ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

‘হয়তো মামলার সিন্দুকের চাবি হারিয়ে গেছে’

জাহাঙ্গীর আলম | প্রকাশিত: ০৯:৫২ পিএম, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২

সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যাকাণ্ডের দশম বার্ষিকী শুক্রবার (১১ ফেব্রুয়ারি)। এ হত্যা মামলার তদন্ত সংস্থা র‌্যাব প্রতিবেদন দাখিল করতে না পারায় সেটি জমা দেওয়ার তারিখ ৮৫ বার পিছিয়েছেন আদালত। দীর্ঘ সময়ও মামলাটির তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল না হওয়ায় আক্ষেপ ঝরছে দুই সাংবাদিকের স্বজনদের কণ্ঠে। সাগরের মা সালেহা মুনিরা বলেন, ‘কোনো প্রভাবশালী মহলের ইশারায় মামলাটি সিন্দুকবন্দি হয়ে আছে। হয়তোবা সিন্দুকের চাবি হারিয়ে গেছে।’

২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক গোলাম মোস্তফা সারোয়ার ওরফে সাগর সারোয়ার ও তার স্ত্রী এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন নাহার রুনা ওরফে মেহেরুন রুনি রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় খুন হন। তখন বাসায় ছিল তাদের সাড়ে চার বছরের ছেলে মাহির সারোয়ার মেঘ। হত্যাকাণ্ডের পর রুনির ভাই নওশের আলম রোমান শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা করেন।

সেসময় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তারা বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই খুনিদের গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হবে। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পেরিয়ে সাড়ে ৮৭ হাজার ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এত সময়ে মামলার বিচারই শুরু করা যায়নি। যদিও এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে বিভিন্ন সময় রাজপথে আন্দোলন করেছেন তাদের সহকর্মীরা।

প্রথমে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার এক উপ-পরিদর্শক (এসআই)। চারদিন পর চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্তভার হস্তান্তর করা হয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) কাছে। দুই মাসেরও বেশি সময় তদন্ত করে ডিবি রহস্য উদ্ঘাটনে ব্যর্থ হয়। পরে হাইকোর্টের নির্দেশে ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হত্যা মামলাটির তদন্তভার র‌্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

মামলায় আটজনকে বিভিন্ন সময় গ্রেফতার করা হয়। এদের মধ্যে বাড়ির নিরাপত্তাকর্মী এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, মিন্টু, কামরুল হাসান, বকুল মিয়া, রফিকুল ইসলাম ও আবু সাঈদ কারাগারে। পলাশ রুদ্র পাল ও তানভীর রহমান নামে দুজন হাইকোর্ট থেকে জামিনে আছেন।

মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর নয় বছর ১০ মাস গড়ালেও র‌্যাব এখনো কোনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি আদালতে। পেছাতে পেছাতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখ ৮৫ বার পেছাতে হয়েছে। এ কারণে মামলার বিচারকাজ কবে শুরু হবে, তা নিয়ে চিন্তিত সাগর-রুনির স্বজনরা।

jagonews24
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবিতে বিভিন্ন সময় আন্দোলন করেছেন সাংবাদিকরা/ফাইল ছবি

সাগর সারওয়ারের মা সালেহা মুনির আক্ষেপ প্রকাশ করে জাগো নিউজকে বলেন, ‘মামলাটি কোনো প্রভাবশালী মহলের ইশারায় সিন্দুকবন্দি হয়ে আছে। হয়তোবা সিন্দুকের চাবিই হারিয়ে গেছে। তাই হত্যাকাণ্ডের দশ বছরেও এর রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্ত সংস্থা।’

মেয়ে ও জামাইয়ের হত্যাকাণ্ডের বিচার না দেখতে পারার আক্ষেপ নিয়েই গত ৫ জানুয়ারি সকালে মারা যান মা নুরুন নাহার মির্জা (৬৪)। সেই প্রসঙ্গ টেনে সালেহা মুনির বলেন, ‘রুনির মা কিছু দিন আগে মারা গেছেন। তিনি তার মেয়ে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারেননি। আমিও এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে পারবো কি না, তা নিয়ে সন্দিহান।’

সাগরের মা বলেন, ‘সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর এ ধরনের অনেক মামলা হয়েছে। মামলার রহস্যও উদ্ঘাটন হয়েছে, আসামিদের সাজাও হয়েছে। কিন্তু কোন প্রভাবশালী মহলের ইশারায় সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত সিন্দুকবন্দি হয়ে আছে আমরা জানি না। সরকার সদিচ্ছা করলে এ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন করতে পারে। সরকার যেন মামলাটির রহস্য দ্রুত উদ্ঘাটন করে এ প্রত্যাশা আমার।’

