রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তা
আমাদের দেশে এমন পোশাক মানানসই কি না: হাইকোর্ট
নরসিংদী রেলস্টেশনে ঢাকাগামী ট্রেনের যাত্রী এক তরুণী যে ধরনের পোশাক পরেছিলেন তা দেশের বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে মানানসই কি না, এ প্রশ্ন তুলেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলছেন, আমাদের দেশের কৃষ্টি-কালচার অনুযায়ী গুলশান-বনানীর মতো অভিজাত এলাকার কোনো অনুষ্ঠানেও এ ধরনের পোশাক দৃষ্টিকটু।
প্রায় তিন মাস আগে পোশাক ঘিরে নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্থার অভিযোগের মামলায় মঙ্গলবার (১৬ আগস্ট) আসামি শিলা আক্তার মারজিয়ার জামিন শুনানিতে এমন পর্যবেক্ষণ দেন আদালত।
ওইদিন পুলিশের করা ওই মামলায় আসামি শিলাকে ছয় মাসের জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেন ও বিচারপতি একেএম জহিরুল হকের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ। ফলে তার কারামুক্তিতে আর কোনো বাধা নেই বলে জাগো নিউজকে জানান শিলার আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. কামাল হোসেন।
জামিন আবেদন শুনানিতে তরুণীর হেনস্তার শিকার হওয়ার পর ঢাকা থেকে প্রতিবাদ করতে যাওয়া ব্যক্তিদের পোশাক নিয়েও প্রশ্ন তোলেন হাইকোর্ট।
পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, জামিন আবেদনকারী আইনজীবীর শুনানি অনুযায়ী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী নরসিংদী রেলস্টেশনে স্বল্প পোশাক পরিহিত এক তরুণীকে সতর্ক করেছিলেন। কারন, ওই তরুণীর পোশাক দেশের কৃষ্টি-কালচার, সামাজিক রীতিনীতি ও বাঙালি সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়নি তার।
গত ১৮ মে সকালে নরসিংদী রেলস্টেশনের ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন দুই তরুণ ও এক তরুণী। মেয়েটির পরনে ছিল জিন্স প্যান্ট ও স্লিভলেস টপস। এমন পোশাকের কারণে স্টেশনে অবস্থানরত এক নারী প্রথমে ওই তরুণীকে আঘাত করেন ও পরে আরও কয়েকজন ব্যক্তি তার ওপর হামলার চেষ্টা চালান বলে অভিযোগ ওঠে।
ঘটনার রাতেই নরসিংদী রেলওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ইমায়েদুল জাহেদী বাদী হয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারায় ভৈরব রেলওয়ে থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে এক নারীসহ দুজনের নাম উল্লেখ করা হয় এবং অজ্ঞাত আরও এক নারী ও ১০ পুরুষকে আসামি করা হয়। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরা ফুটেজ ও মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিওতে অবস্থান নিশ্চিত হওয়ার পর তাদের আসামি করা হয়।
তরুণীকে হেনস্থা ও মারধরের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে ঘটনার দুদিন পরই ২০ মে নরসিংদী শহরের ইউএমসি জুট মিলের সামনে থেকে ইসমাইল মিয়া নামের এক যুবককে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর ২৯ মে দিনগত রাত ৩টার দিকে জেলার শিবপুরের ইটাখোলা এলাকায় অভিযান চালিয়ে হেনস্তাকারী নারী শিলা আক্তারকে গ্রেফতার করে র্যাব-১১ এর একটি দল।
মঙ্গলবার আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবুল হাশেম। সঙ্গে ছিলেন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মির্জা মো. শোয়েব মুহিত। অন্যদিকে আসামি শিলার জামিন আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. কামাল হোসেন। এসময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন নরসিংদী জেলা জজ আদালতের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শিরিন আক্তার (শেলী)।
এর আগে নরসিংদীর আদালতে জামিন আবেদন খারিজ হওয়ার পরে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। জামিন আবেদনের গ্রাউন্ড হিসেবে বলা হয়, তিনি (শিলা) একজন নারী। নরসিংদী রেলস্টেশন ঢাকা রেঞ্জে হওয়ার পরেও মামলা করা হয়েছে ভৈরব রেঞ্জে। এছাড়া ভিকটিম নিজে মামলা করেননি, তার বন্ধুও অভিযোগ করেনি। আদালতের নির্দেশনার পর মামলা হয়েছে। এসব বিষয়ে শুনানি নিয়ে জামিনের আদেশ দেন হাইকোর্ট।
শুনানিতে আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, আইনজীবী নিবেদন করেন যে সবারই পোশাক-আশাকের বিষয়ে রুচিশীল হওয়া উচিত। স্থান-কাল ভেদে সামঞ্জস্যপূর্ণও হতে হবে। অন্যথায় অনভিপ্রেত ঘটনার ক্ষেত্র সৃষ্টি হতে পারে। তখন এর দায়-দায়িত্ব কার ওপরে বর্তাবে। সেক্ষেত্রে পোশাক পরার বিষয়ে সবার সচেতন থাকা উচিত।
হাইকোর্ট বলেন, ভিকটিমের পোশাক-পরিচ্ছদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তার পোশাক এতোটাই অসামঞ্জস্য ছিল যে, আসামি (শিলা আক্তার মারজিয়া) কন্যা সন্তানের মা হিসেবে যদি সাবধান করেও থাকেন তবে তা মাতৃত্বের অধিকার থেকেই করেছেন।
