তারেকের এপিএস অপুর অর্থায়নে চার কোম্পানির ৫ পরিচালকের বিষয়ে রুল
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মিয়া নুর উদ্দিন অপুর অর্থায়নে বেনামে প্রতিষ্ঠিত চার কোম্পানির মনোনীত পাঁচ পরিচালকের কার্যক্রম তদন্ত করে ফাস্র্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড থেকে কেন অব্যাহতি দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে, মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কোম্পানির পরিচালক থেকে অপসারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে করা আবেদন নিষ্পত্তি করতে সংশ্লিষ্টদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা-ও জানতে চেয়েছেন আদালত। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিবাদীদেরকে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
যে চার কোম্পানির পরিচালকদের বিষয়ে অভিযোগ আনা হয়েছে সেগুলো হলো-আলফাবেট অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, অপারচর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, রাকাস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও কাসরাজ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড।
রুল জারির বিষয়টি নিশ্চিত করে ব্যারিস্টার সিদ্দিকুর রহমান খান সাংবাদিকদের জানান, এ আদেশের কারণে সংশ্লিষ্ট পাঁচ পরিচালকের ফাস্র্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের বোর্ড মিটিংয়ে অংশ নেওয়া উচিত হবে না।
মো. মনিরুজ্জামান নামের এক শেয়ারহোল্ডারের আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
আদালতে আজ আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ, অ্যাডভোকেট এম কে রহমান ও ব্যারিস্টার এ বি এম সিদ্দিকুর রহমান খান।
গত ২ জুলাই মানি লন্ডারিংয়ের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের কোম্পানির পরিচালক থেকে অপসারণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি আবেদন করেন ফার্স্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের পরিচালক মো. মনিরুজ্জামান। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
‘তারেক ঘনিষ্ঠ অপুর দুর্নীতির আরো তথ্য’ শিরোনামে গত ২৭ জুন একটি জাতীয় দৈনিকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। একই ঘটনায় আরও দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদন সংযুক্ত করে হাইকোর্টে রিট করেন মো. মনিরুজ্জামান। ওই আবেদন শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট আজ এই আদেশ দেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, বিভিন্ন বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৩৪০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগে গ্রেফতার মিয়া নুরুদ্দিন অপুর দুর্নীতি অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসছে আরও নতুন তথ্য। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সাবেক এপিএস অপুকে জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) এসব তথ্য জানতে পারে।
২০১৭ সালের জুন-জুলাই মাসে অপু আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফাস্র্ট ফাইন্যান্স লিমিটেডের শেয়ার কেনার আগ্রহ প্রকাশ করলে তখনকার মালিকপক্ষ তাদের চারটি কোম্পানির নামে থাকা ২৭ শতাংশ শেয়ার বিক্রির বিষয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। ওই চারটি কোম্পানি হলো-অপারচর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড, আলফাবেট অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড, রাকাস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড ও কাসরাজ ট্রেডিং লিমিটেড। এর মধ্যে আলফাবেট অ্যাসোসিয়েট লিমিটেডের নামে ৫৬ লাখ ৭০ হাজার ৫৮৮টি শেয়ার, অপারচর ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ৮৩ লাখ ২১ হাজার ৫২০টি শেয়ার, রাকাস ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেডের নামে ৫৭ লাখ ৯৪ হাজার ৭৯৬টি এবং কাসরাজ ট্রেডিং লিমিটেডের নামে ১ কোটি ১৬ লাখ ২১ হাজার ৬৫৬টি শেয়ার থাকা অবস্থায় চুক্তিটি স্বাক্ষরিত হয়। পরে জয়েন্ট ভেঞ্চার কোম্পানির নিয়মানুযায়ী কোম্পানিগুলোর মালিকানা পরিবর্তন করা হয়। কিন্তু কোম্পানিগুলোর ইনকাম ট্যাক্স ফাইল নবায়ন না করে মালিকানা পরিবর্তন করা হয়।
কোম্পানিগুলোর পরিচালকদের সবাই একই ব্যক্তি এবং অপুর অফিসের কর্মচারী। কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনতে ৪০ কোটি ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হয়। অথচ কোম্পানিগুলোর এই নতুন পরিচালকদের টিআইএন নম্বর নেই। এ অবস্থায় ট্যাক্স ফাইল না থাকায় তারা ৪০ কোটি টাকার বেশি কোথায় পেলেন তা তদন্তে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা বিশেষ পুলিশ সুপার মোল্লাহ নজরুল ইসলাম জানান।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রের বরাত দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, কোম্পানিগুলোর এই নতুন পরিচালকরা ফাস্র্ট ফাইন্যান্স মনোনীত পরিচালক ছিলেন না। তাদের মধ্যে অপু তার ঘনিষ্ঠ রাশেদুজ্জামান মিল্লাত, আমিনুল ইসলাম, জালাল উদ্দিন, মহিন ও মইনুল হাসানকে নিয়োগ দেন। তাদের মধ্যে আমিনুল ইসলাম এবং মাইনুল হাসান স্বতন্ত্র পরিচালক হন। অন্য চারজন তার কোম্পানি মনোনীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। আর পরিচালনা বোর্ড পরিবর্তন করে অপু চেয়ারম্যান হিসেবে মনোনীত হন।
মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ফার্স্ট ফাইন্যান্সের মতো একটি পুরনো আর্থিক প্রতিষ্ঠানে এত দুর্নীতি হয়েছে, মামলার তদন্ত না করলে বুঝতেই পারতাম না। এ রকম একটি লাভজনক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ২০১৭ সালে ২৪ কোটি টাকার বেশি লোকসান দেয়। কারণ হিসেবে দেখা যায়, বেশি বেতনে নতুন কর্মকর্তা নিয়োগ এবং নতুন আমানত আনার ক্ষেত্রে কমিশন প্রদানের নামে বিপুল অংকের টাকা উত্তোলন করে সরিয়ে নেওয়া। ২০১৮ সালেও ফাস্র্ট ফাইন্যান্স লিমিটেড ৪৭ কোটি টাকার বেশি লোকসান দেয়। আর ২০১৯ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ৮৭ কোটি টাকা সরিয়ে নেওয়া হয়। অথচ কোম্পানিটির প্রায় ৭০০ কোটি টাকার আমানত রয়েছে। অপুর শেয়ার ছাড়া কোম্পানিটির প্রায় এক লাখ বিনিয়োগকারীর কাছে রয়েছে ৭৩ শতাংশ শেয়ার।’
এফএইচ/এসআর/পিআর