বিসিএস জয়
হতাশ হয়েছি বহুবার কিন্তু হাল ছাড়িনি: আনিসুর রহমান
মো. আনিসুর রহমান শ্রাবণ ৪১তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার মেধাক্রম ২৪তম। জন্ম গোপালগঞ্জে, বেড়ে ওঠা ঢাকার মিরপুরে। বাবা মো. কেরামত আলী মোল্লা অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবী ও মা ফিরোজা বেগম গৃহিণী। তিনি উত্তর কালশী আদর্শ বিদ্যাপীঠ থেকে এসএসসি এবং আহ্ছানিয়া মিশন কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স ডিপার্টমেন্ট থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএ থেকে এমবিএ পড়ছেন।
সম্প্রতি জাগো নিউজের সঙ্গে তিনি বিসিএস জয়, ক্যারিয়ার পরামর্শ ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ইসমাম হোসাইন—
জাগো নিউজ: আপনার ছেলেবেলা কেমন কেটেছে?
মো. আনিসুর রহমান: আমরা ৬ ভাই-এক বোন। আমিই সবার বড়। আমাদের জন্ম একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারে। বাবা ছোট চাকরি করতেন আর মা গৃহিণী। থাকতাম একটি টিনশেডের বাসায়। যেখানে দুটি রুম ছিল। একটিতে বাবা-মা ও ছোটবোন থাকতো। অন্যটিতে আমরা ৩ ভাই বিছানায় আর ৩ ভাই ফ্লোরে চক্রাকারে ঘুমাতাম। বাবা-মা খুব বেশি পড়াশোনা না করলেও পড়াশোনার গুরুত্ব বুঝতেন। সব সময় চাইতেন, যেন আমরা পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াই। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আমার জীবনে সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া। এরপর থেকে জীবনের মোড় ঘুরতে থাকে। কোচিং সেন্টারে ভর্তি পরীক্ষার্থীদের ইংরেজি পড়াতাম। খুব দ্রুতই এ অঙ্গণে আমার নামডাক হয়। সবাই ‘শ্রাবণ স্যার’ নামেই চিনতো। টাকার অভাবে পরীক্ষা না দিতে পারা থেকে শুরু করে আজকের এ সফলতা আমাকে একটি জিনিস শিখিয়েছে, কেউ যদি পরিশ্রম করে এবং দৃঢ় চিত্তে লেগে থাকে; তাহলে সাফল্য আসবেই। আজ আমরা সব ভাই শিক্ষিত। তিন ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি। সবচেয়ে ছোট ভাইটি এবার এসএসসি পরীক্ষা দিলো।
আরও পড়ুন: বাবার মৃত্যুতেও হাল ছাড়েননি নাসিম
জাগো নিউজ: বিসিএস দেবেন—এ সিদ্ধান্ত কবে নিলেন?
মো. আনিসুর রহমান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মূলত বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন একটু একটু করে ডানা মেলতে থাকে। আমি ২০১৬ সালে এমবিএ করার শেষের দিকে ইউসিবি ব্যাংকে প্রবেশনারি অফিসার হিসেবে যোগদান করি। বেতন ও অন্য সুবিধা ভালোই ছিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সব সময় ভাবতাম বিসিএস ক্যাডার হওয়ার কথা। তাই কিছুদিন চাকরি করার পর চাকরি ছেড়ে বিসিএসের জন্য পড়া শুরু করি। সেই থেকে শুরু হয় জীবনের এক নতুন অধ্যায়। প্রথম দুটি বিসিএস পরীক্ষা ভালো দেওয়া সত্ত্বেও নন-ক্যাডার আসে। কিছুটা হতাশা জন্ম নেয়। ২০১৯ সালে পিকেএসএফে পরীক্ষা দিই। মূলত বিসিএসের প্রিপারেশন দিয়েই চাকরিটা পেয়ে যাই। তখন আবার আশার আলো দেখতে লাগলাম। ৫টি বিসিএস পরীক্ষায় চাকরি করা অবস্থায় অংশগ্রহণ করি।
জাগো নিউজ: বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন কীভাবে?
