আইনের বই পড়ে সময় কাটছে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবীদের
বিশ্ব জুড়ে করোনাভাইরাস পরিস্থিতির অবনতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে ব্যাপক সতর্কতামূলক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে চলছে সাধারণ ছুটি। এর প্রভাব পড়েছে বিচারালয়েও। সুপ্রিম কোর্টসহ সারা দেশের আদালতগুলোতে বিচার কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে। এতে জুনিয়র আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের সাময়িক অসুবিধা হলেও দেশের সিনিয়র আইনজীবীরা এ ছুটিকে উপভোগ করছেন। তারা নিজেদের আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে পুরো ছুটিকে কাজে লাগাচ্ছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সারা দেশে ৫০ হাজারেরও বেশি আইনজীবী রয়েছেন। এরমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত আইন পেশায় আছেন পাঁচ হাজারেরও বেশি আইনজীবী। যদিও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য সংখ্যা ৯ হাজারের বেশি। তবে এরমধ্যে কেউ কেউ দেশের বিভিন্ন আদালতে (জেলা আদালত) আইন পেশায় নিয়োজিত। আর যারা সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত তাদের মধ্যে যারা সিনিয়র তাদের এখন সময় কাটছে আইনের বই, দেশ-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলায় দেয়া রায় পড়ে। সিনিয়র আইনজীবীরা দিনের অর্ধেকেরও বেশি সময় পার করছেন বিভিন্ন নথিপত্র ঘেটে আর বই পড়ে। এছাড়া করোনার মধ্যে দেশি-বিদেশি খবর জানতে টিভি দেখা এবং সংবাদপত্র পড়ার পাশাপাশি পরিবারকে সময় দিচ্ছেন তারা।
সুপ্রিম কোর্টর আটজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন যেভাবে কাটছে তাদের সাধারণ ছুটিকালীন সময়।
নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করার সময় পেয়েছি : অ্যাটর্নি জেনারেল
দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে রাষ্ট্র তথা সরকার পক্ষের সব মামলা পরিচালনার দায়িত্ব অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়ের। অ্যাটর্নি জেনারেল, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের পদে থেকে ২২৫ জন আইন কর্মকর্তা রাষ্ট্রপক্ষের মামলা দেখছেন।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, সুপ্রিম কোর্টে পাঁচ লাখের বেশি মামলা বিচারাধীন। এর মধ্যে রাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মামলা দেখার দায়িত্ব তাদের। এর মধ্যে মূল দায়িত্ব রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের ওপর। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই মামলা নিয়েই তাকে থাকতে হয়। দিনভর আদালত থেকে আদালতে ছোটাছুটি করেই সময় যায়। কিন্তু আদালত বন্ধ থাকায় সেই ব্যস্ততা নেই। এখন তার হাতে অফুরন্ত সময়। কিন্তু ৭১ বছর বয়স্ক দেশের এই সিনিয়র আইনজীবী অলসভাবে এই সময় নষ্ট করতে রাজি নন।
এই সিনিয়র আইনজীবী তার অধিকাংশ সময়ই আইনের বই পড়ে এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন আদালতের দেয়া রায় পড়ে সময় পার করছেন।
রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, কোর্ট খোলা থাকার কারণে তো সেভাবে পড়াশুনা করতে পারি না। একটি মামলা ভালোভাবে পরিচালনা করতে পড়াশুনার বিকল্প নেই। কিন্তু প্রতিদিন শতশত মামলার কারণে তা হয়ে ওঠে না। এই ছুটির কারণে নিজেকে ভালোভাবে প্রস্তুত করার সময় পেয়েছি। তাই আইনের বই, বিভিন্ন মামলার রায় পড়ছি।
তিনি বলেন, ব্যস্ত আইনজীবীরা সাধারণত তার পরিবারকে সময় দিতে পারেন না। এই ছুটির কারণে পরিবারকেও সময় দিতে পারছি। এর বাইরে খবর পড়ে ও টিভিতে খবর দেখে সময় পার করছি।
আইনের বই পড়ি, ছাদ বাগান পরিচর্যা করি : জয়নুল আবেদীন
সুপ্রিম কোর্টের আরেক সিনিয়র আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, বিভিন্ন মামলার কারণে সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্টে ব্যস্ত থাকতে হয়। আদালত শেষে সন্ধ্যার পর নিজ চেম্বারে বসা হয়। সেখানে অনেক রাত পর্যন্ত থাকা, মামলা প্রস্তুত করে পরদিন আদালতে যাওয়া-এটাই নিয়মিত রুটিন ছিল। তবে করোনাভাইরাসের কারণে দেশের সব আদালত বন্ধ। এরই অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টও বন্ধ। আদালত বন্ধ তাই সব থেমে যাবার কথা নয়।
