তার পরেও আমাদের বিচার নাকি সঠিক নয়। এখন টাকার কাছেই সব কিছু, বিবিসির মতো মিডিয়া যারা, একাত্তরে গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেছেন। কিন্তু আজ তারাই আবার যুদ্ধাপরাধীদেরকে ইসলামিক লিডার বলছে। এমন হলে দুনিয়া কিভাবে চলবে, প্রশ্ন করেন তিনি।
এর আগে গোলটেবিল অনুষ্ঠানের শুরুতে সভার ধারণপত্র পাঠ করেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির, ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন, শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরীন চৌধুরী, ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিনী ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু সম্মিলিতভাবে এই ধারনাপত্রটি লিখেন।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফের সভাপতিত্বে সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের ভাইস চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) আবু ওসমান, দৈনিক সংবাদের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক খন্দকার মুনীরুজ্জামান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম, ব্যারিস্ট্রার তুরিন আফরোজ প্রমুখ।
এফএইচ/বিএ