পেশা হিসেবে মূকাভিনয়ের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত: নিথর মাহবুব
মুহাম্মদ মাহাবুবুর রহমান মোল্লা একজন মূকাভিনয় শিল্পী। শিল্প-সংস্কৃতির অঙ্গনে তিনি পরিচিত ‘নিথর মাহবুব’ নামে। বাংলাদেশের মূকাভিনয় শিল্প আলোর মুখ দেখতে শুরু করে এ শিল্পীর প্রচেষ্টায়। পেশায় সংবাদিক হলেও মঞ্চ নাটক ও টিভি নাটকে নিয়মিত অভিনয় করে যাচ্ছেন তিনি। দুরন্ত টিভির অনুষ্ঠান দুরন্ত সময়ের সুবাদে ছোটদের মহলে ‘মূকাকু’ হিসেবেও তার পরিচিতি আছে।
নিথর মাহবুব ১৮ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলার কলাগাছিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সদাসদী বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, সায়দাবাদ আরকে চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক ও নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন।
সম্প্রতি তিনি মূকাভিনয় পেশা নিয়ে কথা বলেছেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফিচার লেখক সাজেদুর আবেদীন শান্ত—
জাগো নিউজ: প্রথমেই আপনার শৈশব ও পড়াশোনা সম্পর্কে জানতে চাই—
নিথর মাহবুব: আমার খুব ছোটবেলা ক্লাস সিক্স পর্যন্ত কেটেছে ঢাকায়। তারপর এসএসসি পর্যন্ত গ্রামে। তখন ঢাকার ধোলাইরপাড়ে থাকতাম। অনেকটা গ্রামের মতোই ছিল তখনকার ধোলাইরপাড়। কোনো বহুতল ভবন ছিল না। তখন ভাড়া বাড়িগুলোয় ইটের বা টিনের অনেকগুলো ঘর থাকত। সেগুলোর চাল থাকত টিনের।
ছোটবেলায় টোকাইয়ের মতো স্বভাব ছিল আমার। লোহার ফ্যাক্টরি, কাঁচের ফ্যাক্টরি, তামার ফ্যাক্টরি থেকে লোহা, তামা, কাঁচ কুড়িয়ে এনে ঘরে জমাতাম। সেগুলো ফেরিওয়ালার কাছে বিক্রি করে টাকা জোগাড় করতাম। মা-বাবার কাছে কখনোই টাকা চাইতে হতো না। সেই টাকায় প্রচুর সিনেমা দেখতাম। দামি দামি খাবার কিনে খেতাম আর রং পেন্সিল কিনতাম। অনেক সময় রাগ করে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম, তখন সারাদিন সিনেমা হলে কাটাতাম। একদিনে চারটা সিনেমাও দেখেছি। সিনেমা দেখে হলের মেঝেতেই শুয়ে থাকতাম। পরদিন বাসায় ফিরতাম।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিলো?
নিথর মাহবুব: কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। কিন্তু আমার পড়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না, বড় হয়েও না। আমাকে জোর করে পড়োনো হয়েছে। পড়তে ভালো লাগতো না। স্কুল ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতাম। সবাই বলতেন, ব্রেন ভালো। তাই জোর করে উচ্চতর গণিতসহ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করেন। টার্গেট ছিল আমাকে ইঞ্জিনিয়ার বানাবেন।
জাগো নিউজ: মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কবে?
