‘ওই যে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ওসি মোয়াজ্জেম’
আসামির কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন। অপরদিকে সাক্ষীর কাঠগড়ায় ব্যারিস্টার সুমন। সাক্ষ্য দেয়ার একপর্যায়ে ব্যারিস্টার সুমন বলেন, ‘ওই যে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ওসি মোয়াজ্জেম।’
বুধবার (৩১ জুলাই) বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত বিচারক শেখ নাজমুল আলমের আদালতে সাক্ষ্য দেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। তিনি ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফির বক্তব্য ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার অভিযোগে সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ মামলাটি করেন।
ব্যারিস্টার সায়েদুল হক সুমন ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে আজ সাক্ষ্য দেন। সাক্ষ্য দেয়ার এক পর্যায়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী নজরুল ইসলাম শামীম ব্যারিস্টার সুমনকে প্রশ্ন করেন, ‘আপনি কি ওসি মোয়াজ্জেমকে চেনেন?’তখন ওসি মোয়াজ্জেমের দিকে তাকিয়ে সুমন বলেন, ‘ওই যে, কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছেন তিনি।‘সুমনের কথা শুনে ওসি মোয়াজ্জেম হেসে বলেন, ‘আপনি কি কখনো আমাকে দেখেছেন।’
ব্যারিস্টার সুমন সাক্ষ্যতে বলেন, ‘আমি এ মামলার বাদী। আসামি ওসি মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে এ মামলাটি দায়ের করেছি। তিনি সোনাগাজীর ওসি থাকাকালীন ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফি নামে একজন মাদরাসাছাত্রীর সঙ্গে মাদরাসার অভ্যন্তরে অধ্যক্ষ সিরাজের শ্লীলতাহানির অভিযোগ উঠলে রাফি ও অধ্যক্ষকে থানায় নিয়ে আসেন। এরপর রাফিকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে আইনবহির্ভূত ভিডিও ধারণ করেন। এ ভিডিও পরবর্তীতে ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়া হয়। ১১ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় আমার কর্মস্থলে ভিডিওটি দেখতে পাই। ভিডিওতে দেখতে পাই ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন রাফিকে জেরা করতে করতে অনেক অশ্লীল, আপত্তিকর, মানহানিকর প্রশ্ন করতে থাকেন। এরপর ৬ এপ্রিল রাফি অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করার অস্বীকৃতি জানালে চার থেকে পাঁচজন মুখোশপরা মানুষ তার শরীরে আগুন দেয়। এরপর ১০ এপ্রিল তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে মারা যান। তার মৃত্যুর সঙ্গে মোয়াজ্জেমের ধারণ করা ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে এবং সামাজির অস্থিরতা তৈরি হয়। এমনকি আইনশৃঙ্খলা অবনতির সম্ভবনা দেখা দেয়।
সাক্ষ্য শেষে তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ। এদিন তার জেরা শেষ না হওয়ায় পরবর্তী জেরার জন্য ২০ আগস্ট দিন ধার্য করেন আদালত।
এর আগে ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। এ সময় তার আইনজীবী ফারুক হোসেন সাক্ষ্যগ্রহণ মুলতবি রাখার আবেদন করেন। তিনি শুনানিতে বলেন, ‘আমরা অভিযোগ গঠনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাব। তাই আমাদের সময় দেয়া হোক।’ তবে বিচারক তাদের সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু করেন।
১৭ জুলাই বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস সামশ জগলুল হোসেন আসামি সোনাগাজী মডেল থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ৩১ জুলাই দিন ধার্য করেন। অভিযোগ গঠনের ফলে ওইদিন থেকেই মামলার আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু হয়।
