কোচিং বাণিজ্য বন্ধ : হাইকোর্ট
কোচিং বাণিজ্য বন্ধে সরকারের নীতিমালা বৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। এই রায়ের ফলে দেশের সকল সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং অন্যান্য সকল প্রতিষ্ঠানে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মোখলেসুর রহমান।
আইনজীবী জানান, সরকারি নীতিমালার বাইরে সব ধরনের কোচিং বাণিজ্য বেআইনি ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে কোচিং বাণিজ্য বন্ধে ২০১২ সালে সরকারের জারিকৃত নীতিমালাকে বৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। আদালত বলেছেন, জনগণের কল্যাণের জন্য যে কোনো সময় যে কোনো ধরনের নীতিমালার, নির্দেশিকার ও পরিপত্র জারির ক্ষমতা সরকারের রয়েছে।
বৃহস্পতিবার হাইকোর্টের বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই রায় ঘোষণা করেন।
এর আগে গত ২৭ জানুয়ারি কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা ও এর সঙ্গে জড়িত শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া প্রশ্নে জারি করা রুলের শুনানি শেষ করা হয়। ওই রুলের ওপর রায় ঘোষণা করেন আদালত।
আদালতে দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশিদ আলম খান। এক রিটকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর এবং অ্যাডভোকেট মো. নাসিরুদ্দিন। অ্যামিকাসকিউরি ছিলেন অ্যাডভোকেট ফিদা এম কামাল।
কোচিং বাণিজ্যের অভিযোগে মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা নেয়া হবে না, সেজন্য সরকার ২০১৮ সালে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে। দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে এ নোটিশ দেয় সরকার।
এসব নোটিশ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকের কোচিং বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালা-২০১২ নিয়ে শিক্ষকরা হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। আদালত ওই রিটের শুনানি নিয়ে ২০১৮ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ওই চিঠির কার্যকারিতা চার মাসের জন্য স্থগিত করেন। পাশাপাশি রুল জারি করেন আদালত।
ওই আদেশের বিরুদ্ধে দুদক ও রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আপিল করার অনুমতি চেয়ে লিভ টু আপিল করে। ওই আপিল আবেদনের ওপর শুনানি শেষে আপিল বিভাগ ২০১৮ সালের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চকে এ রুলের নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দিয়েছিল। পরে ২৭ জানুয়ারি রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষ হয়। ৭ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে রায় ঘোষণা করা হয়।
আইনজীবী জানান, রায়ে কোচিং বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত বেশকিছু শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে সরকারকে চিঠি দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ওই চিঠির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে সরকারি ও বেসরকারি কয়েকজন শিক্ষকের করা রিট আবেদনের উপরও আজ রায় ঘোষণা করেছেন আদালত।
রায়ে আদালত বলেছেন, দুদকের কাজ সরকারি প্রতিষ্ঠান, আদালত প্রাঙ্গণ, ভূমি, কাস্টমসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেখানে অনুসন্ধান ও তদন্ত করা।
সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকরা ক্লাসে উপস্থিত আছে কী নেই এ ধরনের কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নজর দিলে বড় দুর্নীতির বিষয়গুলো হারিয়ে যাবে। তবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নজরদারিতে তাদের আইনগত কোনো বাধা নেই। দণ্ডবিধির ১৬৬ ধারা অনুযায়ী নজরদারির এখতিয়ার দুদকের। তবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে নজরদারির বিষয় আইন অনুমোদন করে না।
রায়ের বিষয়ে আইনজীবী আরো জানান, সরকারি-বেসরকারি স্কুল, কলেজ, মাদরাসা ও কারিগরি ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কোচিং বাণিজ্য বন্ধ নীতিমালা-২০১২’ কার্যকর হতে যাচ্ছে।
২০১২ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জারি করা ওই নীতিমালায় বলা হয়, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ জন শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান প্রধানকে ছাত্র-ছাত্রীর তালিকা, রোল, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে।
নীতিমালায় বলা হয়, অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠান প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
এক্ষেত্রে মহানগরী এলাকার প্রতি শিক্ষার্থীর কাছ থেকে মাসে তিনশ টাকা, জেলা পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দুইশ টাকা এবং উপজেলা ও অন্যান্য এলাকার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে দেড়শ টাকা নেওয়া যাবে।
তবে প্রতিষ্ঠান প্রধান ইচ্ছা করলে দরিদ্র শিক্ষার্থীদের এই অতিরিক্ত কোচিংয়ের টাকা কমাতে বা মওকুফ করতে পারবেন বলে নীতিমালায় বলা হয়েছে। নীতিমালা অনুযায়ী অতিরিক্ত ক্লাসের ক্ষেত্রে একটি বিষয়ে মাসে কমপক্ষে ১২টি ক্লাস নিতে হবে, প্রতি ক্লাসে সর্বোচ্চ ৪০ জন শিক্ষার্থী অংশ নিতে পারবে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, কোচিং বাণিজ্য অনুসন্ধান এবং তদন্ত করার এখতিয়ার দুদকের আছে। তবে দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি অগ্রধিকার তালিকা থাকতে হবে, কোন বিষয়ে কমিশন তদন্ত বা অনুসন্ধান করবে। কেননা দুদকের পর্যাপ্ত জনবল সঙ্কট রয়েছে।
কাস্টমস হাউজ, ব্যাংক, বন্দর, ভূমি অফিসের দুর্নীতির বিষয়ে ছোটো পরিসরে তদন্ত বা অনুসন্ধানে সুযোগ নেই দুদকের। এসব খাতে গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অগ্রাধিকারভিত্তিতে এ ধরনের অভিযোগে নজর দিতে হবে।
এফএইচ/এসএইচএস/পিআর/এমকেএইচ