আদালত চালুর প্রশ্নে দ্বিধাবিভক্ত আইনজীবীরা
করোনাভাইরাসে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে সাড়ে তিন মাসের বেশি সময় ধরে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সকল আদালতে নিয়মিত কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। তবে জরুরি বিষয়াদি ও জামিন শুনানি চলছে ভার্চুয়াল কোর্টে। কিন্তু অনলাইন প্লাটফর্মে আদালত কার্যক্রমে যুক্ত হতে পেরেছেন মাত্র ১২ থেকে ১৫ শতাংশ আইনজীবী। বাদবাকি আইনজীবীরা এতে মানিয়ে নিতে পারেননি। তারা বিচার কাজের বাইরে থাকায় ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
অনেকের অভিযোগ, এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে না পারার কারণে আর্থিক সংকটে পড়তে হয়েছে সিনিয়র-জুনিয়র ৫০ হাজারের বেশি আইনজীবীকে। এ অবস্থায় আইনজীবীদের বেশিরভাগেরই দাবি, সকল আদালত খুলে দিতে হবে। তবে সেটা প্রচলিত পদ্ধতিতে, নাকি ভার্চুয়ালি খোলা হবে, সে বিষয়ে দ্বিধাবিভক্ত আইনজীবীরা।
অনেক আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশিরভাগ আইনজীবীই কোর্ট চত্বর এলাকায় স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণসাপেক্ষে নিয়মিত আদালত খুলে দেয়ার পক্ষে। এসব দাবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তারা সক্রিয় হচ্ছেন। গত জুন থেকে মাঠেও নেমেছেন কিছু আইনজীবী। সব কোর্ট খুলে দেয়ার দাবিতে প্রধান বিচারপতির কাছে লিখিত আবেদনও করা হয়েছে। এমনকি আদালত খুলে দিতে প্রধান বিচারপতির বাসভবন অভিমুখে পদযাত্রাও হয়েছে।
সূত্রের তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশের আদালতগুলোতে প্রায় ৩৬ লাখের বেশি বিচারাধীন মামলার বিচারকাজ বন্ধ। ফলে ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন লাখ লাখ বিচারপ্রার্থী। প্রচলিত পদ্ধতিতে আদালত খুলে দেয়ার দাবির পক্ষের আইনজীবীরা মনে করেন, এই বিপুলসংখ্যক মামলার বেশিরভাগেরই শুনানিতে আইনজীবীদের সশরীরে উপস্থিতির মাধ্যমে অংশ নিতে হবে। বিশেষ করে দেওয়ানি মামলায় আইনজীবীর উপস্থিতি অত্যাবশ্যক। এ কারণে নিয়মিত আদালত খোলা প্রয়োজন। তাদের বক্তব্য, স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিল্পপ্রতিষ্ঠান, অফিস, পরিবহন, হাট-বাজার চলতে পারলে আদালত চলবে না কেন?
তবে আইনজীবীদের একটি অংশ এখনই প্রচলিত পদ্ধতিতে আদালত খুলে দেয়ার পক্ষে নয়। তারা মনে করেন, সব আদালত ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে খুলে দেয়া যেতে পারে। রাষ্ট্রপক্ষের বেশ কিছু আইনজীবীসহ ভার্চুয়াল কার্যক্রমে পারদর্শী আইনজীবীদের বক্তব্য, জনগণের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে প্রচলিত পদ্ধতিতে আদালত এখনই না খোলা হোক।
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ এম আমিনউদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, আদালত খুলে দেয়ার দাবি সব আইনজীবীর। এই দাবি আমারও। তবে এক্ষেত্রে দেশের বর্তমান অবস্থা, স্বাস্থ্যবিধি এবং সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনা করতে হবে। এসব কিছু সঠিকভাবে মেনে চলা গেলে তবেই নিয়মিত আদালত খুলে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন সংশ্লিষ্টরা।
তিনি বলেন, সরকারি অফিসে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আলাদা কক্ষ থাকে। কিন্তু আদালতে বিচারকাজ চলার সময় আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীসহ সংশ্লিষ্ট অনেক মানুষ উপস্থিত হন। সেক্ষেত্রে যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানা যাবে কি-না, সেটা দেখতে হবে।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অল্প কিছু মামলার বিচার কাজ করা যায়। অনেক আইনজীবী অসুবিধার মধ্যে আছেন, ফিন্যান্সিয়াল। এখানে যেটা দাবি করেছিলাম আইনজীবীদের একটা প্রণোদনা দেয়ার দরকার সরকারের পক্ষ থেকে।
