সাফাত-সাকিফের জবানবন্দিতে সেই রাতের বর্ণনা
বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে জোর করে ধর্ষণ করেন আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার বন্ধু নাঈম আশরাফ। ধর্ষণের পর দুই তরুণী কান্নায় ভেঙে পড়েন। এরপর তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন দুই ধর্ষক।
বৃহস্পতিবার মহানগর হাকিম আহসান হাবিবের আদালতে সাফাত আহমেদ এবং হাকিম সাদবীর ইয়াসির আহসান চৌধুরীর আদালতে সাদমান সাকিফের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়।
জবানবন্দি শেষে তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন আদালত। আদালত ও পুলিশ সূত্রে অভিযুক্ত দু’জনের জবানবন্দি থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
জবানবন্দিতে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ বলেন, ঘটনার ১০-১৫ দিন আগে হোটেল পিকাসোতে ভিকটিম দুই তরুণীর সঙ্গে বন্ধু সাদমান সাকিফের মাধ্যমে পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্র ধরে তাদের সঙ্গে মোবাইলে কথোপকথন হতো।
২৮ মার্চ সাফাতের জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে দুই তরুণীকে আমন্ত্রণ করেন সাদমান। পার্টিতে আসার পর তারা সুইমিং পুলে গোসল করেন। এরপর দুই তরুণীকে নিয়ে সাফাত ও নাঈম দুই রুমে যান। রুমে কথা বলতে বলতে দুই তরুণীর সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠ হন। একপর্যায়ে তারা জোরপূর্বক দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেন। সে সময় দুই তরুণী কান্নায় ভেঙে পড়েন। দুই তরুণীকে তারা বোঝান। পরবর্তীতে তাদের মধ্যে বিষয়টি মীমাংসা হয়ে যায়।
এর আগে সুষ্ঠু তদন্তের জন্য মামলার প্রধান আসামি সাফাত আহমেদকে ছয় দিন এবং সাদমান সাকিফকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে দেন ঢাকা মহানগর হাকিম রায়হানুল ইসলাম।
১১ মে রাতে সিলেট থেকে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফকে গ্রেফতার করা হয়।
মামলায় অভিযুক্ত অপর আসামি নাঈম আশরাফকে (মো. আব্দুল হালিম) গতকাল বুধবার রাত ৮টা ৪০ মিনিটে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থেকে গ্রেফতার করা হয়। বৃহস্পতিবার তার বিরুদ্ধে সাতদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত।
নাঈম আশরাফকে গ্রেফতারের পর বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, মুন্সিগঞ্জের লৌহজংয়ে অভিযান চালিয়ে নাঈম আশরাফ ওরফে এইচ এম হালিমকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাদীদের ভাষ্য অনুযায়ী সেদিন রাতে নাঈমের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত ছিল। গ্রেফতারের পর তাকে ডিবি কার্যালয়ে আনা হয়। সেখানে ওমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন্সের তদন্ত কর্মকর্তারা তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। জিজ্ঞাসাবাদে নাঈম ধর্ষণের বিষয়টি স্বীকার করেছেন।
এর আগে, ১১ মে ঢাকা মহানগর হাকিম নুরুন্নাহার ইয়াসমিনের খাসকামরায় বেলা ১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভিকটিম দুই তরুণী জবানবন্দি দেন।
