জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে : আব্দুন নূর তুষার
আব্দুন নূর তুষার। বিতর্ক, অনুষ্ঠান উপস্থাপনা, লেখালিখিসহ ক্রিয়েটিভ নানা অঙ্গনে যার পরিচয়। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে। চাকরিসূত্রে যুক্ত হয়েছিলেন হাইপারটেনশন সেন্টার, ইউএসএইডের বেসিকস প্রকল্পসহ সরকারি-বেসরকারি বড় বড় প্রকল্পে। সরকারি চাকরিও করেছেন কিছুদিন। নিয়েছেন মানসিক চিকিৎসায় উচ্চতর শিক্ষা। জনসাধারণকে স্বাস্থ্য সচেতন করতেও লিখেছেন তিনি। দায়িত্ব পালন করেছেন নিজেরই প্রতিষ্ঠিত গতি মিডিয়া লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে।
তিনি উপস্থাপনার মাধ্যমে পেয়েছেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা। তৈরি করেছেন একাধিক জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। শুভেচ্ছা, বাউবি ১২, হরলিক্স জিনিয়াস বাংলাদেশ ও জিনিয়াস পরিবার, ইউ গট দ্য লুক, সময়ের কথা, ক্রিকেট ক্রিকেট এবং রোড টু ডেমোক্রেসি ইত্যাদি তাঁর জনপ্রিয়তার শীর্ষে থাকা অনুষ্ঠানগুলোর অন্যতম। দায়িত্ব পালন করেছেন নিজের হাতে ১৯৯১ সালে গড়ে তোলা বিতার্কিকদের জাতীয় সংগঠন বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশন, বিডিএফের সভাপতি হিসেবে। ছিলেন দাতব্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সোসাইটি অব হাইপারটেনশনের মহাসচিব। সমাজসেবার স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি নির্বাচিত হন রোটারি ইন্টারন্যাশনালের পল হ্যারিস ফেলো হিসেবে। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সঙ্গে কাজ করেন ১৯৮৪ সাল থেকে।
তাঁর প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে আছে ‘দেহ-ঘড়ি’, ‘ছয় নম্বর ক্রমজম’, ‘শুদ্ধ বিতর্ক’, ‘ছিন্ন পাতায় ভিন্ন ভাবনা’, ‘সোজা পথে উল্টো রথে’ ও ‘এই বুকে ফেসবুকে’। একইসঙ্গে নিয়মিতই সমসাময়িক নানা বিষয়ে পত্রিকাতে লেখেন প্রায় দুই দশক ধরে। দেশের প্রায় সেরা সব গণমাধ্যমেই রয়েছে জনপ্রিয় এই মিডিয়া ব্যক্তিত্বের ছোঁয়া। বর্তমানে যুক্ত আছেন সম্প্রচারের অপেক্ষায় থাকা নাগরিক টেলিভিশনের চিফ অপারেটিং অফিসার, সিইও হিসেবে।
উপস্থাপনার নানা বিষয় নিয়ে কথা হয় দেশসেরা এই উপস্থাপকের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোলাম রাব্বী।
জাগো জবস : ছাত্রজীবন থেকে এখনো নিজেকে যুক্ত রেখেছেন বিতর্কসহ ক্রিয়েটিভ নানা অঙ্গনে। উপস্থাপনা করতে গিয়ে আপনার এসব অভিজ্ঞতা কতটা কাজে লাগে?
আব্দুন নূর তুষার : অবশ্যই, খুবই কাজে দিয়েছে। আজকের আব্দুন নূর তুষার ঐ সময়ের সেরা ডিবেটরেরই একটা প্রতিকৃতি। ডিবেটে আমি ছিলাম চ্যাম্পিয়ন। ছাত্রজীবনে বিতর্ক চর্চা করতে করতে আমি বাংলাদেশ থেকে ওয়ার্ল্ড ডিবেটেও অংশগ্রহণ করি। যেটা আমাকে দেশ-বিশ্ব-সমাজ-সংস্কৃতি ও রাজনীতি সম্পর্কে জানতে, বুঝতে শিখিয়েছে। উপস্থাপনার মূল শিক্ষাটাতো ডিবেট থেকেই আসা।
জাগো জবস : ডিবেটর নাকি প্রেজেন্টার; কোন পরিচয়ে আপনাকে মানুষ সবচেয়ে বেশি চিনতে পারে?