তিনি বলেন, ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ প্রণোদনা সুবিধা পেয়েছেন এবং সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাও সুবিধা পেয়েছেন। কিন্তু আইনজীবীদের কোনো প্রণোদনা দেয়া হয়নি। এই কারণেই আইনজীবীরা দুই-তিন মাস ধরে কোর্ট খুলে দেয়ার জন্য দাবি করছেন। এখনো তো অনেক আইনজীবী ডিজিটাল কার্যক্রমে অভ্যস্ত নন। অতএব তাদের জন্য সীমিত আকারে হলেও কোর্ট খুলে দিলে তারা কাজ করতে পারতেন। আর ভার্চুয়াল কোর্ট তো চলছেই।
এ আইনজীবী বলেন, পুরোপুরি কোর্ট খুলে দিলে কী ভয়াবহ পরিস্থিতি হবে সেটা সবারই জানা আছে। কোর্ট অঙ্গনে এরকম পরিস্থিতি ঘটুক তা আমরা কেউই চাই না। কিন্তু আইনজীবীদের সার্ভাইভালের বিষয়টাও তো দেখতে হবে।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার মো. আব্দুল্লাহ মাহমুদ বাশার জাগো নিউজকে বলেন, যে হারে আক্রান্ত-মৃতের সংখ্যা বাড়ছে, স্বল্প পরিসরেও সরাসরি কোর্ট খুলে দেয়াটা ঠিক হবে না। এখনো আমাদের দেশের মানুষের মন-মানসিকতা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। তাই ভার্চুয়ালি মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা উচিত। এছাড়া আরও বেশ কিছু ভার্চুয়াল কোর্ট বাড়ানো যেতে পারে। সাধারণ অবস্থায় ভার্চুয়ালি চলবে, আর যেসব আইনজীবীর ভার্চুয়াল কার্যক্রমে সমস্যা, তাদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
স্বাভাবিক নিয়মে কোর্ট খুলে দিতে আইনজীবীদের আন্দোলন ও বিক্ষোভ প্রশ্নে তিনি বলেন, শুধু যে আইনজীবীরাই সংকটে আছেন তা নয়। অন্যান্য পেশার মানুষও সংকটে আছেন।
এ বিষয়ে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, নিম্ন আদালত খুলুক আমরাও চাই। আদালত খুললেই তো হলো না, আদালত খোলার আগে বর্তমান পরিবেশের উন্নতি হওয়া চাই। আমরা নিয়মিত আদালত খোলার পক্ষে, কিন্তু সেটি সিকিউরিটি রিস্ককে মিনিমাইজ করে নয়। পরিবেশ পরিস্থিতির আলোকে। আদালত খুলে দেয়ার আগেই সবার স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা দরকার। এ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে আদালত খুলে দিলে জটিলতা আরও বাড়বে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানিয়েছে, আদালত প্রাঙ্গণ অত্যন্ত জনাকীর্ণ। এখানে স্বাস্থ্যবিধি ও সরকারি নির্দেশনা আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীরা কতটা মেনে চলবেন সেটা নিয়ে কর্তৃপক্ষ সন্দিহান। এছাড়া বেশ কয়েকজন বিচারক ও আইনজীবী করোনায় আক্রান্ত। তাই বর্তমান পরিস্থিতিতে আদালত খোলার পর করোনা আক্রান্ত হয়ে যদি কারও মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, সেই দায় কার ঘাড়ে বর্তাবে তা নিয়েও উদ্বিগ্ন সংশ্লিষ্টরা। সেজন্য করোনা পরিস্থিতির উন্নতি না হলে স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থায় ফেরা নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহসাই হচ্ছে না বলে জানাচ্ছে সূত্রটি।
করোনা পরিস্থিতিতে বিচারক, আইনজীবী, বিচারপ্রার্থীরা যেন আক্রান্ত না হন সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি ও হাইকোর্টের প্র্যাকটিস ডাইরেকশন অনুসরণ করে গত ১১ মে থেকে সুপ্রিম কোর্ট ও অধস্তন আদালতে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে বিচার কাজ পরিচালনার নির্দেশনা দেয়া হয়।
ওই নির্দেশনার আলোকে ৩১ মে পর্যন্ত উচ্চ ও নিম্ন আদালতে বিচারকাজ চলছিল। ওই সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ১৫ জুন পর্যন্ত ভার্চুয়াল কোর্টে বিচারকাজ পরিচালনার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এর পর ১৫ জুনই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নির্দেশে ভার্চুয়াল কোর্টের মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য বাড়ানো হয়।