মো. আনিসুর রহমান: বিসিএসের সিলেবাস অনেক বড়। এ সিলেবাস কাভার করতে সঠিক পরিকল্পনা দরকার। আমি প্রথমেই নিজের দুর্বলতা ও সবলতা নিয়ে কাজ শুরু করি। দীর্ঘদিন ভর্তি কোচিংয়ে ইংরেজি পড়িয়েছি, তাই এ বিষয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হয়নি। ব্যবসায় শিক্ষার ছাত্র হওয়ায় অঙ্কে কিছুটা দুর্বল ছিলাম। তাই সবার আগে গণিতে জোর দিই। এ ক্ষেত্রে নবম-দশম শ্রেণির বোর্ড বই অনুসরণ করি। আমার এমবিএর প্রিপারেশন এ ক্ষেত্রে খুব হেল্পফুল ছিল। অন্য বিষয়ের জন্য বাজারে প্রচলিত একসেট বই পড়েছি। নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। তাই সাধারণ জ্ঞান অংশটি চর্চায় ছিল। আমার অভ্যাস ছিল বা এখনো আছে, তা হলো প্রচুর শিক্ষামূলক ভিডিও দেখা। এসব ভিডিও দেখলে ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল বিষয়ে অনেক বিশ্লেষণাত্মক ধারণা পাওয়া যায়। একটি উদাহরণ দিই—৪১তম বিসিএসে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে ১৫ মার্কের একটি প্রশ্ন এসেছিল আসামের এনআরসি বিষয়ক। পরীক্ষার আগে এ বিষয়ে কিছুই পড়িনি। আগে এনআরসি নিয়ে অনেক ভিডিও ডকুমেন্টরি দেখেছি। সেই জ্ঞান কাজে লাগিয়ে প্রশ্নটির উত্তর দিতে পেরেছি। সব কিছু বই থেকে আসবে না। চোখ-কান খোলা রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। লিখিত পরীক্ষার কিছু কিছু টপিকে গণিতের মতো নম্বর পাওয়া সম্ভব। ইংরেজি ও বাংলা গ্রামার অংশ ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলে গণিতের মতো ফুল মার্কস পাওয়া সম্ভব। বাংলাদেশ বিষয়াবলিতে সংবিধান অংশ, বাংলা থেকে ইংরেজি ও ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদেও ভালো নাম্বার পাওয়া যায়। একই সঙ্গে মানসিক দক্ষতা এবং গণিতের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সবগুলো প্রশ্নের উত্তর করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তীব্র প্রতিযোগিতামূলক এ পরীক্ষায় নম্বর ছেড়ে দিলে দৌড় থেকে অনেকটা ছিটকে যেতে হবে। আমি লেখার সময় কালো কালির সঙ্গে নীল কালি ব্যবহার করতাম। বিশেষ করে কোটেশন, ডাটা বা গ্রাফ-চার্ট নীল কালি দিয়ে লিখতাম।
আরও পড়ুন: দারিদ্র্যকে জয় করে বিসিএস ক্যাডার আসাদ
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রায় কার অনুপ্রেরণা সবচেয়ে বেশি ছিল?
মো. আনিসুর রহমান: আমার অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস আমার পরিবার। আমার মা, বাবা, স্ত্রী এবং ভাই-বোন। মা-বাবা তাদের জাগতিক শখ-আহ্লাদ ত্যাগ করে পড়াশোনা করিয়েছেন। সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে ছিলেন। আমার স্ত্রী সারাক্ষণ সাহস জুগিয়েছে। আমার শিক্ষক ও বন্ধুরাও সব সময় পাশে ছিলেন। শিক্ষকরা নিঃস্বার্থ ভাবে সাহায্য করেছেন। সুফিয়া ম্যাডাম, নাসরিন ম্যাডাম, শাহজামাল ভাই, কামাল হুজুর ও কামরুল ভাইসহ অনেক শিক্ষক আছেন; যারা আমার শিক্ষাজীবনের পথচলাকে অনেক সহজ করেছেন। তাদের আজ অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
জাগো নিউজ: নতুন যারা বিসিএস পরীক্ষা দিতে চান, তদের জন্য কী পরামর্শ দেবেন?
মো. আনিসুর রহমান: নতুনদের জন্য বলতে চাই, হাল ছাড়া যাবে না, হতাশও হওয়া যাবে না। যতদিন লক্ষ্য অর্জন না হয়; ততদিন সবটা উজাড় করে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। তবে একেবারে বেকার না থেকে অন্য চাকরিরও চেষ্টা করতে হবে। কারণ বিসিএস জীবনের লম্বা একটি সময় নিয়ে নেয়। আমি ৪১তম বিসিএসে দেখেছি, যারা সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন; তাদের সিংহভাগই চাকরি করতেন। পড়াশোনার কোনো বিকল্প নেই। মনে রাখতে হবে, আপনার মেধায় একসময় দেশ চলবে; তাই আপনাকে চিন্তা-চেতনায়, মেধা-মননে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকতে হবে।
আরও পড়ুন: বিসিএসে প্রথম পছন্দের ক্যাডারই পেয়েছেন মনির
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. আনিসুর রহমান: অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাধারণ মানুষ সরকারি সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে নানা ধরনের ভোগান্তির শিকার হন। আমার চেষ্টা থাকবে সাধারণ মানুষের এ ভোগান্তি লাঘব করা। আমি এও বিশ্বাস করি, যে কোনো পেশায় থেকে দেশের সেবা করা যায়। যদি কেউ শুধু সমাজ ও দেশের প্রতি নিজের দায়িত্বগুলো ঠিকভাবে পালন করে। আমি সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো।
এসইউ/জিকেএস