বিসিএস জয়
যত আগে প্রস্তুতি; তত আগে ক্যাডার: আলমগীর হোসেন
মো. আলমগীর হোসেন ৪৩তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা সিরাজগঞ্জ জেলার শাহজাদপুর উপজেলার খুকনীর বিশ্বনাথপুর গ্রামে। তিনি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। আট ভাইয়ের মধ্যে আলমগীর সবার ছোট। বাবা পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম। বাবার ছোট ব্যবসা দিয়েই চলতো সংসার এবং সন্তানদের পড়াশোনা। তিনি স্থল পাকড়াশী ইনস্টিটিউশন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি এবং মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ কলেজ থেকে জিপিএ-৫ পেয়ে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে কৃষি বিষয়ে স্নাতক এবং কৃষিতত্ত্বে স্নাতকোত্তর পাস করেন।
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি ৪৩তম বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: ৪৩তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডার পেয়েছেন, অনুভূতি কেমন?
মো. আলমগীর হোসেন: বিচিত্র অনুভূতি, এককথায় অনন্য—অসাধারণ! যা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। চূড়ান্ত রেজাল্ট প্রকাশিত হওয়ার দিন আমি বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, সারদায় ট্রেনিংরত ছিলাম। আমি বিসিএস ভাইভা শেষ করে এক সপ্তাহ পরই ৪ নভেম্বর ২০২৩ তারিখে সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশে এক বছরের মৌলিক প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি, সারদায় যাই। আমি বিভিন্ন গ্রুপের মাধ্যমে আগেই জেনেছিলাম আজ রেজাল্ট প্রকাশিত হবে। যার ফলে আমি অনেক চিন্তিত ছিলাম। কি হয় না হয় এই ভেবে নিজের মধ্যে কিছুটা হতাশাও কাজ করছিল! নিজেকে সামলে সবার সাথে মিশতে চেষ্টা করলেও প্যারেডে মন দিতে পারছিলাম না। প্যারেড শেষ করে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় রুমে আসলাম। গোসল করে মাগরিবের নামাজ আদায় করে ভয়ে ভয়ে মোবাইলটা হাতে নিলাম। দেখলাম রেজাল্ট অনেক আগেই প্রকাশিত হয়েছে! দ্বিধা-দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে রেজিস্ট্রেশন নাম্বার মেলাতে লাগলাম। লক্ষ্য করলাম আমার হাত কাঁপছে! হঠাৎ রেজাল্ট শিটে আমার রেজিস্ট্রেশন নাম্বার দেখে চোখটা আটকে গেল! বিশ্বাসই হচ্ছিল না। বার বার মিলিয়ে দেখতে থাকলাম! নিশ্চিত হলাম আমি কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি! তাৎক্ষণিক চিৎকার করে আমার রুমমেটদের জানাতে লাগলাম। একি! কণ্ঠস্বরটা আটকে যাচ্ছে। গলার স্বরটা কেমন যেন ধরে আসছে। শব্দ যেন বের হতে চাইছে না! সাথে চোখ বেয়ে ঝরছে আনন্দাশ্রু! পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুরো পুলিশ ব্যারাক জানাজানি হয়ে গেল। সবাই আমাকে অভিনন্দন জানাতে এলো। কেউ কেউ এসে আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। সত্যিই এ এক স্বর্গীয় অনুভূতি, যা আমি কখনোই ভুলতে পারবো না।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মো. আলমগীর হোসেন: সত্য কথা বলতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরই আমি বিসিএস প্রতিযোগিতার সাথে পরিচিত হই। আশেপাশের সিনিয়র ভাইদের পড়তে দেখে অনুপ্রাণিত হই। তখন থেকেই একটু একটু বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন লালন করতে থাকি। কিন্তু তখন এটা আমার কাছে দুরূহ মনে হতো। ভাবতাম আমি হয়তো ক্যাডার হতে পারবো না! তার একমাত্র কারণ ছিল আমার অত্যাধিক খেলাধুলাপ্রিয়তা। আর কিছুটা ফাঁকিবাজ তো ছিলামই।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
