আবদুল মতিন খসরু : যার হাত ধরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু
চিরদিনের জন্য পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে গেলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সর্বশেষ ২০২১-২২ মেয়াদের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচিত সভাপতি ও বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্যপদসহ পাঁচবারের এমপি অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু।
মহান স্বাধীনতার দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসলে তিনি সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। দায়িত্বের সময়কাল ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল মতিন খসরু সর্বশেষ ২০২১-২২ মেয়াদের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হন। হাসপাতালে থেকেই গত ১২ এপ্রিল ভার্চুয়ালি দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
তিনি মন্ত্রী থাকার সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কালো আইন ইনডেমনিটি বাতিল ও লিগ্যাল এইড আইন প্রণয়ণ করা। আব্দুল মতিন খসরুর সময়ে সরকারের সবচেয়ে সফল কাজটি ছিল ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ।
এই অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা করেন তিনি মন্ত্রী থাকার সময়। এছাড়াও আইন অঙ্গনের গুরুত্বপূর্ণ মামলা পরিচালনা করেছেন তিনি।
বুধবার (১৪ এপ্রিল) বিকেল ৪টা ৫০ মিনিটের দিকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু মারা যান। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, আইনমন্ত্রী, প্রধান বিচারপতি, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যগণ, বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও দেশের বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন শোক জানিয়েছে।
আবদুল মতিন খসরুর সংক্ষিপ্ত জীবনী
সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট আবদুল মতিন খসরু ১৯৭৮ সালে কুমিল্লা জজ কোর্টে যোগদান করেন এবং ১৯৮২ সাল থেকে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে নিয়মিত প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন এবং কুমিল্লা জেলার অবিভক্ত বুড়িচং থানার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ ও হাইকোর্ট বিভাগে তার করা অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলা ডি.এল.আর (DLR) সহ বিভিন্ন ‘ল’ জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। আইনপেশার পাশাপাশি জাতীয় রাজনীতির সঙ্গেও জড়িত ছিলেন তিনি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্যও ছিলেন তিনি।
এর আগে তিনি দলের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির আইন বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, যুবলীগ, আওয়ামী লীগের থানা ও জেলার বিভিন্ন পদে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাঁচবার জাতীয় সংসদ সদস্য ছিলেন।
১৯৯১-১৯৯৬, ১৯৯৬-২০০১, ২০০৯-২০১৪, ২০১৪-২০১৮ ও সর্বশেষ ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে জাতীয় সংসদে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তিনি, ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের আইন,বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। আইনমন্ত্রী থাকাকালে ১৯৯৬ সালে সংবিধান ও মানবতাবিরোধী কালো আইন ইনডেমনিটি (Indemnity Oপdinance) অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচারের ব্যবস্থা করেন, যার ধারাবাহিকতায় পরবর্তীকালে সুষ্ঠু বিচারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারবর্গের আত্মস্বীকৃত খুনিদের ফাঁসির আদেশ কার্যকর করা হয় ।
তিনি ২০০০ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত African-Asian Legal Conference of the Asian Political Parties Consultative Committee (AALCC) সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন।
আবদুল মতিন খসরু ২০১০ সালে কম্বোডিয়ার রাজধানী নম পেনে অনুষ্ঠিত এশিয়ান রাজনৈতিক দলসমূহের সংগঠন International Conference of Asian Political Parties( ICAPP) এর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন, যে সম্মেলনে কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সর্বশেষ Member Standing Committee of ICAPP এর দায়িত্ব পালন করছিলেন তিনি। তিনি ২০১৩ সালে চীনে অনুষ্ঠিত International Ecological Safety Collaborative Organisation(ICAPP) এর সম্মেলনে Senior Advisor and Deputy Director of Legal Affairs Committee নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
মতিন খসরু ১০ম জাতীয় সংসদের অনুমিত হিসাব সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতির দায়িত্বসহ আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
তিনি জাতীয় সংসদের প্রতিবন্ধী বিষয়ক সংসদীয় মোর্চার (CAUCAS) আহ্বায়ক ছিলেন। এছাড়াও তিনি নিউইয়র্ক ভিত্তিক পার্লামেন্টারি সংগঠন Parliamentary Global Action (PGA) এর অন্যতম সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেক আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সেমিনারে যোগদান করেছেন।
এসকল সেমিনারে তিনি বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও সংসদীয় গণতন্ত্র শক্তিশালীকরণ সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে বিশিষ্ট পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি All Party Parliamentary Caucas on Population Management এর Convenor নির্বাচিত হন।
২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় সরকারের আমলে সমগ্র বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে আগত আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনসমূহের হাজার হাজার নেতাকর্মীর মিথ্যা, রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বিনা পারিশ্রমিকে নিষ্পত্তি করার সুযোগ পেয়েছিলেন।
তিনি আইনমন্ত্রী থাকাকালীন ২০০০ সালে অসহায় ও দরিদ্র বিচারপ্রার্থী মানুষের সার্বিক ও আইনগত সহায়তা প্রদানের জন্য 'Legal Aid Act' প্রণয়ন ও পাশ করেছিলেন।
তিনি বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবস্থাকে আমূল সংস্কার ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে বিশ্ব ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় Bangladesh Legal Aid Capacity Building Project নামে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেন।
তিনি আইনমন্ত্রী থাকাকালীন সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনসহ সারাদেশে বিচারালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেন।
সর্বশেষ তিনি গত ১০ ও ১১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সভাপতি নির্বাচিত হন এবং ১২ এপ্রিল অসুস্থ অবস্থায় সমিতির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এফএইচ/ইএ/এমকেএইচ