নিথর মাহবুব: ২০০৬ সালের দিকে দলের সঙ্গে সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছিল না। তাই দল ছেড়ে জোরেশোরে মূকাভিনয় নিয়ে কাজ শুরু করি। তখন জন্মদিন, বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ঘরোয়া অনুষ্ঠানে মূকাভিনয় শুরু করি।
জাগো নিউজ: মূকাভিনয় শিল্পী হিসেবে যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
নিথর মাহবুব: সম্ভবত ১৯৯৯ সালে নরসিংদীতে আমাদের নাটকের দল নাট্যশীলন কর্মশালার আয়োজন করে। সেখানে নাট্যজন জাহিদ রিপন ভাইয়ের নেওয়া একটি ক্লাসে মূকাভিনয় শিল্প প্রসঙ্গে বিস্তারিত জানতে পারি। সেই থেকে শিল্পটা ভালো লাগত এবং বাসায় নিজে নিজে চর্চা করতাম। ছোটবেলা থেকেই ব্যায়াম ও অ্যাক্রোবেটিকের কিছু কাজ করতাম। তাই মাইমটা ভালো হচ্ছিল আমার। এরপর ২০০৬ সালে শিল্পকলা একাডেমির একটি কর্মশালায় অংশগ্রহণ করি। মূকাভিনয় শিল্পী জিল্লুর রহমান জন ভাই এলেন মাইমের ক্লাস নিতে। সবার মধ্য থেকে তিনি আমাকে কাছে ডেকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আই অ্যাম প্রাউড অব ইউ’।
২০০৭ সালে বাংলাদেশে মূকাভিনয় শিল্পের পথিকৃৎ প্রবাসী পার্থ প্রতিম মজুমদার দাদা দেশে আসেন লান্স ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে। আমি দাদার সঙ্গে দেখা করি। মূকাভিনয় করি বলে দাদার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। দাদার সঙ্গে চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের সৌভাগ্য হয়। দাদার সঙ্গ পেয়ে আরও সমৃদ্ধ হই। ২০০৮ সালে নিজের দল মাইম আর্ট গঠন করলাম। ২০০৯ সালে পার্থ-দা ফ্রান্সের জাতীয় থিয়েটারের মোলিয়ার অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার পর আবার দেশে আসেন। পার্থদার সম্মানে জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে দেশি-বিদেশি গুণী শিল্পীদের অংশগ্রহণে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। সেখানে আমাকে মাইম করার জন্য সিলেক্ট করা হয়। আমি অনেক চিন্তায় পড়ে যাই। এত বড় অনুষ্ঠানে গুণী শিল্পীদের মাঝে আমি কী করব? কেমন করব? অনেক ভেবেচিন্তে একটি খণ্ড মূকাভিনয় দাঁড় করাই। আমার সেই মাইম দেখে হলভর্তি প্রায় ৯০০ দর্শক মুগ্ধ হন। রাতে পার্থ-দাও যখন মেসেজ পাঠিয়ে জানান, তিনি আমার মূকাভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তখন মনে হলো, আসলেই ভালো কিছু করতে পেরেছি।
জাগো নিউজ: মানুষ আপনার ‘চরিত্র’কে কী হিসেবে নিচ্ছে?
নিথর মাহবুব: অনেকে মূকাভিনয়কে মনে করে কমেডি কিছু। কিন্তু মূকাভিনয় কমেডি না। এর মাধ্যমে অনেক সিরিয়াস গল্প বলা যায়, প্রতিবাদ করা যায়, সমাজের অসঙ্গতি তুলে ধরা যায়, মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করা যায়। মূকাভিনয় করি বলে প্রথমদিকে অনেক নাটকের নির্মাতারা আমাকে কমেডি করার জন্য ডাকতেন, আমি না করে দিতাম। কারণ আমি কমেডিয়ান হতে চাইনি, অভিনেতা হতে চাইতাম। তবে আমার বেশিরভাগ মূকাভিনয় দেখে মানুষ প্রচুর হাসে। কিন্তু সেগুলোয় বার্তা থাকে, শিক্ষণীয় বিষয় থাকে। গল্পের সিচুয়েশনই কমেডির জন্ম দেয়, গল্পের চরিত্রকে দর্শক হাসানোর চিন্তা করতে হয় না।
জাগো নিউজ: আপনার এ কাজে অনুপ্রেরণায় কে ছিলেন?
