জানের ভয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাই না
২০০৭ সালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর, যা বিদ্যুৎ, খাদ্য এবং আশ্রয়শূন্য করে দিয়েছিল গোটা জনপদকে। কেউ কেউ তাণ্ডবের কবল থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারলেও বাঁচাতে পারেননি নিকট আত্মীয়স্বজনকে। কারো কারো মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া গেলেও অনেকে রয়েছেন নিখোঁজ। সেদিনের সে মহাপ্রলয়ের নয় বছর কেটে গেলেও আজও স্মৃতির মানসপটে দুঃস্বপ্নের মতো ভেসে ওঠে। আজও কাঁদায় এবং ভয়ে শিউরে ওঠে এলাকার মানুষজন। সিডরের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত অন্যতম জেলা ভোলার মানুষজন বর্তমানে কেমন আছেন- তা নিয়ে ছোটন সাহার চার পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ থাকছে দ্বিতীয় পর্ব।
অভাবের তাড়নায় বাধ্য হয়েই সাগরে যেতে হয়, কিন্তু সাগরে গিয়েই দুর্ঘটনার শিকার হয়। আমরা গরিব, আমাদের দেখাশোনা করার কেউ নেই। সম্পদ গেলে সম্পদ পাবো কিন্তু জান গেলে আর জান পাবো না। তাই জানের ভয়ে সাগরে মাছ ধরতে যাই না। সাগরে মাছ শিকারে না যাওয়ার কারণগুলো এভাবেই বললেন চন্দ্র প্রসাদ গ্রামের গৃহবধূ তাছনুর।
তিনি বলেন, যে যায় সে আর ফিরে আসে না, সিডরের নিখোঁজ নয় জেলেও ফিরে আসেননি। তাই স্বামীকে সাগরে যেতে নিষেধ করেছি।
ঘূর্ণিঝড় সিডরে ট্রলারডুবির ঘটনায় নয় জেলে নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে সাগরে মাছ শিকার বন্ধ করে দিয়েছে ভোলার চন্দ্র প্রসাদ গ্রামের শত শত জেলে। পরিবার থেকে নিষেধ করায় দুঃসাহসী জেলেরা এখন মেঘনা-তেঁতুলিয়া কূলে মাছ শিকার করেন। জীবিকার তাগিদে সাগরে গিয়ে নিহত কিংবা নিখোঁজ হতে চান না কেউ।
চন্দ্র প্রসাদ গ্রামে গিয়ে জানা গেছে, আট বছর আগে চন্দ্র প্রসাদ গ্রামের নয় জেলের নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে ওই গ্রামের অধিকাংশ জেলে সাগরে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। তারা নদীতে মাছ শিকার করেন। আকাশে মেঘ দেখলেই তারা তীরে ফিরে আসার তোড়জোড় শুর করেন।
সিডরে নিখোঁজ হয়েছিলেন আনিছ চৌকিদারের ছেলে সহিদুল মাঝি। এরপর থেকে সাগরে মাছ শিকার বন্ধ করে দিয়েছেন তার ছোট ভাই মাইনুদ্দিন।
মাইনুদ্দিন বলেন, সংসার চালানোর জন্য মাছ ধরি কিন্তু মরতে চাই না, তাই এলাকার নদীগুলোতে মাছ শিকার করে যা পাচ্ছি, তা দিয়ে কোনোরকম কষ্টে দিন কেটে যাচ্ছে।
জেলে বধূ কহিনুর বলেন, এলাকার সবাই মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। তারা সবাই গরিব। মাছ ধরাই সবার পেশা। কিন্তু সাগরে মাছ শিকারে গেলেও অনেক জেলে আর ফিরে আসেনি, তাই স্বামীকে মাছ শিকারে যেতে নিষেধ করেছি।
আরেক গৃহবধূ রাসিদা জানান, বাবার অপক্ষোয় সন্তান আর সন্তানের অপেক্ষায় বাবা, কিন্তু কেউ ফিরে আসে না। আমাদের মনে অজানা ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে। তাই সাগরে মাছ শিকার বন্ধ।
জেলে আকবর, সোহাগ, নুরুউদ্দিন ও সিরাজ জানায়, যে কোনো সময় দুর্যোগ চলে এলে কোনো উপায় থাকে না। তখন বাঁচার যুদ্ধ। যারা বেঁচে ফিরে আসেন তারা ভাগ্যবান। আমাদের সাগরে যেতে ভয় হয়, ঝড় হলে তীরে ফেরা যায় না। নদীতে ভয় একটু কম। তাই জীবিকার প্রয়োজনে নদীতে যাই, সাগরে মাছ শিকার বন্ধ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, শুধু চন্দ্র প্রসাদ নন, ভেলুমিয়া ইউনিয়নের অনেক গ্রামের শত শত জেলে সাগরে মাছ শিকার বন্ধ করে দিয়েছেন। সিডরের সেই ট্রলারডুবির পর থেকে জেলেদের মনে অজানা ভয় কাজ করে।
এছাড়া সাগর ও নদীতে মাছ শিকারে গেলেও সেখানে ঝড়ের পূর্বাভাস পায় না জেলেরা। এতে তাদের মধ্যে আরো বেশি আতঙ্ক চড়িয়ে পড়েছে।
জেলেদের সতর্ক সঙ্কেত দিতে ভোলার মনপুরায় একটি দফতর স্থাপনা করা হলেও ছয় বছরেও তা চালু হয়নি। এছাড়া সাগর উপকূলে কোস্টাল রেডিও স্থাপন করলে ঝড়ের সঙ্কেত কিংবা পূর্বাভাস পেতেন জেলেরা। এসবের ব্যবস্থা না থাকায় ঝড়ের সময় সাগরের জেলেরা অরক্ষিত হয়ে পড়েন।
জেলেরা জানিয়েছেন, সাগরে মাছ শিকারে গিয়ে গত ১০ বছরে ভোলা জেলায় অন্তত অর্ধশতাধিক জেলে নিহত ও শতাধিক জেলে নিখোঁজ হয়েছে।
এফএ/পিআর