চোখ হারানোর দায় এড়াতে পারে না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় : হাইকোর্ট
চুয়াডাঙ্গার চক্ষু শিবিরে চিকিৎসা নিতে আসা ২০ জনের চোখ হারানো দায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এড়াতে পারেন না বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চক্ষু শিবিরে চিকিৎসা নিতে আসা চোখ হারানো ২০ জনের ক্ষতিপূরণের রুল শুনানিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয়ে এমন মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট।
মঙ্গলবার হাইকোর্টের বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এই মামলার শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট অমিত দাস গুপ্ত, সুভাষ চন্দ্র দাস ও মো. শাহিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন এবিএম আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। ইম্প্যাক্ট মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারের পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম।
এদিকে আজ রুল শুনানিতে এই ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত প্রতিবেদন (রিপোর্ট) দাখিল করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের দাখিল করা পৃথক প্রতিবেদন (রিপোর্ট) দুটিতে দুই রকম মতামত দেয়া হয়েছে।
এ কারণে আদালত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ড্রাগ অধিদফতরের অনুমতি ছাড়া কিভাবে ওষুধ আনলেন?
আপনারা জানেন না মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে। তার মানে আপনাদের নলেজে ছিলো, ওষুধ বা অপারেশন যন্ত্রপাতিতে যদি সমস্যা থাকে তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালেয়র অনুমতি ছাড়া এসব দেশে আসে কিভাবে? এটা মানা যায় না। এটা বলে আপনারা দায় এড়াতে পারেন না। পরে আদালত এ বিষয়ে জারি করা রুলের পরবর্তী শুনানির জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত মুলতবি করেন।
পরে রিটকারী আইনজীবী অমিত দাস গুপ্ত সাংবাদিকদের বলেন, চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে একটি চক্ষু শিবির অনুষ্ঠিত হয়। ওই চুক্ষ শিবিরে চিকিৎসা নিয়ে ২৪ জনের মধ্যে ২০ জন চোখ হারায়। এ ঘটনায় একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। ওই প্রতিবেদন সংযুক্ত করে আমরা একটি রিট দায়ের করি। রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত রুল জারি করেন। পরবর্তীতে রুলের জবাব না দেয়ায় আদালত স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে তলব করেন। গত ৯ জুলাই তারা আদালতে এসেছিলেন। পরে তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত লিখিত জবাব দিতে সময় দেন।
আজকে তাদের দুজনের পক্ষ থেকে লিখিত জবাব দাখিল করা হয়। ওই জবাবের মধ্যে দেখা যায়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে দুটি কমিটি করা হয়েছে। ওই দুই কমিটি দুটি রিপোর্ট দিয়েছে। এর মধ্যে প্রথম রিপোর্টটি করা হয় ১৩ জুলাই আর দ্বিতীয় রিপোর্ট দায়ের করা হয় ১৫ জুলাই। আজকে এ দুটি রিপোর্ট আদালতে উপস্থাপন করা হয়। এখানে দেখা যায়, দুটি রিপোর্টে পরস্পরবিরোধী মতামত রয়েছে। প্রথম রিপোর্টে ইম্প্যাক্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ত্রুটির কথা বলা হয়েছে। এখানে ত্রুটি মানে অবহেলা। এ মর্মে মতামত প্রদান করা হয়েছে। আর পরের রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, এই অপারেশনের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের কোনো অবহেলা ছিল না। বরং তারা ইতোপূর্বে আরও অনেক অপারেশন করেছে। তাতে তারা সফলও হয়েছে। এ ঘটনার সুনির্দিষ্ট কোন কারণ তারা উল্লেখ করেননি।
এ বিষয়টি আদালতের নজরে আনলে আদালত তখন বলেন, অপারেশন করার ক্ষেত্রে ইম্প্যাক্ট কর্তৃপক্ষকে অনুমতি দান করেছিল মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে এ ধরনের অপারেশনে যদি ত্রুটি হয় এতে যদি নাগরিকদের ক্ষতি হয় তাহলে এর দায় মন্ত্রণালয় এড়াতে পারে না। যে ওষুধ ব্যবহার করা হয়েছে সেটি জীবানু মুক্ত কিনা সেটি দেখবার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের ছিল, ওষুধ প্রশাসন অধিদফতরের ছিল। এ কারণে এর দায় তারা এড়াতে পারেন না।
এছাড়া ওই অপারেশনের ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির বিষয়ে আদালত বলেছেন, এগুলো বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে, না আমাদানি করা হয়েছে সেটি ওষুধ প্রশাসনের দেখার কথা থাকলেও তারা সেটি দেখেননি। এর দায়ও মন্ত্রণালয় এড়াতে পারেন না।
রিপোর্ট তৈরিতে সব ভিকটিমদের সাক্ষাতকার নেয়া উচিত ছিল। কিন্তু সেটি তারা করেননি। বরং ভিকটিমদের বাইরের লোকদের সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে। এ রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ কোন পক্ষপাতিত্ব করেছেন কিনা সেটি আদালত জানতে চেয়েছে।
এর আগে গত ৩ জুলাই চুয়াডাঙ্গা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে চক্ষু শিবিরে চিকিৎসা নিতে এসে চোখ হারানো ২০ জনের প্রত্যেককে ১ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণের রুলের জবাব না দেয়ায় স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক ও চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জনকে ব্যাখ্যা দিতে তলব করেন হাইকোর্ট।
গত ২৯ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘চক্ষু শিবিরে গিয়ে চোখ হারালেন ২০ জন!’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে তিনদিনের চক্ষু শিবিরের দ্বিতীয়দিন (৫ মার্চ) ২৪ জন নারী-পুরুষের চোখের ছানি অপারেশন করা হয়। অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন চিকিৎসক মোহাম্মদ শাহীন। এদের মধ্যে চারজন রোগী নিজেদের উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য দ্রুত স্বজনদের নিয়ে ঢাকায় আসেন। পরে ইম্প্যাক্টের পক্ষ থেকে ১২ মার্চ একসঙ্গে ১৬ জন রোগীকে ঢাকায় নেয়া হয়। ততদিনে অনেক দেরি হয়ে যায়। ওই অপারেশনের ফলে এদের চোখের এত ভয়াবহ ক্ষতি হয় যে, ১৯ জনের একটি করে চোখ তুলে ফেলতে হয়।
পরে আইনজীবী অমিত দাসগুপ্ত প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনটি সংযুক্ত করে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় গত ১ এপ্রিল রিট করেন। রিটের শুনানি নিয়ে চুয়াডাঙ্গা শহরের ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টার কেন চোখ হারানো ২০ জনের প্রত্যেককে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
চার সপ্তাহের মধ্যে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিব, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, চুয়াডাঙ্গার সিভিল সার্জন, চুয়াডাঙ্গার ডিসি ও এসপি, ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টার, ডা. মোহাম্মদ শাহীনসহ মোট ১০ জন বিবাদীকে এ রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
আদালত পৃথক এক রুলে চুয়াডাঙ্গার ইম্প্যাক্ট মাসুদুল হক মেমোরিয়াল কমিউনিটি হেলথ সেন্টারে তিনদিনের চক্ষু শিবিরে চক্ষু চিকিৎসায় ২০ জনের চোখ অস্ত্রোপচারে কার্যকর, যথাযথ ও পর্যাপ্ত নিরাপদ ব্যবস্থা গ্রহণে নিষ্ক্রিয়তা কেন আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তাও জানতে চান। একইসঙ্গে ওই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং ডাক্তারের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা কেন গ্রহণ করা হবে না, তাও জানতে চেয়েছিলেন আদালত।
এফএইচ/জেএইচ/পিআর