জবানবন্দিতে তারা জানান, গত ২৮ মার্চ বনানীর ‘দ্য রেইন ট্রি’ হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়ে তাদের নেয়া হয়। সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও দেহরক্ষী তাদের বনানীর ২৭ নম্বর রোডের দ্য রেইন ট্রি হোটেলে নিয়ে যান।
জবানবন্দিতে তারা বলেন, হোটেলে যাওয়ার আগে দু’জনই জানতেন না সেখানে পার্টি হবে। এ সময় তাদের সঙ্গে শাহরিয়ার নামের এক বন্ধু ছিলেন। তাদের বলা হয়েছিল, এটা একটা বড় অনুষ্ঠান, অনেক লোকজন থাকবে। হোটেলে যাওয়ার পর সাফাত ও নাঈমের সঙ্গে তারা আরও দুই তরুণীকে দেখেন। সেখানে তারা ভদ্র কোনো লোককে দেখেননি। পরিবেশ ভালো না লাগায় শাহরিয়ারসহ দুই তরুণী চলে আসতে চেয়েছিলেন। তখন আসামিরা শাহরিয়ারের কাছ থেকে গাড়ির চাবি নিয়ে নেন এবং শাহরিয়ারকে মারধর করেন। এরপর দুই তরুণীকে অস্ত্রের মুখে একটি কক্ষে নিয়ে যান। ধর্ষণ করার সময় সাফাত গাড়িচালককে ভিডিও চিত্র ধারণ করতে বলেন। আর নাঈম আশরাফ মারধর করেন। তারা এ ঘটনা জানিয়ে দেবেন বলে জানান। এরপর আসামি সাফাত তার দেহরক্ষীকে ওই দুই তরুণীর বাসায় পাঠান তথ্য সংগ্রহের জন্য। তারা এতে ভয় পেয়ে যান। লোকলজ্জার ভয় এবং মানসিকভাবে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন।
নাঈম আশরাফকে আদালতে নেয়া হচ্ছে।
আসামিরা ভিডিও চিত্র বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছেড়ে দেয়ার হুমকি দেন। তাদের কথামতো না চললে কিংবা ২৮ মার্চের ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেন।
প্রসঙ্গত, সাফাত (২৬) আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে এবং সাদমান (২৪) পিকাসো রেস্তোরাঁর অন্যতম মালিক ও রেগনাম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে।
ফেরিওয়ালার ছেলে নাঈম আশরাফ
দুই তরুণীর ধর্ষণ মামলার পর নাঈমকে চিহ্নিত করেন সিরাজগঞ্জবাসী। তিনি সিরাজগঞ্জের কাজিপুর উপজেলার গান্ধাইল গ্রামের আমজাদ হোসেন ফেরিওয়ালার ছেলে এইচএম হালিম ওরফে নাঈম আশরাফ।
২০০৪ সালে এসএসসি পাস করে বগুড়া পলিটেকনিকে ভর্তি হন তিনি। সেখানেও নিজের বাবার নামসহ পুরো পরিচয় গোপন করে প্রতারণা করেন এক মেয়ের সঙ্গে। বিষয়টি জানাজানি হলে সেখানে গণপিটুনির শিকার হন নাঈম।
তার বিরুদ্ধে তিনটি বিয়ের অভিযোগ রয়েছে। আগের দুই স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হলেও তৃতীয় স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকার কালশি এলাকায় ভাড়াবাড়িতে বসবাস করতেন।
কাজিপুর উপজেলার গান্ধাইল ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আশরাফ আলী জানান, এলাকায় সে একজন প্রতারক হিসেবে পরিচিত। বাবার নাম-পরিচয় বদলে বিয়ে করেছে তিনটি। বগুড়া-ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিজের নাম বদলে কুকীর্তি করে বেড়ায় হালিম। সে বছরে দু-একবার এলাকায় আসে। প্রতারণাই তার পেশা। স্কুলজীবন থেকেই সে প্রতারক। তার বিরুদ্ধে ইউনিয়ন পরিষদে নানা অভিযোগ রয়েছে।
২৮ মার্চ বন্ধুর সঙ্গে জন্মদিনের অনুষ্ঠানে গিয়ে বনানীর ‘দি রেইনট্রি’ হোটেলে ধর্ষণের শিকার হন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া দুই তরুণী। ওই ঘটনায় ৬ মে রাজধানীর বনানী থানায় আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ (সিরাজগঞ্জের আবদুল হালিম) ও সাদমান সাকিফসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তারা।
জেএ/এমএআর/জেআইএম