এর আগে ১০ জুলাই মামলার অভিযোগ গঠন শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার থেকে আসামিকে আদালতে হাজির না করায় অভিযোগ গঠন শুনানি পেছানোর আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। বিচারক সময় আবেদন মঞ্জুর করে ১৭ জুলাই অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য নতুন দিন ধার্য করেন।
আসামির আইনজীবী আদালতে আরও দুটি আবেদন করেন। প্রথমত, তিনি এজলাসে পুলিশের উপস্থিতিতে আসামির সঙ্গে আইনজীবীদের প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলার সুযোগ চান। দ্বিতীয়ত, মামলার আরজিতে বর্ণিত (সংযুক্ত) পেনড্রাইভের কপির জন্য আবেদন করেন। আদালত পেনড্রাইভের কপি সংযুক্তির আবেদন মঞ্জুর করলেও এজলাসে কথা বলার আবেদন মঞ্জুর করেননি।
গত ২৪ জুন জেল কোড অনুযায়ী, ওসি মোয়াজ্জেমের ডিভিশনের বিষয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন আদালত। ১৭ জুন বাংলাদেশ সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ আস শামস জগলুল হোসেন ওসি মোয়াজ্জেমের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। এর আগে ১৬ জুন রাজধানীর শাহবাগ থেকে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ।
১৫ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (প্রত্যাহার হওয়া) মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন করেন ব্যারিস্টার সৈয়দ সায়েদুল হক সুমন। আদালত তার জবানবন্দি নিয়ে ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮’ এর ২৬, ২৯ ও ৩১ ধারায় করা অভিযোগটি পিটিশন মামলা হিসেবে গ্রহণ করেন। পরে এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেন আদালত।
গত ২৭ মার্চ নুসরাত জাহান রাফিকে মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা শ্রেণিকক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়ন করেন। এমন অভিযোগ উঠলে দু’জনকে থানায় নিয়ে যান ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন। ওসি নিয়ম ভেঙে জেরা করার সময় নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেন। মৌখিক অভিযোগ নেয়ার সময় দুই পুরুষের কণ্ঠ শোনা গেলেও সেখানে নুসরাত ছাড়া অন্য কোনো নারী বা তার আইনজীবী ছিলেন না। ভিডিওটি প্রকাশ হলে অধ্যক্ষ ও তার সহযোগীদের সঙ্গে ওসির সখ্যতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, থানার ওসির সামনে অঝোরে কাঁদছেন নুসরাত। নুসরাত তার মুখ দুই হাতে ঢেকে রেখেছিলেন। তাতেও ওসির আপত্তি। বারবারই ‘মুখ থেকে হাত সরাও, কান্না থামাও’ বলার পাশাপাশি তিনি এও বলেন, ‘এমন কিছু হয়নি যে এখনো তোমাকে কাঁদতে হবে।’
মামলায় অভিযোগ করা হয়, ওসি মোয়াজ্জেম অনুমতি ছাড়া নিয়মবহির্ভূতভাবে নুসরাতকে জেরা এবং তা ভিডিও করেন। পরবর্তীতে ওই ভিডিও ফেসবুক ও ইউটিউবসহ বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ভিডিওতে দেখা যায়, ওসি মোয়াজ্জেম অত্যন্ত অপমানজনক ও আপত্তিকর ভাষায় নুসরাতকে একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছেন। নুসরাতের বুকে হাত দিয়ে শ্লীলতাহানি করা হয়েছে কি না- এমন প্রশ্নও করতে শোনা যায় ওসি মোয়াজ্জেমকে।
অধ্যক্ষের নিপীড়নের ঘটনায় রাফির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। এরপর গত ৬ এপ্রিল সকালে নুসরাত পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় যান। এ সময় মাদরাসার এক ছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে -এমন সংবাদ দিলে তিনি ওই বিল্ডিংয়ের চার তলায় যান। সেখানে মুখোশপরা চার-পাঁচজন তাকে অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে মামলা ও অভিযোগ তুলে নিতে চাপ দেয়। নুসরাত অস্বীকৃতি জানালে তারা তার গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়।
পরে গত ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত।
জেএ/এসআর/এমএস