বিচারপতি অপসারণ মার্শাল ল’তে ফিরে গেলে তা হবে ঐতিহাসিক ভুল
অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, ‘মার্শাল ল অনুযায়ী বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা যদি আপিল বিভাগের মাধ্যমে আবার সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে ফিরে যায় তবে তা হবে ঐতিহাসিক ভুল।’
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল থেকে সংসদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী করা হয়। কিন্তু তা বাতিল চেয়ে রিট আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন হাইকোর্ট।
হাইকোর্টের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখার পর এক প্রতিক্রিয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল এ মন্তব্য করেন।
বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আদি সংবিধানে যদি সংসদ সদস্যদের হাতে বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা থাকতে পারে এখন কেন পারবে না? আগে মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে ছিল তাহলে হঠাৎ এমন কি পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো এখন এ অনুচ্ছেদকে সাংঘর্ষিক বলা হচ্ছে।’
‘এখন সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে মার্শাল ল অনুযায়ী বিচারপতিদের অপসারণ ক্ষমতা আবার যদি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে যায় তা হলে এটা হবে ঐতিহাসিক ভুল।’
তিনি বলেন, ‘সংসদ যদি ভুল আইন করে বা সংবিধানের ভুল ব্যাখ্যা করে তা দেখার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর। কিন্তু বিচারকরা ভুল করলে তাদের দায়বদ্ধতা জনগণের ওপর নির্ভর করে।’
এর আগে, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের আপিল বেঞ্চে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, বিচারকরা ভুল করলে তাকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে অপসারণ না করে জনগণের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে (সংসদ সদস্য) অপসারণ করতে হবে। বিশ্বের বহু দেশে বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ন্যস্ত বলে কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী প্রয়োজন আছে বলে মন্তব্য করেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ এ আইন কর্মকর্তা।
বৃহস্পতিবার সকালে রাষ্ট্রপক্ষের হয়ে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা শুনানি করেন। এরপর শুনানি শুরু করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। পরে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ তার যুক্তিতর্ক তুলে ধরেন। এরপর মামলা রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখেন আপিল বিভাগ।
শুনানিতে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা বলেন, ‘এ সংবিধানের মাধ্যমেই সংসদের সৃষ্টি। আর এ সংসদের প্রতি অবিশ্বাস, অনাস্থা আনা দুঃখজনক।’
তিনি বলেন, ‘আদি সংবিধানে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা যদি মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে থাকতে পারে তাহলে এমন কি পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো যে এখন ওই অনুচ্ছেদকে সাংঘর্ষিক বলা হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘সংবিধানের মূল অংশের ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেই বিচার করতে হবে। সামরিক শাসনের কারণে একটি কালো অধ্যায়ের সৃষ্টি হয়েছিল। তখন আমরা সুপ্রিম কোর্টের কোনো সাহায্য পাইনি। একজন প্রধান বিচারপতি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছিলেন। সেই কালো অধ্যায়ের সময়ে করা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা সুপ্রিম কোর্ট রেখে দিল।’
এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা কোনোভাবেই মার্শাল ল-এর অধীনে ফিরে যেতে চাই না। সংসদ ইচ্ছা মতো আইন প্রণয়ন ও সংবিধানের সংশোধন করতে পারবে- এটাই তো বলছেন?’
জবাবে মুরাদ রেজা বলেন, ‘৯৬ অনুচ্ছেদে আগে যা ছিল চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রথমে সেখানে হাত দেয়া হলো। এটা মৌলিক কাঠামোর অংশ ছিল না বলেই সেখানে হাত দিতে পেরেছিল।’
তিনি বলেন, ‘সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থাকে আপনারা মার্জনা করেছেন। সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল অবৈধ ছিল বলেই আপনারা মার্জনা করেছেন। বৈধ হলে সেটা মার্জনা করার প্রয়োজন ছিল না। ওই সংশোধনী যদি মৌলিক কাঠামোর অংশ হতো তাহলে মার্জনা করার প্রয়োজন হতো না। মার্জনা না করলে আপনা-আপনি জুডিশিয়াল কাউন্সিল ব্যবস্থা চলে যেত। সংবিধানের মৌলিক কাঠামো হলো কষ্টিপাথর। কোনো সংশোধনী অসাংবিধানিক কি না সেটা মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখতে হবে।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরাইতো পঞ্চম, সপ্তম, অষ্টম, ত্রয়োদশ সংশোধনী মামলার রায়ে আদি সংবিধানে ফিরে যাওয়ার কথা বলেছি।’
গত ২৪ মে এ মামলায় অ্যামিকাস কিউরিদের বক্তব্য প্রদান শুরু হয়, যা গত মঙ্গলবার শেষ হয়। অ্যামিকাস কিউরিদের বাইরে আদালতের অনুমতি নিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু বক্তব্য রাখেন। তিনি হাইকোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের সম্পর্কে থাকা কিছু বিরূপ মন্তব্য প্রত্যাহারে আদালতের কাছে আর্জি রাখেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি উপস্থাপনের জন্য বৃহস্পতিবার দিন নির্ধারিত হয়।
বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। এরপর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট আকারে তা প্রকাশ পায়। এ অবস্থায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয়জন আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। এ আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি শেষে হাইকোর্ট ওই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। এ রুলের ওপর শুনানি শেষে গত ৫ মে আদালত সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারকের মতামতের ভিত্তিতে ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। তিন বিচারকের মধ্যে একজন রিট আবেদনটি খারিজ করেন।
এর মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠদের রায় প্রকাশিত হয় গত ১১ আগস্ট এবং রিট খারিজ করে দেয়া বিচারকের রায় প্রকাশিত হয় ৮ সেপ্টেম্বর। দুটি মিলে মোট ২৯০ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে।
এফএইচ/ওআর/এমএআর/পিআর