ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

আদালত অবমাননা আইন অবৈধ ঘোষণার ৯ বছর পর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০১:৩২ পিএম, ১৬ নভেম্বর ২০২২

বাংলাদেশে গণমাধ্যম এবং সরকারি কর্মকর্তাদের কিছু সুরক্ষা দিয়ে আদালত অবমাননার যে আইন করা হয়েছিল, হাইকোর্ট সে আইনকে সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বিবেচনায় অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়ছিল ২০১৩ সালের সেপ্টম্বর মাসে। ওই রায়ের পূার্ণাঙ্গ অনুলিপি আজ বুধবার প্রকাশ করা হয়েছে। সে হিসেবে প্রায় ৯ বছর পর রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশের বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ। রায়ের সার্টিফাইট কপি হাতে পেয়েছেন রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।

এর আগে ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক ও বিচারপতি এ বি এম আলতাফ হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে এ রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননা আইন’২০১৩ বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল আবেদন করেন। তবে সেটি মঞ্জুর করেননি সুপ্রিম কোর্টের চেম্বারজজ আদালত। আবেদনটি ২৯ সেপ্টেম্বর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন চেম্বারজজ আদালতের তৎকালীন (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি) বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। কথা ছিল, ওই বছরের ৩ অক্টোবর পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।

চেম্বার আদালতে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের সচিব, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিব হাইকোর্টের রায় স্থগিতের আবেদন জানান। তাদের পক্ষে আদালতে আবেদনটি দাখিল করেন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড মো. বখতিয়ার হোসেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। মূল রিটকারীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।

এর আগে ২০১৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ অবৈধ ও সংবিধান-পরিপন্থী ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সাংবাদিকদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সরকারি কর্মচারীদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনের কথা বিবেচনায় রেখে সরকার আইনটি প্রণয়ন করেছিল। আদালত আইনটি বাতিল ঘোষণা করেছেন। ওই রায়ে ৩৮ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ করা হয়েছে।

২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে আদালত অবমাননা আইন, ২০১৩ পাস হয়। ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননার আইন রহিত করে ২৩ ফেব্রুয়ারি গেজেট প্রকাশিত হয়। আইনের ৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৩(২) ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে গত ২৫ মার্চ দুই আইনজীবী রিট আবেদনটি করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ৩ এপ্রিল আদালত রুল জারি করেন। রুলের ওপর চূড়ান্ত শুনানি শেষে গতকাল আদালত রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে আদালত বলেন, ৪, ৫, ৬, ৭, ৯, ১০, ১১ ও ১৩(২) ধারা সংবিধানের ১০৮, ১১২ ও ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত।

আদালত বলেন, যেকোনো আইনে দেশের সব নাগরিককে সমান অধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। এ আইনে সেকশন অব পিপলকে (জনগণের একটা অংশকে) সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, যা বৈষম্যমূলক, সংবিধানের ২৭, ১০৮ ও ১১২ অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।

আদালত বলেন, অবশ্যই সত্য প্রকাশ ও সমালোচনার সীমা অবারিত নয়। বিধিনিষেধ ছাড়া অবারিত স্বাধীনতা পূর্ণ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। সঠিক ও সত্য প্রকাশের একটি নির্দিষ্ট পরিমণ্ডল থাকতে হবে।

আদালত বলেন, ‘আমরা চাই না, কারও হাত বাঁধা থাকুক। আমরা প্রতিদিনই প্রেসের (গণমাধ্যম) সাহায্য নিই। প্রেস শক্তিশালী মাধ্যম। আমরা প্রেসকে লিমিট করতে চাই না। আবার প্রেসও যেন লিমিটের বাইরে না যায়।’

রায়ে বলা হয়, আদালত কখনো অবমাননার অভিযোগ আনতে চায় না। সীমা অতিক্রম করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এ অভিযোগ আনা হয়। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এটা করতে হয়।

২০১৩ সালের আইনে কোন কোন বিষয় আদালত অবমাননা নয়, তা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। আগের আইনে এ বিষয় স্পষ্ট করা ছিল না।

