তনিমা সিদ্দিকী শ্বেতার উদ্যোক্তা হওয়ার গল্প
সবারই হয়তো ছোট-বড় স্বপ্ন থাকে। তনিমা সিদ্দিকী শ্বেতারও একটি স্বপ্ন ছিল। কিছু করার ইচ্ছা ছিল। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই স্বপ্নটি ডানা মেলতে শুরু করেছিল। এমন কিছু করতে চাইতেন, যার সব কিছুতেই থাকবেন তিনি। তবে তার জন্য তা বাস্তবায়ন করা খুব কঠিন ছিল না। ফলে তিনি স্বপ্নের পথেই হাঁটতে শুরু করলেন।
তনিমা সিদ্দিকী শ্বেতা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। তবে উদ্যোক্তা হবো এমন কোনো পরিকল্পনা তখনো ছিল না। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা হয়ে বেড়ে ওঠার কারণেই হোক আর নিজেকে অন্য ভাবে পরিচিত করার জন্যই হোক। মানুষের জন্য, সমাজের জন্য কিছু করার ইচ্ছে থেকেই হোক। সমাজব্যবস্থা পরিবর্তনের অদ্ভুত সব ছক আঁকাআঁকি করা, জেগে জেগে স্বপ্ন দেখার অভ্যাস তাই আমার বেশ পুরোনো।’
নিজের অন্যান্য দিক সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হবো, মানব সেবা করবো। রিসার্চার হবো। জীব-জগতের কত সব রহস্য উন্মোচন করবো।আবার মানুষের তৈরি সমাজে পরিবর্তন আনবো। লেখাপড়ার সাথেই যেন কাটে আজীবন। পরিবর্তনের স্বপ্ন লালন করে, জন্ম, বেড়ে ওঠা, নাড়ির টান সবই যশোরকেন্দ্রিক। তবে বর্তমানে ঢাকায় থাকি। শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত আছি। যদিও নিজেকে যশোরের মেয়ে বলতেই বেশি সাচ্ছন্দ্যবোধ করি সব সময়।’
উদ্যোক্তা হওয়া সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘করোনার প্রাদুর্ভাবের পুরো সময়টি কেটেছে যশোরে। বাসায় বন্দি জীবন, বরাবরই অসহনীয় আমার কাছে। তার ওপর আপদকালীন মানসিক ভাবে কমবেশি বিশৃঙ্খল সময় কেটেছে ২০২০ জুড়ে। হঠাৎ মনে হলো, এটাই সময়। যেটাকে আমি কাজে লাগাতে পারি। এ অসময়কে কাজে লাগিয়ে মূলত যশোরের পণ্যগুলো পুরো দেশে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে কিছু একটা করার চেষ্টা শুরু করলাম। মানুষের দুর্ভোগ আর অসহায়ত্ব কিছুটা লাঘব করার জন্য খেটে খাওয়া মানুষদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করলাম।’
কাজ শুরু সম্পর্কে শ্বেতা বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগত ভাবে সব সময় খাঁটি, বিশুদ্ধ, নির্ভেজাল পণ্য নিয়ে খুব সচেতন থাকার চেষ্টা করি। আমার অনেক সহকর্মী আগে থেকেই আমার কাছ থেকে এসব খাঁটি, বিশুদ্ধ পণ্য নিয়ে ব্যবহার করতেন। যদিও সেটা আসলে বিজনেসের পর্যায়ে ছিল না। মানুষকে সাহায্য করাই প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। সেই সাথে পারিবারিক ভাবে যশোরে একটি মজবুত অবস্থান বরাবরই আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে, যেটা আমার প্লাস পয়েন্ট।’