মামলার বাদী রুনির ভাই নওশের আলম রোমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বোনের হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে পারেননি আমার মা। ১০ বছর ধরে এ হত্যা মামলার তদন্ত চলছে। আর কত বছর লাগবে এ হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করতে আল্লাহই ভালো জানেন।’

ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘তদন্ত সংস্থার উচিত মামলাটি দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা।’

মামলার তদন্ত সংস্থা র‌্যাবের লিগ্যাল আ্যন্ড মিডিয়া উইংয়ের সহকারী পরিচালক এএসপি আ ন ম ইমরান খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের মামলাটি স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনার প্রায় দুই মাস পর তদন্তভার র‌্যাবের ওপর ন্যস্ত হয়। তদন্তভার পাওয়ার পর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার ও পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে র‌্যাব।’

র‌্যাব বিভিন্ন বাহিনী, সংস্থা ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের তদন্ত বিশ্লেষণ অব্যাহত রেখেছে জানিয়ে ইমরান খান বলেন, ‘আমরা অপরাধের ধরন বিশ্লেষণ করেছি। ১৬০ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছি। আটজন আসামিকে গ্রেফতার করে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। আমরা আমাদের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেশের গণ্ডি অতিক্রম করে উন্নত দেশের সহায়তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ডিএনএ পরীক্ষা করেছি। এ বিষয়ে আমরা কাজ করছি। আমরা আমাদের প্রচেষ্টা কোনো ঘাটতি রাখছি না। আদালতে মামলার অগ্রগতির বিষয়টি বিভিন্ন সময় অবহিত করছি।’

jagonews24সন্তান মাহির সারোয়ার মেঘের সঙ্গে সাগর সারোয়ার ও মেহেরুন রুনি। এই ছবি মেঘের কাছে এখন কেবলই স্মৃতি

হত্যায় জড়িতদের ছবি প্রস্তুতে চলছে প্রচেষ্টা
২০২০ সালের ৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম আদালত সাগর-রুনি হত্যা মামলার অগ্রগতির বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন তদন্ত সংস্থা র‌্যাবকে। আদালতের আদেশে ওই বছরের ৫ অক্টোবর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‌্যাব ফোর্সেস সদর দপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার খন্দকার মো. শফিকুল আলম আদালতে একটি অগ্রগতি প্রতিবেদন দাখিল করেন।

এতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘মামলাটি ২০১৯ সালের ৭ জুলাই থেকে আমি তদন্ত করে আসছি। তদন্তকালে পূর্ববর্তী তদন্তকারী অফিসার তদন্তের আনুষঙ্গিক কাজ করার পাশাপাশি মোট আটজন আসামি গ্রেফতার করেছেন। গ্রেফতারকৃত আসামিদের মধ্যে ছয়জন বর্তমানে জেলহাজতে আছেন। দুজন জামিনে মুক্ত আছেন।’

পুলিশ সুপার আরও উল্লেখ করেন, ‘মামলাটি যথাযথভাবে তদন্তের লক্ষ্যে জব্দকৃত আলামত ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতের অনুমতিক্রমে যুক্তরাষ্ট্রের আইএফএসে পাঠানো হয়। ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পূর্বে পাঠানো আলামত এবং গ্রেফতারকৃত আসামিদের ‘বুক্যাল সোয়াব’ পর্যালোচনায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই পুরুষের ডিএনএ পাওয়া গেছে। তদন্তকালে তাদের চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে প্যারাবন স্ন্যাপশট নামীয় যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ডিএনএ ল্যাবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। জড়িত ব্যক্তির ছবি প্রস্তুত করার সক্ষমতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ডিএনএ ল্যাবের।’

অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে পূর্বের প্রতিষ্ঠান আইএফএসের সমন্বয়পূর্বক ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের ছবি প্রস্তুতের প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে। আইএফএস কর্তৃক সংরক্ষিত বর্ণিত ডিএনএ প্যারাবন স্ন্যাপশট নামীয় প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহের সার্ভিস চার্জ হিসেবে ১২০০ মার্কিন ডলার ফি নির্ধারণ করায় যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণপূর্বক ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। সর্বশেষ ২০২০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আইএফএস ল্যাব কর্তৃপক্ষকে উল্লিখিত পরীক্ষার অগ্রগতির বিষয়ে মতামতের জন্য ইমেইল পাঠানো হয়েছে। ল্যাব কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে এখনো কোনো মতামত দেয়নি। ডিএনএ প্রযুক্তির মাধ্যমে সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহের প্রচেষ্টাসহ মামলার তদন্ত কার্যক্রম অব্যাহত আছে।’

জেএ/এইচএ/জিকেএস