আব্দুন নূর তুষার : দু’টোতেই। কেননা আমি বিতর্ক করে যেমন সবার ভালোবাসা পেয়েছি; ঠিক তেমনি উপস্থাপনায়ও রেসপন্স পেয়েছি। এককথায় দু’টোতেই সবার কাছে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছি, এখনও পাচ্ছি। তাই আমার বিশ্বাস আমি সব জায়গাতেই সমান জনপ্রিয় এবং পারদর্শী।
জাগো জবস : উপস্থাপক হতে গেলে বিতার্কিক হওয়া কতটা জরুরি বলে আপনি মনে করেন?
আব্দুন নূর তুষার : না, বিষয়টা এমন না যে, উপস্থাপক হতে গেলে তাকে বিতার্কিক হতেই হবে। বরং আমি মনে করি, কারো যদি জানাশোনা ভালো থাকে, সে যে কাজই করুক, সেখানেই ভালো করতে পারবে।
জাগো জবস : অনুষ্ঠান উপস্থাপকের কী কী গুণ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আব্দুন নূর তুষার : একজন উপস্থাপক অবশ্যই একজন ভালো মানুষ হবেন। তিনি অনুষ্ঠানের কনটেন্ট সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখবেন। অনুষ্ঠান নির্মাণসহ প্রযোজনার বিষয়গুলোতে অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারলে ভালো হয়। সেটা সম্ভব না হলে, যে অনুষ্ঠান বা যে বিষয়ে অনুষ্ঠান করবেন, অবশ্যই সে বিষয়ে নিজের নলেজ লেভেলটাকে বাড়াতে হবে। আর শুদ্ধ, সঠিক উচ্চারণ ও ভাষা ব্যবহারতো রয়েছেই। আর সবসময় অটোকিউ বা স্ক্রিপ্ট ফলো না করে নিজের থেকে কিছু বলার বা প্রেজেন্ট করার ক্ষমতাও থাকতে হবে।
জাগো জবস : সংবাদ উপস্থাপকেরও কি ঠিক একই গুণ থাকা প্রয়োজন?
আব্দুন নূর তুষার : এসব গুণ থাকার পাশাপাশি একজন সংবাদ উপস্থাপককে অবশ্যই নিউজি মানে সংবাদ বিষয়ক জ্ঞান এককথায় সংবাদের খুঁটিনাটি এবং চারপাশে ঘটে যাওয়া বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখতে হবে।
জাগো জবস : সংবাদ বা প্রোগ্রাম উপস্থাপকের জন্য পোশাক-পরিচ্ছেদ কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
আব্দুন নূর তুষার : খুবই ভালো প্রশ্ন করেছেন আপনি। বর্তমানে অনেককেই দেখি, বাংলা কালচার বিশেষ করে আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে রিপ্রেজেন্ট করছে এমন অনুষ্ঠান- অথচ কেমন যেন তার পোশাক বা অ্যাপিয়ারেন্স ঠিক ঐ বিষয়টির সঙ্গে যাচ্ছে না। তাই আমি বলবো, অবশ্যই একজন উপস্থাপক, সে নিউজ বা প্রোগ্রাম, যা-ই হোক না কেন, তাকে অবশ্যই পোশাক পরিধানের ক্ষেত্রে খুবই সচেতন হতে হবে। নতুবা দর্শক কিন্তু আপনাকে নিতে পারবে না। আর সংবাদ উপস্থাপককেও এজন্য নিউজ পড়তে আসার আগে আজকের চলমান নিউজ বা ব্রেকিং ইস্যুগুলো দেখে ঘর থেকে বের হতে হবে; নতুবা কোন বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেলে বা আপনি আগে থেকে চকমকা ড্রেস পরে আসার অভিপ্রায় থাকলেও, সেটা পরিবর্তন করে শোকের পোশাক পরিধানের প্রস্তুতি নিয়ে অফিসে আসতে হবে। নতুবা বিষয়টি খাপছাড়া খাপছাড়া লাগবে।
জাগো জবস : দেশে ভালো মানের উপস্থাপক তৈরি হচ্ছে না কেন?
