স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন নাজমুল হক
গ্রামীণ ইউনিক্লোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হক একজন দুর্দান্ত ব্যবসায়ী। চলার পথে বদলে দিয়েছেন অনেক হিসাব-নিকাশ! রীতিমত লাইফস্টাইল ইন্ড্রাস্টিতে আলোচিত নামে পরিণত করেছেন নিজের প্রতিষ্ঠানকে। স্বপ্নের কারিগর মানুষটির সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বেনজির আবরার—
আপনার শৈশব সম্পর্কে কিছু বলুন—
নাজমুল হক: আমার জন্ম বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জে। শৈশব সেখানেই কেটেছে। এরপর বাবার চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকা হয়। বাবা দেশের বাইরে চলে গেলে আবার গ্রামে ফিরে যাই। ঠিক তখন থেকে এসএসসি পর্যন্ত গ্রামেই ছিলাম। ছোটবেলায় দুষ্টু হলেও পড়াশোনায় মনোযোগী ছিলাম। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ক্লাসে কীভাবে ভালো ফলাফল করা যায়, সে প্রচেষ্টা সব সময় ছিল। গ্রামে তখন পরিবেশগত বৈরিতা থাকলেও মায়ের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, তত্ত্বাবধান ও শাসনের কারণে অনেক নিয়মতান্ত্রিক পরিবেশেই বেড়ে উঠি। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফেরা ছিল অলিখিত আইন। সন্ধ্যার পরে যদিও অনেক ঘুম পেত। কিন্তু মা সব সময় গভীর রাত পর্যন্ত পাশেই থাকতেন পড়াশোনা দেখার জন্য। মা এভাবে আগলে রেখেছিলেন বলেই পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ সৃষ্টি হয়। তবে খেলাধুলা অনেক পছন্দ করতাম, যেটা মা জানতেন না। স্কুল শেষে বিভিন্ন খেলায় অংশ নিতাম। একবার ষষ্ঠ শ্রেণিতে থাকতে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় ৫টি খেলায় অংশ নিয়ে ৫টিতেই পুরস্কার পাই। এ ঘটনায় মা খুব অবাক হন। যেহেতু আমার খেলাধুলার ব্যাপারে কিছুই জানতেন না। এরপর থেকেই তিনি আমার খেলাধুলার আগ্রহের ব্যাপারে জানতে পারেন।
এইচএসসিতে আমার ঢাকার কোনো কলেজে পড়ার আগ্রহ থাকলেও কিছু জটিলতার কারণে ভর্তি হতে পারিনি। বরিশাল বিএম কলেজে ভর্তি হই। সারাদেশে নম্বরের ভিত্তিতে ৪র্থ স্থান অর্জন করি। এরপর ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। আইনজীবী হওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ১ম বর্ষে মনে হয় দেশের বাইরে কোথাও পড়াশোনা করব। গার্মেন্টস সেক্টর তখন উজ্জীবিত হচ্ছিল। তাই মনে হলো এ সেক্টরে কাজ করা যায়। তখন ভারতে একটি স্কলারশিপ পেলেও যাওয়া হয়নি। ঠিক তখন জাপানের মনোবুশো স্কলারশিপ হয়। চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সেখানে গিয়ে ১ বছর জাপানিজ ভাষা শিখি। আন্ডারগ্রাজুয়েট লেভেলে পড়াশোনা শেষ করে কনসালটিং সেক্টরে কাজ শুরু করি। পড়াশোনার প্রবল আগ্রহ থেকে জাপানে এমবিএ শেষ করি।
ক্যারিয়ার শুরুর গল্পটা শুনতে চাই—
নাজমুল হক: পড়াশোনা অবস্থায় বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে খণ্ডকালীন কাজ করতাম। জাপানে জব মার্কেট একটু আলাদা। ৩য় বর্ষে থাকতেই জব খোঁজা শুরু করতে হয়। পড়াশোনা শেষের একবছর আগেই জব কনফার্ম করতে হয়। আমি একটি কার রিলেটেড কোম্পানিতে জব পাই। আমার যেহেতু কনসালটিং রিলেটেড কাজে আগ্রহ, তাই চেষ্টা করি ওই সেক্টরে চাকরি খুঁজতে। জব পেয়ে যাই জাপানের নাম্বার ওয়ান অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি ডেনস্যু কর্পোরেশনে। যার ১৩০টির বেশি দেশে ব্যবসা আছে। ডেনস্যুতে কাজ করা অবস্থায় অভিজ্ঞতা হয় বিখ্যাত বিভিন্ন ব্র্যান্ড নিয়ে কাজ করার। যেমন- হোন্ডা, প্যানাসোনিক, নেসলে, মিৎসুই সুমিতোমো কাইজোকাসাই, ওরাকল, ফাইজার, সানোফি, ফিলিপ মরিস, ফুজিৎসু, ইউনাইটেড এয়ার, এমেক্স, ফেডেক্সসহ অনেক কোম্পানি। এ সময় আমি ইউনিক্লো থেকে অফার পাই গ্লোবাল মার্কেটিংয়ে কাজ করার। এতদিন কনসালটিংয়ে কাজ করলেও সরাসরি ব্যবসায় এ কাজ করতে যোগদান করি ইউনিক্লোতে। কাজ শুরুর পর বিভিন্ন দেশের ইউনিক্লোর মার্কেটিংয়ের বিষয়গুলো দেখতাম। ঠিক তখন আমাকে বাংলাদেশে গ্রামীণ ইউনিক্লোর দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয় বিজনেস পুনর্গঠনে। এরপর থেকেই কাজ করে যাচ্ছি গ্রামীণ ইউনিক্লোর সম্প্রসারণে।
আপনার জীবনের ইউটার্ন বলবেন কোন ঘটনাকে?
