আদালতের কার্যক্রম সীমিত করতে প্রধান বিচারপতির প্রতি আহ্বান
নভেল করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিস্তাররোধে ব্যাপক জনসমাগম এড়ানোর লক্ষ্যে অধস্তন আদালতগুলোতে কার্যক্রম সীমিত পরিসরে চলমান রেখে অবশিষ্ট সব কার্যক্রম মুলতবি রাখার জন্য প্রধান বিচারপতির প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ আইন সমিতি।
শনিবার (২১ মার্চ) সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার সাজ্জাদ হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক কেশব রায় চৌধুরী এক বিবৃতিতে এ আহ্বান জানান।
প্রধান বিচারপতির উদ্দেশে করা আহ্বানটি তুলে ধরা হলো-
“বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক বৈশ্বিক মহামারি হিসাবে স্বীকৃত নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ এড়াতে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে আপনার সময়োচিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ফলস্বরূপ গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা (প্রশাসন শাখা) কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিমূলে দেশের অধস্তন আদালতসমূহে আসামিদের জামিন শুনানিকালে এবং মামলার অন্যান্য কার্যক্রমে কারাবন্দি-আসামিদের আদালতে হাজির না করা এবং এরূপ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে মামলার কার্যক্রম মুলতবি করার নির্দেশ প্রদানের জন্য বাংলাদেশ আইন সমিতির পক্ষ থেকে আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করছি।
আপনি নিশ্চয়ই অবগত আছেন যে, গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান প্রদেশে শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসে সারাবিশ্বে আড়াই লাখ লোক আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে ১১ হাজারের বেশি লোকের প্রাণহানি হয়েছে এবং প্রতিদিনই এই আক্রান্ত ও প্রাণহানির সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এমনই এক আতঙ্কজনক অবস্থায় গতকাল ২০ মার্চ জাতিসংঘ ঘোষিত এক সতর্কবার্তায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু হবে। এর আগে গত ১৭ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক প্রতিবেদনে ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এক কঠিন সর্তকবার্তায় বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর প্রতি কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। উক্ত প্রতিবেদনে সামাজিকভাবে মানুষ থেকে দূরে থাকা তথা জনসমাগম নিয়ন্ত্রণের ওপর অতিরিক্ত গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া নানা বিশেষজ্ঞ মহল থেকে সামনের দুই বা তিন সপ্তাহকে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে সতর্কবার্তা দেয়া হচ্ছে।
আপনি এও অবগত আছেন যে, জাতিসংঘ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এরূপ সতর্কবার্তা এবং বাংলাদেশে এ পর্যন্ত নিশ্চিতভাবে ২৪ জনের করোনাভাইরাস শনাক্ত-সহ দুজনের মৃত্যুর ঘটনার পর এদেশে ব্যাপক হারে এই ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা করা হচ্ছে এবং জনমনে ভয়াবহ আতঙ্ক বিরাজ করছে। ব্যাপক জনসমাগম এড়ানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে; সব ধরনের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে এবং সকল বিনোদন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে। তাছাড়া মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলা ‘লকডাউন’ ঘোষণা করা হয়েছে। পুরো মাদারীপুর ও ফরিদপুর জেলা-সহ প্রয়োজনে আরও এলাকা ‘লকডাউন’ করা হতে পারে মর্মে সরকারের পক্ষ থেকে আগাম ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু কিছু জেলা থেকে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এরূপে একের পর এক ঘোষণা বা কার্যক্রমের মাধ্যমে সরকারের পক্ষ থেকে মূলত করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবরোধে বিভিন্ন স্থানে জনসমাগম এড়ানোর প্রচেষ্টাই করা হচ্ছে।
আপনার সময়োচিত পদক্ষেপের ফলে গত ১৯ মার্চ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা (প্রশাসন শাখা) কর্তৃক প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিমূলে জারিকৃত নির্দেশও নিশ্চয়ই জনসমাগম এড়ানোর লক্ষ্যেই করা হয়েছে বলে আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু দেশের অধস্তন আদালতসমূহে প্রতিদিন যে সংখ্যক কারাবন্দি-আসামিদের কারাগার থেকে আদালতে উপস্থাপন করা হয় তা তুল্যবিচারে খুবই নগন্য। বরং উক্ত আদালতসমূহে প্রতিদিন যে বিপুলসংখ্যক বিচারপ্রার্থী-জনগণ ও আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের জনসমাগম হয়, তার সংখ্যা কারাবন্দি-আসামিদের তুলনায় কয়েকশ’ গুণ বেশি। আর ঢাকা ও চট্টগ্রামের অধস্তন আদালতসমূহে তো প্রতিদিন লক্ষাধিক লোকের জনসমাগম হয়, যা এই মুহূর্তে আদালতসংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই বড় উদ্বেগের বিষয়।
এই নজিরবিহীন সংকটাপন্ন মুহূর্তে কেবলমাত্র কিছুসংখ্যক কারাবন্দি-আসামিকে আদালতে উপস্থাপন না করার নির্দেশনাই অধস্তন আদালতসমূহে ব্যাপক জনসমাগম এড়ানোর একমাত্র মোক্ষম পদক্ষেপ হতে পারে না; বরঞ্চ অবিলম্বে আপাতত কমপক্ষে পরবর্তী দুই সপ্তাহের জন্য কেবল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহে জামিন ও রিমান্ড শুনানির মতো অপরিহার্য বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে অধস্তন আদালতসমূহের কার্যক্রম চলমান রেখে অবশিষ্ট সকল কার্যক্রম মুলতবি করার পদক্ষেপ নেয়ার মাধ্যমেই অধস্তন আদালতসমূহে ব্যাপক জনসমাগম এড়ানো যেতে পারে- যা করোনাভাইরাসের গোষ্ঠীগত সংক্রমণরোধে এই মুহূর্তে বিচার বিভাগের পক্ষ থেকে একটা জুতসই ও যথোপযুক্ত পদক্ষেপ হবে বলে আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
সমগ্র বিশ্বের পাশাপাশি বাংলাদেশের মানুষ আজ এক ভয়াবহ বৈশ্বিক মহামারির সম্মুখীন। এমতাবস্থায় কোনোভাবেই এরূপ সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে বিন্দুমাত্রও বিলম্বের অবকাশ নেই। নচেৎ খুব অল্প সময়ের মধ্যে গোষ্ঠী-সংক্রমণের মাধ্যমে এই ভাইরাসের ব্যাপক প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধের আর কোনো সুযোগ থাকবে না বাংলাদেশে; আর তাতে অনিবার্যরূপে আমরা ইতালি, স্পেন বা আমেরিকার চেয়েও ভয়ানক সংকটাপন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হব শিগগির।
এমতাবস্থায় আমরা বাংলাদেশ আইন সমিতির পক্ষ থেকে এই মুহূর্তে কমপক্ষে পরবর্তী দুই সপ্তাহের জন্য কেবল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতসমূহে জামিন ও রিমান্ড শুনানির মতো অপরিহার্য বিষয়সমূহের ক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে অধস্তন আদালতসমূহের কার্যক্রম চলমান রেখে অবশিষ্ট সকল কার্যক্রম মুলতবি রাখার নির্দেশনা প্রদানের জন্য আপনাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ ও উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।”
জেএ/এইচএ/এমকেএইচ