আদালত বলেন, এখানে মেয়েটি তার বন্ধু বা বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে গেলেন, কিন্তু রেলস্টেশনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে ভিকটিম নিজে বা তার বন্ধু কেউ কোনো আপত্তি তোলেননি। আমরা উভয়পক্ষের আইনজীবীদের দাবি বিবেচনায় নিয়ে আসামির আইনজীবীর আবেদন বিবেচনাযোগ্য মনে করে জামিন মঞ্জুর করলাম।
এসময় আদালত আবার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীকে ডেকে বলেন, আপনারা কি ভিকটিমের জবানবন্দি নিয়েছিলেন। এর জবাবে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য
ভিকটিমের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন। তাদের খুঁজে না পাওয়ায় এতোদিন তার ২২ ধারায় জবানবন্দি নিতে পারেননি।
এ পর্যায়ে আদালত ওই নারীর পোশাক নিয়ে আবারও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর দিকে প্রশ্ন তোলেন। হাইকোর্ট বলেন, আমাদের দেশে গুলশান-বনানী এলাকার কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও এমন পোশাক মানানসই হয় কি না। আমাদের সামাজিক কৃষ্টি-কালচার অনুযায়ী গুলশান-বনানীতেও এ ধরনের পোশাক দৃষ্টিকটু।
আদালতের ভাষ্য, নরসিংদী রেলস্টেশনের মতো একটি জায়গায় এ ধরনের পোশাক পরায় ওই তরুণীকে সতর্ক করেছিলেন একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী। সেই নারীকে গ্রেফতারের পর অন্য এক দল প্রতিবাদ করতে চলে গেলো। যারা প্রতিবাদ করতে গেলো তাদের পোশাক কেমন ছিলো? সেখানে যদি আরেক দল তাদের প্রতিরোধ করতে আসতো তখন কে এর দায় নিতো।
এসময় আদালত এ ঘটনায় বিভিন্ন গণমাধ্যমে আসা ভিডিও ফুটেজ সম্বলিত একটি সিডি রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর হাতে তুলে দেন।
আসামির জামিন আদেশের পর আইনজীবী কামাল হোসেন বলেন, আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেছেন, গুলশান-বনানীর মতো এলাকায়ও কোনো মেয়ে এ ধরনের পোশাক পরে রাস্তায় বের হয় না। সেখানে গ্রামের মতো একটি জায়গায় পাবলিক প্লেসে এ রকম পোশাক পরা স্বাধীনতা হতে পারে না। যেমন খুশি তেমন পোশাকের নামে আমাদের সোসাইটির কালচারকে ধ্বংস করতে পারে না। ওই মেয়ে যে ধরনের পোশাক পরিহিত ছিল সেটা আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থার সঙ্গে বেমানান। যে কারণেই প্রতিবাদের শিকার হয়েছিল।
তিনি আরও বলেন, মায়ের বয়সী একজন নারী যে প্রতিবাদ করেছে এটা কোনোভাবেই নারী-শিশু নির্যাতন আইনের ১০ ধারায় যায় না। কেননা ১০ ধারায় বলা আছে, যৌন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশে যদি কোনো নারীকে হেনস্তা করা হয়। ৬০ বছর বয়সী একজন নারীর পক্ষে কীভাবে ২২ বছর বয়সী মেয়েকে যৌন হেনস্তা করা হয়েছে, এটা বোধগম্য নয়। আর ভিকটিম নিজে মামলা করেননি, ২২ ধারায় জবানবন্দি দেননি। তার বন্ধুরা মামলা করেনি। স্টেশন মাস্টারও মামলা করেনি। এটা পরিকল্পিতভাবে পুলিশের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে মামলা করার জন্য। আর যে আইনে মামলা হওয়ার কথা, সেটাও হয়নি। এ মামলা অবান্তর, অযাচিত।
নরসিংদী রেলস্টেশনে ওই তরুণীকে হেনস্তার ঘটনায় শিলা আক্তারকে গ্রেফতারের পরই পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে তাকে তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছিলেন নরসিংদী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক দেলোয়ার হোসেন।
র্যাব-১১ সূত্রে জানা যায়, রেলস্টেশনে তরুণীকে লাঞ্ছিতের ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হলে মূলহোতা শিলা আক্তার মারজিয়া ওরফে শায়লা আত্মগোপনে চলে যান। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে শিবপুর উপজেলার ইটাখোলা এলাকায় শিলার খালার বাসায় অভিযান চালানো হয়। সেখানে থেকে ২৯ মে দিনগত রাত ৩টার দিকে তাকে গ্রেফতার করে রেলওয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
রেলওয়ে পুলিশের এসআই ও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হারুনুর জামান রুমেল জাগো নিউজকে জানান, গ্রেফতারের পরদিন ৩০ মে সন্ধ্যায় শিলা আক্তারকে নরসিংদী সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক দেলোয়ার হোসেনের আদালতে সোপর্দ করা হয়।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে পাঁচদিনের রিমান্ড আবেদন করেন। পরে আদালতের বিচারক তিনদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এর পরে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত।
গত ২০ মে এ মামলার অন্য আসামি ইসমাইলকে আটক করার পর ৫৪ ধারায় তাকে গ্রেফতার দেখিয়ে নরসিংদীর অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ সিদ্দিকীর আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ।
এফএইচ/এমকেআর/এমএস