ভিডিও EN
  1. Home/
  2. আইন-আদালত

ইউনুছ আলী একই অপরাধ ৩ বার করেছেন, কত ছেড়ে দেব?

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ০৪:৩২ পিএম, ১২ অক্টোবর ২০২০

আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ কর্তৃক আদালত অবমাননার বিষয়ে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘এই আইনজীবী (ইউনুছ আলী আকন্দ) একজন হ্যাবিচুয়াল কনটেম্পনার (অভ্যাসগত আদালত অবমাননাকারী)। এর আগেও তিনি তিনবার একই ধরনের অপরাধ করেছেন, তাকে ছেড়ে দিয়েছি। আর কতবার তাকে ছেড়ে দেব? তিনি এবার যে কাজ করেছেন সেটা কি ক্ষমারযোগ্য? তার যে বয়স (৬১ বছর) তাতে প্র্যাকটিস থেকে অবসর নেয়ার সময় হয়েছে।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দের করা বিরূপ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অবমাননার শুনানিতে রোববার (১১ অক্টোবর) প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন তাকে উদ্দেশ করে এসব কথা বলেন।

এ দিন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে (ভার্চুয়াল) এ মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ভার্চুয়ালে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবীরা শুনানিতে সংযুক্ত ছিলেন। পরে এ বিষয়ে আদেশের জন্য সোমবার দিন ঠিক করেন আদালত।

শুনানির একপর্যায়ে আইনজীবীদের উদ্দেশে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘কোন কাজটি গোপনে হয়েছে আপনারাই বলুন? ১৫ বছর ধরে যেসব ফাঁসির আসামি কনডেম সেলে আছে, তাদের জেল আপিল শুনছি। এসব আপিল কি আমরা গোপনে শুনছি? উভয় পক্ষের আইনজীবীদের শুনানি নিয়েই জেল আপিলের রায় দেয়া হচ্ছে। তাতে কেউ খালাস পাচ্ছেন, কারও সাজা বহাল থাকছে। এসব পুরোনো মামলা শোনার ক্ষেত্রে সরকারের কী স্বার্থ থাকতে পারে? পুরোনো মামলা শুনানি করতে গিয়ে কি বিচার বিভাগ ধ্বংস হয়ে গেছে? করোনাকালে আমরাই ভার্চুয়াল কোর্ট চালু করেছি। আদালতের নানা বিষয়ের সঙ্গে সরকারের প্রসঙ্গ টেনে আনা বা যোগসূত্র খোঁজা দুঃখজনক।’

সকাল সাড়ে ৯টায় প্রধান বিচারপতির কোর্টের ডায়াসে রাখা ল্যাপটপের সামনে সশরীরে উপস্থিত হন আদালত অবমাননাকারী আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ।

এ সময় আদালত অবমাননার ভুল স্বীকার করে তিনি নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে লিখিত আবেদন জমা দেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, এক হাজারের মতো জনস্বার্থমূলক মামলা করেছেন। তিনি জনস্বার্থ মামলা করার ক্ষেত্রে একজন ‘পাইওনিয়ার’। একই সঙ্গে তার ওই ক্ষমার আবেদনে ১০-১৫ জন সিনিয়র আইনজীবীর নামও উল্লেখ করেছেন। সেখানে বলেছেন, উনি তাদের এ মামলায় নিয়োগ করেছেন।

কিন্তু সিনিয়র আইনজীবীরা বলেন, তাদের সম্মতি না নিয়েই ক্ষমার আবেদনে তাদের নাম জুড়ে দেয়া হয়েছে।

এ সময় ইউনুছ আলীর আবেদনে উল্লেখ করা অন্যান্য তথ্য সঠিক কি না- তা নিয়ে সন্দেহ পোষণ করে প্রশ্ন তোলেন আপিল বিভাগের বিচারপতিরা।

আপিল বিভাগের বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার বলেন, ‘এটা কি আদালতকে ধোঁকা দেয়া নয়? এত মিথ্যা আপনি ঢাকবেন কী করে? একটি নয়, হাজারটি মিথ্যা বলেছেন।’

তখন ইউনুছ আলী বলেন, ‘মাই লর্ড যে আবেদন দিয়েছি সেটা পরিবর্তন করে নতুন করে আবার আবেদন জমা দেব।’

আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী বলেন, ‘যে আবেদন দিয়েছেন সেটা এখন কোর্টের রেকর্ড। এটা মুছে ফেলা বা পরিবর্তন করা যাবে না। সারাবিশ্বে আমাদের জুডিশিয়ারিকে হেয় করেছেন।’

সকালে আপিল বিভাগের শুনানির শুরুতে নবনিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন আদালতকে বলেন, ‘আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ ফেসবুকে বিচার বিভাগ নিয়ে যেসব স্ট্যাটাস দিয়েছেন- তা বিচার বিভাগের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে।’

আদালত অবমাননাকারী আইনজীবীর উদ্দেশে বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আপনার ফেসবুক স্ট্যাটাসে কার বিচার চেয়েছেন বা কারা বিচার বিভাগকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে? সেটা বলুন।’