তিনি বলেন, আইনজীবীদের আইনের বই পড়েই নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। ছুটি হওয়ার কারণে নিজেকে প্রস্তুতের জন্য সময় পেয়েছি। তাই আইনের বই পড়ে সময় কাটছে। এর বাইরে কিছু সময় নিজের ছাদ বাগানও পরিচর্যা করি। আর কিছু সময় ইবাদত-বন্দেগি করে। এছাড়াও অনেক আইনজীবী ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করে সময় কাটছে।
আইনজীবীদের প্রধান শক্তি হলো লেখাপড়া : এ এম আমিন উদ্দিন
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট এ এম আমিন উদ্দিন বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে জনসমাগম স্থানে যাওয়া ঠিক না। তাই অধিকাংশ সময়টা কাটছে ঘরের মধ্যে। এই সময়ে আইনের বই পড়ি। আইনজীবীদের প্রধান শক্তি হলো লেখাপড়া করা। এর বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, আদালত খোলা থাকলে সেভাবে পরিবারকে সময় দেয়া হয় না। এখন পরিবারকে অনেক সময় দিচ্ছি। ফোনে আইনজীবী, আত্মীয়স্বজন, ক্লায়েন্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সময় যাচ্ছে।
যেসব মামলায় হেরেছি তা পর্যালোচনা করছি : খুরশীদ আলম খান
সুপ্রিম কোর্টের দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান বলেন, প্রতিদিন চেম্বারে যাচ্ছি। দিনভর আইনের বই পড়ি। ভারতে দুর্নীতি মামলায় কি রায় দিচ্ছে তা দেখি। আর আমাদের আদালতে দুদকের যেসব মামলায় হেরে গেছি, সেসব মামলার রায় ও আদেশ দেখছি। কেনো হারলাম, তা পর্যালোচনা করে ভবিষ্যতে মামলায় শুনানির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করছি।
তিনি বলেন, এর বাইরে টিআইবি গত ২০ বছরে যেসব প্রতিবেদন দিয়েছে, তা পর্যালোচনা করছি। ভবিষ্যতে টিআইবি যত প্রতিবেদন দেবে তার প্রতিক্রিয়া দেয়ার জন্য নিজেকে তৈরি করছি।
গৃহের কাজে সময় দিচ্ছি : এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক বলেন, সর্বশেষ গত ১৮ মার্চ কোর্টে গিয়েছিলাম, পরের দিন ১৯ মার্চ থেকে ঘরেই বের হচ্ছি না। পরিবার পরিজন নিয়ে কাটছে। মহান স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চও আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করতে পারিনি। বসায় বই পড়ছি। গৃহের কাজে সময় দিচ্ছি। টিভি দেখছি। মামলার কিছু ফাইল বাসায় নিয়ে এসেছি। সেগুলো নড়াচড়া করেই সময় পার করছি।
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী যেভাবে আক্রমণ করেছে তাতে ঘরে বসে থাকাই লাভ। আমাদেন প্রধানমন্ত্রীও ঘরে বসে থাকার জন্য বলেছেন। সাধারণ ছুটি শেষে কোর্টে যাব আশা করছি।
আরেক ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ বলেন, গৃহে থেকে মনে হচ্ছে জেলে আছি। কখনো জেলে যাইনি। কিন্তু করোনাভাইরাস ঘরে বসে মোকাবেলা করতে জেলের কষ্টটা বুঝতে পারছি।
তিনি বলেন, দুর্বিষহ মনে হচ্ছে। বাইরে না যেতে পেরে অলস সময় কাটতে চাইছে না, বোরিং লাগছে। সবই করছি করোনাভাইরাস থেকে সাবধানে থাকার জন্য। আশা করছি সমস্যা অনেক কমে আসবে আল্লার রহমতে।
গত ২১ মার্চ থেকে বাইরে বের হচ্ছেন না ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়। তিনি বলেন, আমি ঘরবন্দী হয়ে আছি। সময কাটছে বই পড়ে। সুপ্রিম কোর্টের সব কিছুই বন্ধ। সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।
এখন পড়ার ভালো সুযোগ পেয়েছি উল্লেখ করে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ফজলুর রহমান খান বলেন, করোনাভাইরাসকে কেন্দ্র করে বাসায় বই পড়ছি। বিভিন্ন মামলার রেফারেন্স দেখছি। ঘাটাঘাটি করছি বিভিন্ন আইন নিয়ে। আমার বাসায় লাইব্রেরি আছে। এখানে অনেক বই রেখেছি। আইনের বইসহ অন্যান্য বইও। এই মুহূর্তে আমি আরব জাতির ইতিহাস নামে একটি বই পড়ছি। সময় পেলেই আমি বই পড়ি। আমার বই পড়ার অভ্যাস অনেক আগে থেকেই।
এফএইচ/এমএফ/পিআর