দেশেই তৈরি হোক দক্ষ জনশক্তি
‘লেখাপড়া করে যে, অনাহারে মরে সে/জানার কোন শেষ নাই, জানার চেষ্টা বৃথা তাই’- হীরক রাজার কথা দিয়েই লেখা শুরু করছি। কিন্তু এখন ২০১৬ সাল। হীরকরাজও নেই, তার রাজ্যও নেই। সুশিক্ষা ও কর্মদক্ষতা জীবনে পথ চলার ক্ষেত্রে এখন অপরিহার্য। আর দক্ষতা বাড়াতে চাই ট্রেনিং বা কর্মমুখী শিক্ষা।
আজকের লেখাটা আমাদের দেশের ট্রেনিং ইনস্টিটিউট নিয়ে। লেখাটায় আমার সঙ্গে থাকছেন একজন কল্পিত কারখানা মালিক। তাকে নিয়েই আমার দেখা ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের চিত্র তুলে ধরবো।
ট্রেনিং করিয়ে কী হবে
দেশি আর বিদেশি কোম্পানির মধ্যে পার্থক্য কোথায় জানেন? আমরা কর্মীদের ভাবি ব্যয়ের উৎস আর বিদেশে ভাবা হয় আয়ের উৎস হিসেবে। তাই পেশাজীবীদের আরো কর্মদক্ষ করে তোলার জন্য কোম্পানি অর্থ ব্যয় করে। আমাদের দেশের কোনো কোনো কোম্পানি মালিকদের এটা বোঝানো অসম্ভব কাজ। ‘ট্রেনিং করে যদি চলে যায়?’ চলে গেলে যাক। তবুও তাকে শেখান। যেখানেই যাক, সে ভালো করবে।
বিদেশ থেকে ট্রেইনার আনা হোক
মালিক তার জনবল দক্ষ করার জন্য রাজি হয়েছেন। কিন্তু তিনি বিদেশি ট্রেইনার ছাড়া দেশি ট্রেইনারে বিশ্বাস করতে পারছেন না। অথচ আমাদের দেশে বহু ছেলে-মেয়ে বেকার, চাকরির জন্য দিশেহারা। ‘আমাদের ছেলেরা কাজ জানে না, তারা বেশিদিন থাকে না, তারা উচ্চাভিলাষী’- কত কী। তদ্রুপ ট্রেইনারদের ক্ষেত্রেও ‘বাংলাদেশি ট্রেইনার? কথা বলতে পারবে তো?’ অনেকে এমনটাই ভাবেন।
আচ্ছা, দেশের মধ্য থেকেই আনো
এবার দেশি ট্রেইনার খোঁজার পালা। কার ট্রেনিং লাগবে, কোন ট্রেনিং লাগবে, ট্রেনিং করে কীভাবে কাজ করবে, তার জন্য কোনো যথাযথ তদারকি নেই। দু’দিন আপনি লেট, যান টাইম ম্যানেজমেন্ট ট্রেনিং করে আসুন। আগুন লেগেছে কোম্পানিতে, যান ফায়ার ফাইটিং ট্রেনিং করতে। নতুবা অর্ডার পাওয়া যাবে না বায়ারদের কাছ থেকে। কে ট্রেইনার এটা বড় কোনো বিষয় না। কে কি শিখলো, কি শেখানো হল খুবই গৌণ। ট্রেনিংটা যেন একটা সো-ডাউন টাইপ।
ওকে, নতুন ট্রেইনার আনো
কারখানা মালিক অবশেষে নতুন ট্রেইনারের ব্যাপারে সম্মত হলেন। লক্ষ্য করে দেখবেন আমাদের অনেকেরই সুপ্ত বাসনা থাকে শিক্ষক হওয়ার। বাচ্চাদের এখনো বড় হয়ে কি হবে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায় টিচার হবো। টিচার না হোক, জ্ঞান আহরণ ও বিতরণের লক্ষ্য অনেকেরই থাকে। সবার যেটা থাকে না সেটা হল ভালো রেজাল্ট। আরেকটি হল বয়স ও এক্সপেরিয়েন্স।