আব্দুন নূর তুষার : না, আমি বলবো না যে দেশে ভালো মানের প্রেজেন্টার একেবারেই নেই। এখনও দেশে বহু ভালো মানের প্রেজেন্টার রয়েছে। তবে সামনের দিনগুলোতে ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্জনে আমাদের আরো কাজ করতে হবে। সেজন্য এ পেশায় জড়িতদের আরো প্রফেশনাল হতে হবে। আসলাম আর অটোকিউ দেখে অনুষ্ঠান উপস্থাপন করে চলে গেলাম- এমনটা করে ভালো উপস্থাপক হওয়া সম্ভব না। প্রচুর পরিশ্রম করতে হবে। যতটা সম্ভব জ্ঞানের পরিধি বাড়াতে হবে। দেশ এবং বিশ্বসেরা প্রেজেন্টারদের ফলো করাও যেতে পারে।
জাগো জবস : অনেকেই হঠাৎ করেই বনে যান অনেক কিছু, আবার কিছুদিন পর হারিয়েও যান; এ নিয়ে আপনার অভিমত?
আব্দুন নূর তুষার : হ্যাঁ, এটা ঠিক সেলিব্রেটি হয়ে গেলে তিনি তার লাইনের বা বিষয়বস্তুর সঙ্গে যায় এমন কিছুর সঙ্গে তিনি নানা রূপে স্ক্রিনে হাজির হতেই পারেন। যেমন আমরা অমিতাভ বচ্চনকে ‘কোন বনে গা ক্রোরপতি’ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক হিসেবে দেখতে পাই। তবে কথা হচ্ছে আমাদের দেশে সেটা কতটা যৌক্তিক ভাবে হচ্ছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তিনি তার সেক্টরেই এখনো ততটা সফলতা বা সার্থকতা দেখাতে পারলেন না, অথচ অন্যসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। যার দরুণ- তিনি নিজের লাইনেও যেমন মেলে ধরতে ব্যর্থ হন, ঠিক তেমনি মিডিয়ার অন্য লাইন বিশেষ করে উপস্থাপনায় আসলেও কিছুদিন পর আর দেখা যায় না।
জাগো জবস : প্রেজেন্টেশনের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ এককথায় জেন্ডার ইস্যু বা বয়সটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
আব্দুন নূর তুষার : আমার কাছে জেন্ডার এবং বয়স কোনো ম্যাটার করে না। আমি বলবো, যাকেই অনুষ্ঠানের হটসিটে বসানো হোক, তার পুরো বিষয় যেন বিষয়বস্তুর সঙ্গে যায়। তাতে তাকে যেভাবে, যে বয়স বা জেন্ডারের দরকার, সেভাবেই নেয়া যেতে পারে। তবে অবশ্যই তাকে যোগ্য, দক্ষ ও ঐ বিষয়টির সঙ্গে যুতসই, এমন কাউকে বসানো উচিৎ। তা হতে পারে ছেলে, মেয়ে বা যেকোনো বয়সের। বিশেষ কোনো বয়স বা জেন্ডারের উপর দুর্বলতা উপস্থাপনা শিল্পকে নষ্ট করবে বৈকি!
জাগো জবস : সব মিলিয়ে উপস্থাপনা বিষয়টি নিয়ে আপনার অভিমত কী?
আব্দুন নূর তুষার : সময় এসেছে সামনে এগিয়ে যাবার। দেশে এখন অনেক মিডিয়া। এ পেশায় এখন অনেক যোগ্য এবং শিক্ষিত লোক কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। তাই আমরা যারা উপস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত হতে চাই, তারা যেন ভালোবেসে যেমন কাজটিতে এসেছি, ঠিক তেমনি যেন পেশাটিতে সফল হতে পরিশ্রম করতেও তৎপর থাকি। মনে রাখতে হবে, ব্যক্তি বিশেষের আলসেমিতে প্রেজেন্টেশন যে একটা আর্ট- সেটা যেন প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। তাহলেই একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে আমি সবচেয়ে খুশি হবো।
জাগো জবস : আমাদেরকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
আব্দুন নূর তুষার : আপনাকেও ধন্যবাদ।
এসইউ/আরআইপি