কোটা প্রথা পুনর্মূল্যায়নের রিট খারিজ প্রসঙ্গে আদালতের ব্যাখ্যা
সকল ক্ষেত্রে কোটা প্রথা পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে করা রিট আবেদন সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। রিট খারিজের আগে আদালত আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি সংক্ষুব্ধ কিনা, ক্ষতিগ্রস্ত কিনা- তা হওয়ার আগেই আদালতে এসেছেন? আপনিতো সাংঘাতিক লোক।’
কোটা প্রথা নিয়ে করা রিট আবেদনের শুনানিতে সোমবার হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ মোহাম্মদ দস্তগীর হোসেন ও বিচারপতি মো. আতাউর রহমান খানের বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। পরে রিট সরাসরি খারিজ করেন আদালত।
সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথা পুনর্মূল্যায়ন চেয়ে দায়ের করা রিট আবেদন খারিজ করে দেয়ার সুনির্দিষ্ট কারণও উল্লেখ করেছেন হাইকোর্ট। রিটকারীরা সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদ অনুসারে সংক্ষুব্ধ বা ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়ায় তাদের রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করেন আদালত।
সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘(১) সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করিতে রাষ্ট্র সচেষ্ট হইবেন; (২) মানুষে মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ করিবার জন্য, নাগরিকদের মধ্যে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করিবার জন্য এবং প্রজাতন্ত্রের সর্বত্র অর্থনৈতিক উন্নয়নের সমান স্তর অর্জনের উদ্দেশ্যে সুষম সুযোগ-সুবিধাদান নিশ্চিত করিবার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন; (৩) জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে মহিলাদের অংশগ্রহণ ও সুযোগের সমতা রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী একলাছ উদ্দিন ভূইয়া। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত তালুকদার।
শুনানির শুরুতে অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূইয়া আদালতকে বলেন, ‘আমরা রিটে কোটা প্রথা কেন সংস্কার করা হবে না- তার নির্দেশনা চেয়েছি।’ তখন আদালত বলেন, ‘এগুলো (কোটা পদ্ধতি প্রণয়ন) হয়েছে ১৯৯৭ ও ২০১১ সালে। এসব এখন বলছেন কেন?’
একলাছ উদ্দিন বলেন, ‘যখন কোটা নির্ধারণ হয়, তারপরও কয়েকবার তা সংস্কার হয়। বুদ্ধিজীবীরাসহ অনেকেই এ কোটার বিরুদ্ধে মতামত দিয়েছেন। নারী, মুক্তিযোদ্ধা, উপজাতীসহ অনেক কোটা হয়েছে।’ তখন আদালত বলেন, ‘এসব সরকারের পলিসি। এগুলো কি সরকারের নজরে নেই?’
তখন একলাছ উদ্দিন বলেন, ‘আমি শুধু রুল চাচ্ছি (কোটা সংস্কার চেয়ে)। কেননা, এ কোটার কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনীরাও সুবিধা পাচ্ছেন।’ তখন আদালত বলেন, ‘কোটার দ্বারা কোনো ভায়োলেশন (সংবিধান লংঘন) হয়েছে কিনা?’