ভালো রেজাল্ট
সর্বোচ্চ সিজিপিএ পাওয়া ছাত্ররাই যে ভালো ক্লাস নেবে এরকম কথা কোনো কিতাবে লেখা নেই। মেধাবী একজন ছাত্র চাকরি করতে গেলে তাকে ১০ হাজার টাকা বেতন অফার করা হয়। যারা এটা করেন, ভেবে দেখুন তো আপনার ড্রাইভারের বেতন কত? বুয়ার বেতন কত? এই ছেলেগুলোই ক্ষোভে আর হতাশায় দেশ ছাড়ছে। আর সেই সুযোগে দেশে প্রবেশ করছে বাইরের দেশের লোক।
বয়স
পৃথিবীতে কি ২১ বছর বয়সের সিইও নেই? ২০ বছরে কি বিজ্ঞানী হয় না? মেধার মূল্য দিন, বয়স নয়। মেধাকে পারফর্মেন্স নয়, পটেনশিয়ালিটি দিয়ে বিচার করুন। বিদেশের লোকগুলোর থেকে আমাদের শেখার আছে। তারা মেধা যাচাই করতে জানে, মেধার মূল্য দিতে জানে, সবার কাজকে সম্মান করতে জানে।
অভিজ্ঞতা
স্টিভ জবস, বিল গেটস কোন কোম্পানিতে চাকরি করেছেন? স্টিভ জবস নিজে সমাবর্তন পাননি, কিন্তু সমাবর্তনে এসে ভাষণ দিয়ে গেছেন। চাকরি না করলে তার কি এক্সপেরিয়েন্স হয় না? দেশের যে সব তরুণ উদ্যোক্তা খেটে মরছেন, নিজেরা কিছু করার চেষ্টা করছেন, তাদের কি কোনই অভিজ্ঞতা নেই? তারা কি কাজ করেন না? অভিজ্ঞতার সংজ্ঞা কি চাকরি নাকি কাজ?
আচ্ছা ভাই, ফ্রি ট্রেনিং হবে
যে কারখানা মালিক কিনা বাইরে থেকে ট্রেইনার আনতে চেয়েছিলেন, সে এখন একটি ফ্রি ট্রেনিং চাচ্ছেন। কেন আশা করেন ফ্রি ট্রেনিং? ট্রেইনারদের কি পেট নেই?
কীভাবে বুঝব আপনি ভালো ট্রেইনার
দেখুন, পচা মাছ ভুল করেও পয়সা দিয়ে লোকে কেনে। মাছ ভালো না হলে পরদিন আর তার কাছে কেউ যায় না। বাজে ট্রেনার হলে আপনিও না হয় তাকে আর ডাকবেন না। অন্যদের বলবেন সে ভালো না। বিশ্বাস করার ঝুঁকিটাতো নিতে হবে ভাই।
একটি স্যাম্পল ট্রেনিং হোক
ভেবে দেখুন তো, কত পিস অর্ডার পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলে এক-দুই পিস স্যাম্পল বানানো হয়? ট্রেনিং তো প্রতিদিন হয় না। হয়তো বছরে এক অথবা দুইবার হয়। আপনি কি বিনা বেতনে এক মাস চাকরি করেছিলেন? সবার কাজকে সম্মান করতে শিখুন।
আমাদের আহ্বান- কোম্পানিতে ট্রেনিং কালচার গড়ে তুলুন। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সহায়ক হউন। সকল ক্ষেত্রে নতুনদের সুযোগ দিন।
লেখক : ট্রেইনার ও প্রফেশনাল সিভি রাইটার, চিফ নলেজ ডিস্ট্রিবিউটর, কর্পোরেট আস্ক।
এসইউ/এমএস