আইনের ৪ ধারায় নির্দোষ প্রকাশনা বা বিতরণ অবমাননা নয়, ৫ ধারায় পক্ষপাতহীন ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশ আদালত অবমাননা নয়, ৬ ধারায় অধস্তন আদালতের সভাপতিত্বকারী বিচারকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালত অবমাননা নয়, ৭ ধারায় কিছু ক্ষেত্র ছাড়া বিচারকের খাসকামরায় কক্ষে অনুষ্ঠিত প্রক্রিয়া-সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ আদালত অবমাননা নয় বলে আইনে ব্যাখ্যাসহ বলা হয়েছে।

আইনের ৯ ধারায় আদালত অবমাননার পরিধি বিস্তৃত না হওয়া অর্থাৎ এ আইনে শাস্তিযোগ্য নয় এমন কোনো কাজ আদালত অবমাননা বলে গণ্য হবে না।

আইনের ১০ ধারায় প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের কথা বলা হয়েছে। ১০ (১) ধারায় বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের প্রচলিত আইন, বিধিমালা, সরকারি নীতিমালা, পরিপত্র, প্রজ্ঞাপন, স্মারক ইত্যাদি যথাযথভাবে অনুসরণ করে জনস্বার্থে ও সরল বিশ্বাসে কাজ করলে তা আদালত অবমাননা হিসেবে গণ্য হবে না।

১০ (২) ধারায় বলা হয়েছে, উপধারা (১)-এর অধীনে করা কাজের বিষয়ে আদালতের আদেশ-নির্দেশ যথাযথ প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বাস্তবায়ন বা প্রতিপালন করা অসম্ভব হলে তার জন্য আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা যাবে না।

আর আইনের ১৩ (২) ধারায় বলা হয়েছে, আদালত অবমাননার দায়ে শাস্তি হলে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি আপিলে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইলে এবং আদালত তাতে সন্তুষ্ট হলে তাকে ক্ষমা করে দণ্ড মাফ বা কমাতে পারবেন।

আদালত গতকাল এ ধারাগুলোকে সংবিধানের ২৭, ১০৮ ও ১১২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে রায় দিয়েছেন।

সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান এবং ১০৮ অনুচ্ছেদে ‘কোর্ট অব রেকর্ড’ রূপে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা বর্ণনা করা হয়েছে। আর ১১২ অনুচ্ছেদে সবাই সুপ্রিম কোর্টকে সহায়তা করার কথা বলা হয়েছে।

এ রায়ের ফলে ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননার আইন পুনর্বহাল হবে কি না-জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, রায় না দেখে কিছু বলা যাচ্ছে না।

তবে রিট আবেদনকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, আদালত ২০১৩ সালে করা আইনটি বাতিল ঘোষণা করেছেন। আটটি ধারাও অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে এখন ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা আইন পুনর্বহাল হবে। এ রায়ের ফলে এখন আদালতের রায় বাস্তবায়নে প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।

রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী মনজিল মোরসেদ ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিত রায় মামলা পরিচালনা করেন।

আদালত অবমাননা আইনের আটটি ধারা সংবিধানের ১০৮ অনুচ্ছেদের ক্ষমতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক উল্লেখ করে আইনজীবী আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও আয়শা খাতুন রিটটি করেন। প্রাথমিক শুনানির পর জারি করা রুলে ধারাগুলো কেন সংবিধান-পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রাষ্ট্রপতির সচিব, প্রধানমন্ত্রীর সচিব, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও সংসদবিষয়ক সচিবালয়ের সচিবকে ১০ দিনের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

রিটে প্রথম আলো ও বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষভুক্ত করতে আবেদন করেন আইনজীবী ড. কামাল হোসেন। আদালত পক্ষভুক্তির আবেদন নামঞ্জুর করেন, তবে ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য শোনছিলেন।

এফএইচ/এমআইএইচএস/জিকেএস