একলাছ উদ্দিন আদালতকে বলেন, ‘কোটা ব্যবস্থার কারণে সংবিধানের ১৯ অনুচ্ছেদের ভায়োলেশন হয়েছে। একটি ছেলে এ কারণে আত্মহত্যাও করেছে। তাই এ বিষয়ে একটি রুল চাচ্ছি। রুল দিয়ে বিষয়টি সংস্কারের আদেশ দিন।’
এ সময় আদালত রিটকারী আইনজীবীকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘যারা রিট করেছেন তারা কি কোটা নিয়ে সমস্যায় পড়েছিল? ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে শিক্ষার্থী রিট করেছেন তিনি কি পরীক্ষা দিয়ে সুযোগ পাননি? আর অন্যরাও এ কোটার বিষয়ে সংক্ষুব্ধ কিনা?’ জবাবে একলাছ উদ্দিন বলেন, ‘রিটকারী শিক্ষার্থী এখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। অন্য দুজন সাংবাদিক। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থী সামনে চাকরির জন্য পরীক্ষা দেবেন।’
এ যুক্তির পর আদালত আইনজীবীর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘আপনি বলতে চান, আমি আইনে পাশ করেছি এখন ডাক্তার হতে চাই? তিনি তো এখনো সংক্ষুব্দ হননি। এটা ভবিষ্যতের বিষয়। এখনও তিনি পরীক্ষা দেননি। তার আগেই তিনি রিট করেছেন? কোটা আছে, কি আছে না- সেটা সরকারের পলিসি। আপনি সংক্ষুব্ধ কিনা, ক্ষতিগ্রস্ত কিনা- তা হওয়ার আগেই আদালতে এসেছেন? আপনিতো সাংঘাতিক লোক।’
এরপর আদালত আদেশ দিয়ে রিট আবেদনটি সরাসরি খারিজ করে দেন। পরে একলাছ উদ্দিন ভূইয়া সাংবাদিকদের বলেন, আদালত রিট খারিজ করে দিয়েছেন। আমরা এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করবো।
প্রসঙ্গত, গত ৩১ জানুয়ারি দুপুরে হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় রিটটি দায়ের করেন অ্যাডভোকেট একলাছ উদ্দিন ভূইয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আনিসুর রহমান মীরসহ তিনজনের পক্ষে এ রিট দায়ের করা হয়।
রিট আবেদনে বলা হয়, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার সরকারি, বেসরকারি, আধা-সরকারি এবং জাতীয়করণ প্রতিষ্ঠানে জেলা ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে ৩০ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১০ শতাংশসহ ক্ষতিগ্রস্ত মহিলাদের জন্য কোটা প্রবর্তন করে আদেশ দেন।
পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় এ কোটা প্রথা সংস্কার ও পরিবর্তন করা হয়। বর্তমানে জনপ্রসাশন মন্ত্রণালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি নিয়োগে কোটা রয়েছে, প্রতিবন্ধী এক শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনির জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা কোটা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য পাঁচ শতাংশ- সবমিলিয়ে ৫৬ শতাংশ কোটা চাকরিতে বিদ্যামান রয়েছে।
২০১৫ সালের ৩১ মার্চ দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে বর্তমান জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৯৭ লাখ ৭০ হাজার। এর মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এবং ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১৫ জন প্রতিবন্ধী। মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে মুক্তিযোদ্ধা দুই লাখ নয় হাজার। ফলে দেশের মোট জনসংখ্যার মধ্যে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ১৪১ নৃ-গোষ্ঠীর জন্য কোটা রয়েছে পাঁচ শতাংশ। একই সঙ্গে ২০ লাখ ১৬ হাজার ৬১০ প্রতিবন্ধীর জন্য কোটা রয়েছে এক শতাংশ।
এদিকে পিএসসি'র তথ্য অনুযায়ী, ২১, ২২ ও ২৫তম বিসিএস পরীক্ষায় মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের পোষ্যদের সংরক্ষিত ৩০ শতাংশের স্থলে ১০.৮, ২.২, ও ৫.২ শতাংশ পূর্ণ হয়েছিল। ফলে বাকি সংরক্ষিত কোটা শূন্য থেকে যায়।
রিট আবেদনে আরও বলা হয়, ২০০৮ সালে পিএসসি'র উদ্যোগে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতায় সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটা প্রথা নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়। ওই সমীক্ষায় কোটা প্রথা ‘অসাংবিধানিক ও ন্যায়নীতির পরিপন্থী’ বলে উল্লেখ করা হয়। সেখানে আরও বলা হয়, কোনো কোটা চিরদিন থাকা ঠিক নয়। এ কোটা সংবিধানের ১৯, ২৮, ২৯ ও ২৯ (৩) এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
রিটে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের সচিব, আইন সচিব, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সচিবসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
এফএইচ/এমএআর/জেআইএম