মো. আলমগীর হোসেন: অন্যদের থেকে আমার বিসিএস যাত্রা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল। অ্যাডমিশনে মেডিকেলে চান্স না পেয়ে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। আমার ভাই একরকম আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিলেন। যদিও অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ ছিল। যেহেতু নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কৃষিতে পড়তে হচ্ছে। তাই পড়ালেখার প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। বিকেলে মাঠে খেলাধুলা আর রাতে ভার্সিটির গেটে বন্ধু, সিনিয়র-জুনিয়রদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সময় কাটতে লাগলো। আমার প্রথম বিসিএস ছিল ৪০তম। তখন আমি মাস্টার্সের ছাত্র। ওই বিসিএসে আমার প্রস্তুতি ছিল না বললেই চলে। আমি মনে হয় অল্প কিছু প্রশ্নের উত্তর কনফিডেন্টলি করতে পেরেছিলাম। ফলাফল ওই বিসিএসে অকৃতকার্য! অথচ আমার কাছের কিছু বন্ধু-বান্ধব আর ক্লোজ কয়েকজন সিনিয়র ভাইও প্রিলি পাস করলো। তাদের পাস করা দেখে আমি হতাশ হয়ে পড়লাম। এর কিছুদিন পরই আমার বাবা ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। আমার হতাশা যেন আরও বাড়তে থাকলো। দিশেহারা হয়ে গেলাম। নিজের মধ্যে একটা চরম অনুশোচনা তৈরি হলো। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম আমি সিরিয়াসলি পড়বো। আস্তে আস্তে আড্ডাবাজি কমিয়ে রুমে থাকতে শুরু করলাম। অভ্যাসের কিছুটা কষ্টসাধ্য হলেও পরিবর্তন করতে হলো। একটু একটু করে বিসিএস পড়া শুরু করলাম। কিছুদিন পরেই করোনা বিশ্বকে থমকে দিলো। হল ছেড়ে বাড়ি চলে গেলাম। দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকায় বাড়িতে আর পড়ালেখায় মন বসতো না। এর মধ্যে করোনার প্রকোপ ৬-৭ মাস অতিবাহিত হয়েছে। ক্লোজ কয়েক জন বন্ধুকে কল দিলাম। সিন্ধান্ত নিলাম কয়েক জন মিলে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটের পাশেই একটা বাসা ভাড়া নিয়ে জবের জন্য পড়বো। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করলাম। বাসা ভাড়া নিলাম। এর মধ্যেই আমার মাস্টার্স শেষ হলো। হাতে সময় তিন মাস। তারপরই ৪১তম বিসিএসের প্রিলি। এবার কোমর বেঁধে মাঠে নামলাম। আমি আর আমার বন্ধু মিলে প্রতিদিন প্রায় ১৫ ঘণ্টা করে পড়তে লাগলাম। মনে আছে একটা টিউশনিও করাতাম তখন। খুব ভালো একটা প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস কাট মার্কের খুব কাছাকাছি গিয়েও ফেল করলাম। এবার আমি একেবারে ভেঙে পড়লাম। আমার বাবা প্রায় দুই বছর ক্যান্সারের সাথে লড়াই করে ওই সময় মৃত্যুবরণ করলেন। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। নিজেকে সবার থেকে আরও গুটিয়ে নিলাম। এবার প্রথমেই ব্যর্থতার কারণগুলো খুঁজতে শুরু করলাম। যে বিষয় বা টপিকগুলোতে ভুল করেছিলাম; ওইগুলো আইডেন্টিফাই করে রিকভার করার চেষ্টা করতে থাকলাম। এরপর আমাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একে একে আমি ৪৩তম ও ৪৪তম প্রিলি পাস করলাম। ৪৩তম লিখিততে বোথ ক্যাডারে পাস করে ভাইভা দিলাম। মহান আল্লাহ পাকের অশেষ রহমতে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হলাম। আমার লালিত স্বপ্ন পূরণ হলো। বিসিএস ছাড়াও আমি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক এবং বাংলাদেশ পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর পদে সুপারিশপ্রাপ্ত হই এবং যোগদানও করি।
আরও পড়ুন
জাগো নিউজ: আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন?
