সাঈদী-মুজাহিদ ও সাকার রায় প্রকাশের অপেক্ষা
একাত্তরে সংঘটিত নির্যাতন, আটক, হত্যা, গণহত্যা, ধর্মান্তর, জোরপূর্বক দেশান্তর করাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালের দেয়া দণ্ডের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে ৫টি মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হলেও এখন পর্যন্ত তিনটি মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়নি।
অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় আশা করছে শিগগিরই দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ও আলী আহসান মুজাহিদ এর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রাকাশিত হতে পারে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর নিয়ম অনুযায়ী রিভিউ করা হবে। তবে মুজাহিদের পক্ষে রিভিউ আবেদন করা হলেও সাঈদীর বিরুদ্ধে রিভিউ করা হতে পারে বলে রাষ্ট্রপক্ষের একটি সূত্রে জানা গেছে।
জামায়াতের নায়েবে আমির দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর আপিলের রায় ঘোষণা করা হয় ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর, দলের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের রায় ঘোষণা করা হয় চলতি বছরের ১৬ জুন আর সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীর আপিলের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করা হয় ২৯ জুলাই।
এর আগে জামায়াতের দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লা ও মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মামলার চূড়ান্ত আপিল নিষ্পত্তি শেষে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। বর্তমানে নিজামী-মীর কাসেমসহ আরো ৮টি মামলা আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
তাদের মধ্যে সবার আগে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মামলায় আপিল শুনানি শুরু হতে পারে। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে মীর কাসেম আলী ও এটিএম আজহারুল ইসলামের আপিল শুনানি হতে পারে।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় শিগগিরিই পাওয়া যাবে বলে আশা করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তিনি বলেন, অচিরেই মুজাহিদের রায় পাবো। কারণ ঐকমত্যের ভিত্তিতে আপিল বিভাগের বিচারকগণ মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা করেছেন। যেহেতু ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ রায় হয়েছে সেহেতু একজন বিচারক রায় লিখবেন। অন্য বিচারকদের ভিন্নমত পোষণ করে রায় লেখার সুযোগ নেই। সেই হিসেবে আমার অনুমান শিগগিরই পাওয়া যাবে।
অন্যদিকে সাঈদীর মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ও শিগহিরই বের হতে পাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী :
মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা সাঈদীকে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আমৃত্যুকারাদণ্ড দিয়েছেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের করা দুটি আপিল সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতে আংশিক মঞ্জুর করে এ রায় দেয়া হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বাধীন পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ ঐ রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা (বর্তমানে প্রধান বিচারপতি), বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন চেয়ারম্যান বিচারপতি এটিএম ফজলে কবিরের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল-১ সাঈদীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন। ট্রাইব্যুনালের অন্য দুই সদস্য ছিলেন- বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক ।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ :
মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল থেকে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াত নেতা আলবদর কমান্ডার বুদ্ধিজীবী হত্যার মাস্টার মাইন্ড আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন আপিল বিভাগ। চলতি বছরের ১৬ জুন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ রায় ঘোষণা করেন। বাংলাদেশকে মেধাশূন্য করার চেষ্টায় বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে মুজাহিদের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়।
বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। বুদ্ধিজীবী হত্যায় এটাই আপিল বিভাগের প্রথম রায়।
উল্লেখ্য, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান শাহীনের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আলী আহাসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মুত্যুদণ্ড প্রদান করেন। এই প্রথম বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব পালন করা কোনো ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড উচ্চ আদালত বহাল রাখলেন।
আপিল বিভাগের রায়ে অভিযোগ-১ এ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনকে অপহরণ ও হত্যার দায়ে আসামি মুজাহিদকে খালাস দিয়েছেন। অভিযোগ-২ এ ট্রাইব্যুনালের দেয়া ৫ বছরের সাজা বহাল রেখেছেন। অভিযোগ-৫ এ বদি রুমিসহ অন্যান্যদের হত্যার ঘটনায় ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড বহাল রেখেছেন।
অভিযোগ-৬ এ ট্রাইব্যুনালের দেয়া বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। অন্যদিকে অভিযোগ-৭ এ বকচর হত্যাকাণ্ডে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করাদণ্ড প্রদান করা হয়েছে।
২০১৩ সালের ১৭ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ মুজাহিদের বিরুদ্ধে ৭টি অভিযোগের মধ্যে ২টি অভিযোগ (২ ও ৪) প্রমাণিত না হওয়ায় অভিযোগের দায় থেকে তাকে খালাস দেন।
অন্যদিকে ৫টি অভিযোগ (১, ৩, ৫, ৬ ও ৭) সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল তাকে ৩ নং অভিযোগে ৫ বছর ও ৫ নং অভিযোগ যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান করেন। ৬ ও ৭ নং অভিযোগে মুজাহিদকে মুত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ১ নং অভিযোগটি ৬নং অভিযোগের সাথে একীভূত করায় ১ নং অভিযোগে পৃথক কোনো দণ্ড দেয়নি ট্রাইব্যুনাল।
বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী :
মানবতাবিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক হত্যা ও গণহত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া বিএনপির শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন কাদের বাহিনীর (নিজস্ব বাহিনী) প্রধান স্বঘোষিত ব্রিগেডিয়ার সালাউদ্দিন কাদের (সাকা) চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। চলতি বছরের ২৯ জুলাই প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চ ঐতিহাসিক এই মামলার রায় ঘোষণা করেন।
বেঞ্চের অন্য সদস্যরা ছিলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। ৭ নম্বর অভিযোগ থেকে আসামি সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে খালাস দেওয়া হয়। ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৮, ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে সাজা বহাল রাখা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২০১৩ সালের ১ অক্টোবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১-এ সাকা চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা ২৩টি অভিযোগের মধ্যে নয়টি প্রমাণিত হয়। ৩, ৫, ৬ ও ৮ নম্বর অভিযোগে সাকাকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ তা বহাল রাখেন। ৭ নম্বর অভিযোগে সাকা চৌধুরীকে ২০ বছর কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। এই অভিযোগ থেকে আসামিকে খালাস দিয়েছেন আপিল বিভাগ। ২ ও ৪ নং অভিযোগে সাকাকে ট্রাইব্যুনাল ২০ বছরের কারাদণ্ড প্রদান করেন। সেটা আপিল বিভাগও বহাল রেখেছেন। অন্যদিকে ১৭ ও ১৮ নম্বর অভিযোগে সাকাকে ৫ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। আপিল বিভাগ একই কারাদণ্ড বহাল রাখেন।
আপিলে আরো ৮ মামলা বিচারাধীন : বর্তমানে আপিল বিভগে আরো ৮টি মামলায় ৯ জনের আপিল নিষ্পত্তির জন্য বিচারের অপেক্ষায় আছে। যার মধ্যে রয়েছে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, জামায়াতের নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর কাসেম আলী, আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত মোবারক হোসেন, জাতীয় পার্টির সাবেক মন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সার আহমদ, জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম, জাতীয় পার্টির নেতা (পলাতক) আব্দুল জব্বার (রাষ্ট্রপক্ষ) জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির আব্দুস সুবহান ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের মাহিদুর রহমান ।
এফএইচ/এসএইচএস/এমএস