‘জামিন পেলে আত্মসাতের টাকা নিয়ে পালাতে পারেন ই-অরেঞ্জ মালিক’
অগ্রিম টাকা নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ায় গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে দেশীয় কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। গ্রাহকরা বলছেন, প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের কম দামে পণ্য দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করেছে। সবশেষ প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগে ই-অরেঞ্জ শপের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন গ্রাহকরা।
প্রতিষ্ঠানটি পণ্য দেওয়ার কথা বলে অগ্রিম নেওয়া এক হাজার একশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে বলে অভিযোগ। রাজধানীর গুলশান থানায় করা মামলায় প্রতিষ্ঠানের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমানসহ চারজন গ্রেফতার হয়েছেন। তারা এখন কারাগারে।
আসামিরা জামিনে মুক্তি পেলে আত্মসাৎ করা অর্থ বিদেশে পাচার করতে পারেন এবং কৌশলে দেশত্যাগ করার আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।
এর আগে তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। রিমান্ড শেষে আদালতে হাজির করে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা গুলশান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমিনুল ইসলাম আসামিদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন। ওই আবেদনে অর্থপাচার ও আসামিদের দেশত্যাগের শঙ্কার কথা জানান তিনি।
লোগো
তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে জানান, জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য-উপাত্ত দিয়েছেন। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। আসামিরা পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে গ্রাহকদের বেশি লাভের প্রলোভন দেখিয়ে টাকা নিয়েছেন। তবে শর্ত অনুযায়ী পণ্য ডেলিভারি দেননি।
‘আসামিদের দেওয়া তথ্য যাচাই করতে গিয়ে পুনরায় তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রয়োজন হতে পারে। তারা জামিনে মুক্তি পেলে আত্মসাৎ করা অর্থ বিদেশে পাচার করতে পারেন এবং কৌশলে দেশ ছেড়ে পালাবেন বলে আশঙ্কা রয়েছে। ফলে মামলার তদন্ত ও বিচারকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের জেলহাজতে আটক রাখা প্রয়োজন।’
মামলার পরদিন ই-অরেঞ্জ শপের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন ও তার স্বামী মাসুকুর রহমান আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। তবে শুনানি শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন আদালত। পরদিন তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন আদালত।
গত ২৩ আগস্ট মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য সোনিয়া, মাসুকুর ও আমান উল্লাহকে ১০ দিন করে রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূঁইয়া প্রত্যেকের পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) পাঁচদিনের রিমান্ড শেষে তাদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর হাকিম বাকী বিল্লাহ তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
অন্যদিকে গত ২৯ আগস্ট মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম ই-অরেঞ্জের সাবেক চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) নাজমুল আলম রাসেলকে আদালতে হাজির করে তাকে গ্রেফতার দেখানোসহ ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন। ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর হাকিম আবুবকর ছিদ্দিক তাকে গ্রেফতার দেখানোর আবেদন মঞ্জুর করেন। এরপর শুনানি শেষে রাসেলের চারদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