নাজমুল হক: ইউটার্ন বলা যায় জাপানে স্কলারশিপ নিয়ে যাওয়াকে। কারণ এর পরেই আমি নতুনভাবে শিখতে ও নতুন জগতে প্রবেশ করি। নতুন একটি ভাষা শেখা ও নতুন পরিবেশে মানিয়ে ওঠা আমার জীবনের অন্যতম ঘটনা। যা আমাকে আজকের এ অবস্থায় নিয়ে এসেছে।
গ্রামীণ ইউনিক্লোর এগিয়ে যাওয়ার গল্পটা বলবেন?
নাজমুল হক: গ্রামীণ ইউনিক্লো ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে সোশ্যাল বিজনেস হিসেবে। আমি যুক্ত হই ২০১৫ সালে। যখন ডেনস্যুতে জব করতাম; তখন গ্রামীণ ইউনিক্লোর বিষয়টি প্রথম আসে কিছু কাজের প্রেক্ষিতে। ইউনিক্লোতে কাজ করার সময় গ্রামীণ ইউনিক্লো রিস্ট্রাকচারিংয়ের কথা এলে আমাকে এখানে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। যেহেতু আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে জানি এবং জাপান ও ইউনিক্লো সম্পর্কেও জানি। আমারও বিশ্বাস ছিল গ্রামীণ ইউনিক্লোকে রিস্ট্রাকচার করতে পারব। গ্রামীণ ইউনিক্লো শুরুতে গ্রামীণ নারীদের মাধ্যমে গ্রামের নারীদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টির লক্ষে স্যানিটারি প্রোডাক্ট ও পোশাক সেল করত। এরপর আমরা ২০১৩ সালে সামগ্রিক বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা উন্নয়নের জন্য প্রথম ২টি স্টোরের মাধ্যমে তৈরি পোশাক বিক্রির মূলধারার সামাজিক ব্যবসায় যাত্রা শুরু করি। স্টোরের যাত্রা শুরুর পর থেকে অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী মূল্যে বিভিন্ন ইউনিক ও ফাংশনাল পোশাক, ব্যতিক্রমী স্টোর ব্যবস্থাপনা, জাপানিজ মান নিয়ন্ত্রণ এবং তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে বিক্রি করে আসছি। ব্যবসা থেকে অর্জিত মুনাফা পুরোপুরি ব্যবসায় সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সামাজিক উন্নয়নে ব্যয় করছি। আমাদের মূল নীতি কমফোরটেবল। আমরা নিশ্চিত করতে চেষ্টা করছি কমফোরটেবল পোশাক, শপ ও লাইফস্টাইল।
দীর্ঘদিন ধরে এক শ্রেণির মানুষের পছন্দের এ প্রতিষ্ঠানকে কোথায় দেখতে চান?
নাজমুল হক: ইউনিক্লোর একটি ব্র্যান্ড কনসেপ্ট আছে—লাইফওয়্যার। গ্রামীণ ইউনিক্লোকে আমরা লাইফওয়্যার হিসেবে মানুষের মাধ্যে উপস্থাপন করতে চাই। লাইফওয়্যার হচ্ছে কোনো স্পেশ্যাল নয় বরং দৈনন্দিন জীবনে যে পোশাকের প্রয়োজন সেটি। নারী-পুরুষ সবার জন্য প্রতিদিনের পোশাক। এখন ঢাকা বা ঢাকার আশেপাশে শুধু শোরুম থাকলেও আমরা সারাদেশে লাইফওয়্যারকে ছড়িয়ে দিতে চাই।
তরুণদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
নাজমুল হক: তরুণরা এখন অনেক এগিয়ে। তারা ক্যারিয়ার সম্পর্কে যেমন সচেতন; তেমনই বিশ্বের বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখেন এবং জানেন। তথ্যপ্রযুক্তিতেও তরুণরা অনেক এগিয়ে। তবে একটি বিষয় হচ্ছে, তরুণরা যখন কোনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন; তখন অনেকে ঘাবড়ে যান। আমি মনে করি, জীবনে চ্যালেঞ্জ আসবেই। সেই চ্যালেঞ্জকে মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে হবে। চ্যালেঞ্জকে ভয় না করে স্বাগত জানিয়ে জয় করতে হবে।
এসইউ/জিকেএস