এ সংক্রান্ত সার্কুলারে বলা হয়েছে, করোনা রোধকল্পে ও শারীরিক উপস্থিতি ব্যতিরেকে ১৬ জুন থেকে পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ভার্চুয়াল কোর্টে বিচারকাজ পরিচালনা অব্যাহত থাকবে। এছাড়া রেড জোন এলাকায় অবস্থিত অধস্তন আদালতসমূহ এবং রেড জোনে বসবাসরত আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় লাল অঞ্চলসহ দেশের প্রত্যেকটি জেলায় চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত এবং চিফ মেট্রোপলিটন এলাকায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলার জন্য একাধিক ম্যাজিস্ট্রেট কর্তব্যরত থাকবেন।
প্রচলিত পদ্ধতিতে আদালত খুলে দেয়ার দাবিতে যারা
সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সকল আদালত খুলে দেয়ার দাবিতে জুন মাস থেকে নিয়মিত মানববন্ধন ও সমাবেশ করে যাচ্ছে সাধারণ আইনজীবী পারিষদের ব্যানারে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতি ও ঢাকা আইনজীবী সমিতি। এতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ মেহেদী। এ দাবিতে অ্যাডভোকেট মো. মমতাজ উদ্দীন আহমেদ মেহেদী সংবাদ সম্মেলনও করেন।
তার আগে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনও প্রচলিত পদ্ধতিতে আদালত খুলে দেয়ার দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেন। এরপর একই দাবিতে পৃথকভাবে সংবাদ সম্মেলন করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল।
তার আগে তারা প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের কাছে কোর্টের আইনজীবী ও আগত বিচার প্রার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নীতিমালা করার দাবি জানিয়ে সাত দফা দাবি তুলে ধরেন।
অ্যাডভোকেট মোমতাজ উদ্দিন আহমদ মেহেদী জাগো নিউজকে বলেন, কালক্ষেপণ না করে সুপ্রিম কোর্টসহ দেশের সব আদালতে রেগুলার (নিয়মিত) কোর্ট শুরু করার দাবি জানিয়েছে সাধারণ আইনজীবী পরিষদ। অন্যথায় আগামীতে দেশের সব আদালতে লাগাতার মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ ও আমরণ অনশন কর্মসূচি পালনে আইনজীবীদের প্রতি আহ্বান জানানো হবে।
তিনি বলেন, ১৩ মার্চ থেকে সুপ্রিম কোর্ট এবং ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে রেগুলার কোর্ট না থাকায় বিচারপ্রার্থীরা সাংবিধানিক ও মৌলিক আইনগত অধিকার থেকে বঞ্চিত। ৬০ হাজার আইনজীবীর জীবন-জীবিকা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। ইতোমধ্যে সরকার ভার্চুয়াল বিচার ব্যবস্থা চালু করেছে। দেশের ৯৫ শতাংশ আইনজীবী ভার্চুয়াল কোর্ট সমর্থন করেননি। বড় জোর ৫ শতাংশ আইনজীবী ভার্চুয়াল কোর্টে মামলায় লড়তে সমর্থ হয়েছেন।
এখনই প্রচলিত পদ্ধতিতে ফিরতে একমত নন বিচারপতিরা
তবে এখনই স্বাভাবিক বিচার ব্যবস্থায় ফিরতে একমত নন সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা। সম্প্রতি প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের সভাপতিত্বে একাধিবার ফুলকোর্ট সভায় বসেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা।
সভা সূত্রমতে, বিচারপতিরা বলেছেন—দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের পিক চলছে। অনেক বিচারক, আইনজীবী ও কোর্ট স্টাফ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। অধস্তন আদালতের একজন বিচারক ও একজন কর্মচারী মৃত্যুবরণ করেছেন। এমন পরিস্থিতিতে কোর্ট খুলে দেয়াটা যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ আদালত প্রাঙ্গণ সবসময় জনাকীর্ণ থাকে।
আবার বিচারপ্রার্থীদের দুর্ভোগ লাঘবে কোনো কোনো বিচারপতি সীমিত পরিসরে প্রচলিত পদ্ধতিতে কোর্ট খুলে দেয়ার পক্ষে মতামত দেন। তবে সব বিচারপতি একমত পোষণ না করায় স্বাভাবিক পদ্ধতিতে আপাতত না ফেরার সিদ্ধান্ত হয় ফুলকোর্ট সভায়।
সূত্র জানায়, করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলেই প্রচলিত আদালত খোলার বিষয়ে আবার ফুলকোর্ট সভা আহ্বান করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সভায় আপাতত ভার্চুয়াল কোর্ট চালিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
এফএইচ/এইচএ/এমএস