শুক্রবার (৩ সেপ্টেম্বর) চারদিনের রিমান্ড শেষে তাকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে পুলিশ। এসময় মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগারে আটক রাখার আবেদন করা হয়।
অন্যদিকে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করেন। ঢাকা মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমান তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দিয়ে রোববার জামিন শুনানির জন্য দিন ধার্য করে।
ই-অরেঞ্জের প্রতারণার প্রতিবাদে মানববন্ধন
গত ১৬ আগস্ট ই-অরেঞ্জ শপের বিরুদ্ধে এক হাজার একশ কোটি টাকা প্রতারণামূলকভাবে আত্মসাতের অভিযোগে মামলা করেন তাহেরুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী। মামলায় তিনি ই-অরেঞ্জের পাঁচ কর্মকর্তাসহ সব মালিককে আসামি করেছেন।
মামলার আসামিরা হলেন- ই-অরেঞ্জের মালিক সোনিয়া মেহজাবিন, তার স্বামী মাসুকুর রহমান, চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আমান উল্লাহ ও সাবেক চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) নাজমুল আলম রাসেল, বিথি আক্তার ও কাওসার।
মামলায় উল্লেখ করা হয়, গত ২৮ এপ্রিল থেকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের পণ্য কেনার জন্য টাকা দেওয়া হয়, যা একটি নির্দিষ্ট মেয়াদের পর ই-অরেঞ্জ কোম্পানির ডেলিভারি দেওয়ার কথা ছিল। এ শর্তেও বারবার নোটিশের নামে ভুক্তভোগীদের পণ্য ডেলিভারি না করে প্রতারণা করে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা ই-অরেঞ্জ অফিসে গিয়ে ডেলিভারি দেওয়ার কথা বললে কর্মরত কর্মকর্তা ও মালিকপক্ষ জানান, কিছুদিনের মধ্যে পণ্যগুলো ডেলিভারি হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো পণ্য ডেলিভারি না করে এক লাখ ভুক্তভোগীর প্রায় এক হাজার একশ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।’
মামলায় আরও বলা হয়, করোনাকালে ভুক্তভোগীদের কষ্টার্জিত অর্থের নিশ্চয়তা না দিয়ে ই-অরেঞ্জ তাদের মালিকানা পরিবর্তনের নামে ধোঁয়াশা সৃষ্টি করছে। নতুন মালিক ও পুরোনো মালিকের কোনো তথ্য ভুক্তভোগীদের সামনে প্রকাশ করা হচ্ছে না। এছাড়া আসামিরা সব ধরনের দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন বলেও মামলায় উল্লেখ করা হয়।
মামলার বাদী তাহেরুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় এক লাখ গ্রাহকের এক হাজার একশ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ই-অরেঞ্জ মালিক সোনিয়া মেহজাবিনসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। মামলার পর এখনো এজাহারভুক্ত দুই আসামি বিথি আক্তার ও কাওসারকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। আমরা টাকা ফেরত চাই।’
তিনি আরও বলেন, কয়েকদিন আগে আমি আট হাজার গ্রাহকের তিনশ কোটি টাকা আত্মসাতের তালিকা আইনজীবীর কাছে দিয়েছি। আমরা এখন দিশেহারা হয়ে পড়েছি। সরকারের কাছে আমাদের আকুল আবেদন যাতে আত্মসাৎ করা টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।
তদন্ত কর্মকর্তা আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে প্রতারণার মামলাটি তদন্ত করছি। আদালতের নির্দেশে আরও দুটি মামলা গুলশান থানায় এসেছে। আমরা তা নথিভুক্ত করেছি। প্রথম মামলার পাশাপাশি এ দু’টি মামলাও আমরা তদন্ত করছি।’
এর আগে ই-অরেঞ্জ শপের বিরুদ্ধে অর্ডার নিয়ে পণ্য ডেলিভারি না দেওয়ার অভিযোগে ১৬ আগস্ট রাজধানীর গুলশানে বিক্ষোভ করেন ভুক্তভোগীরা। সেই টাকা ও পণ্যের দাবিতে মিরপুরে মাশরাফি বিন মর্তুজার বাসার সামনেও বিক্ষোভ করেন তারা।
ওই সময় মাশরাফি বলেন, ‘ই-অরেঞ্জের সঙ্গে আমার ছয়মাসের চুক্তি ছিল। সেটা শেষ হয়েছে। আমি এখন এটির সঙ্গে নেই। তবুও একজন গ্রাহক বলছেন, তাদের পাশে আমাকে থাকতে হবে। আইনগত জায়গায় খুব বেশি কিছু করার নেই। তবুও সাধারণ মানুষের কারণে কথা বলেছি। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, তাদের পাশে দাঁড়াব।’
জেএ/এএএইচ/এএ/এএসএম