উদ্যোক্তা হিসেবে এগিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘এরই মধ্যে বিষয়টিকে কাজে লাগালাম সোশ্যাল মিডিয়ায়। পরিচিত জনদের মাঝে জানাতে শুরু করলাম। অনলাইন পেজ খুলে সাজানো শুরু করলাম। পুরো বিষয়টি যত সহজে বলে ফেললাম, এতটা সহজ কিন্তু নয়। প্রথমে এ ধারণার সম্মুখীন হলাম, আমিও সেই গতানুগতিক দোকানদার বনে গেলাম! শেষ পর্যন্ত এটা করাই বাকি ছিল? এমন অনেক নেতিবাচক কথা এবং শব্দ শুনতে হয়েছে, ফেস করতে হয়েছে। ওই যে, লোকে কী বলবে? মান-সম্মান আর রইল না। আর যেসব খেটে খাওয়া মানুষদের নিয়ে শুরু করলাম! তাদেরও ধারণা হলো, এসব আমার খেয়াল-খুশি! এসব কি আমার পোষায়? তারাও যেন হকচকিয়ে গেল।’
পরিবারের সমর্থন সম্পর্কে এ উদ্যোক্তা বলেন, ‘আমার পরিবারের যথেষ্ট সাপোর্ট ছিল এবং আছে। আমার এত কষ্ট করাটা যেমন মানতে পারছিলেন না আমার মা-বাবা। তেমনই তাদের সাপোর্ট ছাড়া কিছুই আসলে সম্ভব নয়। আমার কাজের অনেকখানি জুড়েই তারা। আমার স্বামী সব সময়ই উৎসাহ এবং সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। আমার ছোট ছোট সন্তানরাও কিন্তু বাদ নেই। তাদের সবার এত সমর্থন না থাকলে চাকরি করে, সংসার সামলে উদ্যোক্তা হওয়া সত্যিই কঠিন ছিল।’
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে শ্বেতা বলেন, ‘আমার স্বকীয়তা আমার বৈশিষ্ট্য। আড়াই বছরে অনেকখানি এগিয়েছি। আমার পেজ Tehzeeb’s Galley এবং Apparel & More এর মাধ্যমে বেশ কিছু কাস্টমার তৈরি হয়েছে। আমি গতানুগতিক পন্থার বাইরে এসে নিজেকে প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছি। শুরুটা ঢাকা দিয়েই। তবে সেটি এখন ঢাকার বাইরের জেলাসহ দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি রিপিট কাস্টমার। আমার পণ্য যে ব্যতিক্রম, তা কিছুটা হলেও বোঝাতে সক্ষম হয়েছি। এটিই আমার অতি ছোট যাত্রার সফল প্রয়াস।’
সফলতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘এখনো কোনো কারখানা করা হয়নি। তবে যশোরে ৬-৭ জন এবং ঢাকায় ২-৩ জন সহযোগী নিয়ে কাজ করছি। এখন মাসে বিক্রি হয় প্রায় ৬০-৭০ হাজার টাকা। গুড়ের মৌসুমে সেটি লাখ ছাড়ায়। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হিসেবে কাজ শুরু করে শিখতে শুরু করেছি। সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্ত্বাবধানে সংগ্রহ করা খাঁটি গুঁড়া মশলা, ঘি, সরিষার তেল, নারিকেল তেল, প্রাকৃতিক মধু, চুই ঝাল, লাল চাল, লাল আটা, মাল্টিপারপাস আটা, খেজুরের গুড়, নলেন গুড়ের সন্দেশ, হাতের কাজের পোশাক, ধুতি, কুর্তি, স্কাটের ফিউশন, নকশিকাঁথা, চাদর, সুতি শাড়ি ইত্যাদি পণ্য নিয়ে কাজ করছি।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে শ্বেতা বলেন, ‘কিছু মানুষের উপকার করতে পারছি, মানুষকে ভেজালের বিরুদ্ধে সচেতন করতে পারছি। সততার সাথে কাজ করার শিক্ষা দিতে পারছি। মানুষের গতানুগতিক ধারণাকে পাল্টাতে পারছি। এটি খুব ছোট হলেও আমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার প্রথম সফল ধাপ। সামনে এ স্বপ্নের পূর্ণ বাস্তবায়ন হিসেবে এমন একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলতে চাই, যেটা কি না পুরো বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করবে।’
এসইউ/এএসএম