এ আইনজীবী বলেন, ‘আমি বিচারক বা বিচার বিভাগ কোনোটিকেই বোঝাইনি। আমি তো ক্ষমা চেয়েছি। যেদিন এই স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম ওই দিনই তা মুছে ফেলেছি।’

বিচারপতি হাসান ফয়েজ বলেন, ‘ওই স্ট্যাটাস দিয়ে সারাবিশ্বে আমাদের জুডিশিয়ারিকে হেয় করেছেন।’

আইনজীবী বলেন, ‘আমাকে তলব করার আগেই তা ডিলিট করেছি।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘মিথ্যা বলার আর জায়গা পান না।’ বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমাদের পরিসংখ্যান বলছে ল’ ভার্চুয়াল কোর্ট করোনাকালে এক লাখ ৪৭ হাজার জামিনের আবেদন শুনেছে। ৭২ হাজার আসামিকে জামিন দিয়েছে’।

‘করোনাকালে আইনজীবীরাই বাধ্য করেছিল কোর্ট বন্ধ রাখতে’ উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘করোনাকালে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সম্পাদক আমাকে বলেছিলেন বর্তমান অবস্থায় কোর্ট খোলা ঠিক হবে না। কোর্ট খুললে হাঙ্গামা করবেন আইনজীবীরা। কিন্তু করোনাকালে বিশ্বের কোনো দেশে সম্পূর্ণ কোর্ট বন্ধ থাকেনি। আপনারাই (আইনজীবী) বাধ্য করেছেন কোর্ট বন্ধ রাখতে।’

তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘করোনায় মানুষের আক্রান্ত ও মৃত্যুর বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আমরা কোর্ট বন্ধ রাখার কথা বলেছিলাম।’

সমিতির সভাপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, ‘আপনারা যখন কোর্ট খুলে দিলেন তখন আইনজীবীরা চিঠি ও ফেসবুকে শত শত স্ট্যাটাস দিয়ে বিরোধিতা করতে লাগল।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি তো সমস্যার মধ্যে আছি, কোর্ট খুললেও বিপদ আবার না খুললেও বিপদ।’

বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী বলেন, ‘আমরা ৫০ দিনের অবকাশকালীন ছুটি বাতিল করেছি। কিন্তু বাতিল না করে তো ছুটিগুলো এনজয় করতে পারতাম। কিন্তু তা আমরা করিনি।’

সমিতির সম্পাদক রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘কোর্ট খুলে দেয়ার আগে আমরা সমিতি থেকে আইনজীবীদের লোনের ব্যবস্থা করেছি। এখন কোর্ট খুলে দেয়ায় আইনজীবীদের কারো মধ্যে কোনো হাহাকার নেই। আপনাদের উদ্যোগের কারণে এফিডেভিট ও ফাইলিং শাখায় দীর্ঘদিন ধরে যে অব্যবস্থাপনা ছিল সেটা দূর হয়েছে। এ জন্য আমরা কৃতজ্ঞ।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সরকারি চাকরি করলে তো ওই আইনজীবীকে এতদিন অবসরে যেতে হতো। যেহেতু তার বয়স ৬০ পেরিয়ে গেছে তাহলে অবসরে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেই।’

এ সময় আইনজীবী জয়নুল আবেদীন ও মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, ‘অবসরে পাঠালে সে কী করবে? পরিবার পরিজন নিয়ে বিপদে পড়বে। আপনারা তো দয়ার সাগর। ক্ষমা করে দিন।’

আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘দয়ার সাগরের কারণেই তো আমাদের বিচার বিভাগ নিয়ে নানা কথা শুনতে হচ্ছে।’

রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘আপনারা তো সবাই উনাকে চেনেন। ক্ষমা করে দেন।’

আপিল বিভাগের অপর বিচারপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘বিচারে এলে কাউকে চেনার সুযোগ নেই। সবাই আদালতের কাছে সমান।’

সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, ‘উনি যা করেছেন ভুল করেছেন, সতর্ক করে ক্ষমা করে দিন।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এমসিকিউ প্রশ্নপত্রে ভুল থাকায় তা নিয়ে মামলা করার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ওনার মেয়েকে মেডিকেলে পড়ার সুযোগ এবং স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে সুপারিশ করে ১৪ লাখ টাকা আদায় করে দিয়েছি। এখন তো দেখছি বুকের পাটা অনেক বড়। ওনার সাহস অনেক বেড়ে গেছে।’

শুনানি শেষে এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করেন আপিল বিভাগ। ফেসবুকে বিরূপ মন্তব্য করে পোস্ট দেয়ায় আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দকে দোষী সাব্যস্ত করে রায় দেয়া হয়েছে। রায়ে আগামী তিন মাস আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট উভয় বিভাগের মামলা পরিচালনার কাজ থেকে তাকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

একই সঙ্গে তাকে ২৫ হাজার টাকা জরিমানাও করা হয়েছে। জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ডের শাস্তির আদেশ দিয়েছেন সর্বোচ্চ আদালত।

এফএইচ/এফআর/এমএস