নিথর মাহবুব: শিল্পের সঙ্গে সম্পর্ক আমার শিশুকাল থেকে। যখন আমার হাতে পাথরের স্লেট-পেন্সিল আসে; তখন থেকেই ছবি আঁকি। আর যখন থেকে মুখে কথা ফোটে; তখন থেকেই ছড়া মুখস্থ করে আশেপাশের মানুষদের নেচে নেচে অভিনয় করে সেই ছড়া শোনাতাম। বেড়াতে বা কোথাও গেলে সবাই আমাকে ছড়া শোনাতে বলতেন। তবে আমার শিল্পের ভ্রমণে আমার পরিবারের অনুপ্রেরণা, সহযোগিতা, দিকনির্দেশনা কিছুই ছিল না। নিজের যখন যা মনে চাইতো, তা-ই করতাম। এখন শিল্পের অঙ্গনের বেশিরভাগ মানুষ আমাকে চেনেন মাইম শিল্পী হিসেবে। তার পরে সাংবাদিক হিসেবে। কিন্তু স্কুলজীবনে যে কারণে আত্মীয়-স্বজন, স্কুলের বন্ধু-বান্ধব ও আশেপাশের মানুষের কাছে আমার ব্যাপক পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে, তা হলো ছবি আঁকার জন্য। এ ছাড়া একাডেমিতে গান শিখেছি, আবৃত্তি সংগঠনের সঙ্গেও কাজ করেছি কিছুদিন।
জাগো নিউজ: পেশা হিসেবে মূকাভিনয় শিল্পীদের ভবিষ্যৎ কী?
নিথর মাহবুব: দেশের কোনো মাধ্যমের শিল্পীদের ভবিষ্যতই ভালো নয়। সেখানে মূকাভিনয়ের ভবিষ্যৎ তো আরও অনিশ্চিত। আমরা এখন যাদের শিল্পী বলছি, যারা প্রচুর টাকা রোজগার করছেন। তাদের বেশিরভাগই আসলে চেহারার পরিচিতি কাজে লাগিয়ে সেটা করছে। বিজ্ঞাপন করে, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, ভাইরাল হয়ে, নিজের প্রযোজনা করে চেহারার পরিচিতি পাচ্ছেন তারা। কিন্তু কাজ করতে করতে কাজের গুণে চেহারা পরিচিতি বেড়েছে এমন শিল্পী এখন আর খুব একটা নেই। যারা দিনের পর দিন শিল্পের সাধনা করছেন, শিল্পের অঙ্গন থেকে তাদের আয়ের পথ এখন প্রায় বন্ধ। কেউ কোনোভাবে চেহারার পরিচিতি তৈরি করতে পারলে তা দিয়ে সে নাচ, গান, মডেলিং, অভিনয়, উপস্থাপনা, লেখালেখি ইত্যাদি সবই করার সুযোগ পাচ্ছেন। আর এটা পারছেন আমাদের মিডিয়াগুলোর দুর্বলতার কারণে। সেসব জায়গায় মেধাবী মানুষের অভাব বলে। শিল্পীর পরিচিতি কাজে লাগিয়ে দর্শক ধরতে চাইছে মিডিয়াগুলো। আর তাদের এই দুর্বলতাকে পূঁজি করে চেহারার পরিচিতি বাড়িয়ে যে কেউ শিল্পী হয়ে যাচ্ছেন। শিল্পী হওয়ার এ প্রবণতাকে কাজে লাগিয়ে একটা শ্রেণি আবার চেহারার পরিচিতি তৈরি করার ব্যবসা জুড়ে দিয়েছে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
নিথর মাহবুব: সারাজীবন একটাই পরিকল্পনা করে আসছি, সেটি হলো ভালো মানুষ হওয়া। সৎ থাকতে চাই, আজীবন শিল্পের সঙ্গে শিল্পের সাধনায় নিয়োজিত থাকতে চাই, দেশের-দশের কল্যাণে নিয়োজিত থাকতে চাই। কর্মগুণে মানুষের মনে জায়গা করে নিতে চাই, দেশে মূকাভিনয় শিল্পকে আরও জনপ্রিয় করতে চাই।
এসইউ/জিকেএস