মো. আলমগীর হোসেন: আমার বাবার অল্প ইনকাম দিয়ে সংসার চালানোই অনেক কঠিন ছিল। তারপরও আমার ভাইয়েরা সবাই অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করতেন। আমি নিজেও ক্লাস নাইনের আগে কোনো প্রাইভেট পড়িনি। ক্লাস নাইনে একটি ব্যাচে ইংরেজি প্রাইভেট পড়তাম। মাসিক বেতন ছিল মাত্র ১৫০ টাকা, সেটা ম্যানেজ করাও কঠিন ছিল। তারপর আমার ভাইয়েরা চাকরিতে প্রবেশ করতে থাকেন। আমাদের পরিবারে তখন কিছুটা সচ্ছলতা আসে। এরপরে পড়ালেখা চালিয়ে যেতে আমার আর তেমন একটা অসুবিধে হয়নি। এখন আমরা আট ভাইয়ের মধ্যে ছয় জন গ্র্যাজুয়েট এবং অধিকাংশই সরকারি চাকরি করেন। আমার পরিবারের প্রতিটা সদস্যই ছিল আমার অনুপ্রেরণা। শত ব্যর্থতা, হতাশা, ঝড়-ঝাপটা সামলেও যারা আমাকে আগলে রেখেছেন। সাহস জুগিয়েছেন। চেয়েছেন আমি যেন আমার লালিত স্বপ্ন পূরণ করি। বিসিএস ক্যাডার হই। আমার বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন সব সময় তিনি এটা বিশ্বাস করতেন যে, আমি অবশ্যই ভালো কিছু করবো। সবার মুখে হাসি ফুটাবো। কিন্তু বাবা আমার সেই স্বপ্ন পূরণ হওয়ার দিনটার সাক্ষী হতে পারলেন না। আরও অনেকে আমার অনুপ্রেরণা ছিলেন। বিশেষত সেই সব বন্ধু আর সিনিয়র ভাই, যারা ইতোমধ্যেই ৪০তমে ক্যাডার হয়েছিলেন।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএসের জন্য কীভাবে প্রস্তুতি নেবেন?
মো. আলমগীর হোসেন: আমি মনে করি, বিসিএস প্রস্তুতি একটা লম্বা জার্নি। যে যত আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করবে; সে তত আগে ক্যাডার হবে। যেমন- আমার যে বন্ধুরা অনার্স থেকেই বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছিল। তাদের দেখেছি প্রথম বিসিএসেই ক্যাডার হতে। একটা কথা সবার মনে রাখতে হবে যে, কঠোর পরিশ্রম করেই আসলে সফলতা অর্জন করতে হয়। সফলতার কোনো শর্টকাট পথ নেই। তবে টেকনিক্যালি পড়ালেখা করলে পরিশ্রম অনেকটাই কমে যায় এবং সফলতার পথ অনেক সহজ হয়ে যায়। বিসিএসের জার্নিতে প্রিলি পাস করাটাই আসলে সবচেয়ে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং কাজ। প্রিলির জন্য প্রত্যেকটি বিষয়েই সমান গুরুত্ব দিতে হবে। তবে গুরুত্বপূর্ণ টপিকস ভালোভাবে আয়ত্ত করতে হবে এবং নিজে নিজে বিভিন্ন টেকনিক প্রয়োগ করে মনে রাখার চেষ্টা করতে হবে। আর বিসিএসের প্রিভিয়াস প্রশ্ন অবশ্যই গুরুত্ব দিয়ে পড়তে হবে। কতটুকু পড়লেন তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো কতটুকু মনে রেখে পরীক্ষার হলে প্রয়োগ করতে পারলেন। একটি বিষয়ের অনেকগুলো বই একবার পড়ার চেয়ে একটি বিষয়ের একটি বই অনেকবার পড়া বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরীক্ষার আগে যত বেশি রিভিশন দিতে পারবেন; তত বেশি মনে থাকবে এবং পরীক্ষার হলে কনফিডেন্স পাবেন। সাথে প্রচুর পরিমাণে মডেল টেস্ট দিতে হবে। এতে পরীক্ষার হলে টাইম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে ধারণা তৈরি হবে এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস বাড়বে।
জাগো নিউজ: কৃষি ক্যাডার নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. আলমগীর হোসেন: দেশে শিক্ষিত, ধনী ও সম্পদশালী মানুষের অভাব নেই। তবে সৎ লোকের বড়ই অভাব। আমার প্রধান লক্ষ্য হলো সততা ও নিষ্ঠার সাথে বাকি জীবন অতিবাহিত করা। বাংলাদেশ যেহেতু একটি কৃষি প্রধান দেশ, তাই প্রত্যন্ত এলাকার কৃষক ভাইদের সাথে নিয়ে দেশের মাটি ও মানুষের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বিনির্মাণ ও দেশের সমৃদ্ধির জন্য কাজ করে যেতে চাই।
এসইউ/জিকেএস