লেগে থাকার দৃঢ়তা এনে দেবে সফলতা
শিবু দাশ সুমিত
আশা দুই অক্ষরের একটি শব্দ হলেও কী অসীম তার শক্তি। এর কোনো শেষ নেই। আশার পালে ভর করেই মানুষ তার পুরো জীবন পার করে দিতে পারে। গ্রিক মিথোলজির ভাষায়, রাগ, ক্ষোভ, দুঃখ, হতাশা, আশা, জরা, ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, লোভ-লালসা, কামনা-বাসনা, প্লেগ, হিংসা-বিদ্বেষে পূর্ণ একটি বক্স থেকে শুধু আশা ব্যতীত সবকিছুই পৃথিবীতে ছড়িয়ে গেছে। আটকে পড়া আশা নিয়েই মানুষ তার জীবনের বাকি পথটুকু পাড়ি দিচ্ছে।
মানুষ স্বপ্ন দেখে ঘুমিয়ে আর আশায় বুক বাঁধে সচেতনভাবে। ঘুম ভেঙে গেলেই স্বপ্ন শেষ হয়ে যায়। তবে আশা আমৃত্যু বেঁচে থাকে। আপনি এ মুহূর্তে কোথায় আছেন সেটা জরুরি নয়, আসলে আপনি কোথায় যেতে চান; সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ঘাত-প্রতিঘাত অসংখ্যবার আসবে। তাই বলে ভেঙে পড়া যাবে না। জিততে শেখার চেয়ে বেশি জরুরি হলো হেরে গেলে সেটি মেনে নেওয়ার মানসিকতা। ঠিক এ জায়গাতেই আমরা বারবার হেরে যাই!
আশা বা স্বপ্ন যাই বলি না কেন, তাতে বিশ্বাস রাখতে হবে। কারণ বিশ্বাস এক অদ্ভুত ও বিপুল শক্তি। এটা কোনো ম্যাজিক বা অলৌকিক বিষয় নয়। বাইবেলে আছে, ‘টপ অব দ্য হিলে সব সময় একা যেতে হয়।’ আপনি যখন কোনো পর্বত শৃঙ্গের সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহন করবেন, তখন কেবল আপনিই সেখানে অবস্থান করতে পারবেন। হয়তো এ কারণে তেনজিং ও হিলারি সর্বোচ্চ শিখরে একসঙ্গে অবস্থান করতে পারেননি। সুতরাং আপনার কাজ আপনাকেই করতে হবে। এ পথে আপনি একজন রাজার মতোই অসম্ভব একা। রাজা নিঃসঙ্গ, কারণ সিংহাসন তো একটি। আর একই সিংহাসনে একসঙ্গে দু’জন বসতে পারেন না।
মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। বালি ভেজা পায়ে, জুতার ঘর্ষণে, রক্তের ক্ষরণে, রোদে ভেজা শরীরে খড়ি ফোটে পুরোনো চামড়ায়। অনিশ্চিত গন্তব্যের পথে অভিলাষে জেগে থাকে মন স্বপ্ন ছোঁয়ার প্রতীক্ষায়। পৃথিবীতে সবাই জিততে আসেনি। একসঙ্গে সবার জয় হবে, সেটা আদতে সম্ভবও নয়। কেউ জিতবে আবার কেউ হারবে। হার বা জয় পাশাপাশি আছে বলেই তাদের একটির গুরুত্ব বেশি। অন্যটি অধিকাংশের দৃষ্টিতেই একটু কম।
সফলতার বিপরীত শব্দই কিন্তু ব্যর্থতা। চাণক্যের মতে, ব্যর্থতা নিয়ে কখনোই আতঙ্কিত হওয়া উচিত নয়। জীবনে সাফল্য ও ব্যর্থতা পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। ব্যর্থতা এলে জীবনে সাফল্য আসবেই। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এমন যে, ছোটকাল থেকেই শেখানো হয় তোমাকে প্রথম হতে হবে বা তোমাকে অবশ্যই জিততে হবে। সেই থেকে যে জীবনের অসীম দৌড় শুরু হয়, সেটি শেষদিন পর্যন্ত চলতে থাকে।
মন খারাপের সময় যখন আমাদের উচিত মানুষটার পাশে দাঁড়ানোর, তখন আমরা সব আক্রোশ নিয়ে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। অমুক পারলে তুমি পারবে না কেন? এ প্রশ্নে বা অপমানের গ্লানিতে অনেকে জীবনকে চিরতরে ছুটি দেয়। আমরা সব সময় সাফল্যের চিন্তায় মগ্ন। পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে হবে, সবার চেয়ে ভালো করতে হবে, বড় চাকরি পেতে হবে; ব্যস তুমি সফল।
সবাইকে দিয়ে যে একই কাজ হবে না, আমরা সেটা বুঝতে চাই না। সবার পেশা বা ইচ্ছাও কখনো এক হবে না। এখানে কেউ কবিতায় তার সুখ খুঁজে নেবে, কেউ গানে গানে হারাবে, কেউ মেঘ হবে আবার কেউ বা রোদ্দুর হয়ে চারপাশ আলোকিত করবে। ইচ্ছের এতটা বৈচিত্র্য আছে বলেই ধরণী এত মায়াময়, এত সুন্দর। ইচ্ছেরা ফুল হয়ে ফুটুক আর সুবাস হয়ে চারপাশ মুখরিত করুক, এটাই তো আমাদের চাওয়া উচিত।
সফলতার পাশাপাশি ব্যর্থতার পাঠও জরুরি। আমরা যে আবেগ, চিন্তা-ভাবনা ও মূল্যবোধ লালন বা ধারণ করি, তার সবই আমরা কোথাও না কোথাও থেকে শিখেছি। আর এর মাধ্যমেই আমরা দৈনন্দিন পরিচালিত হচ্ছি। সাফল্যের এ ধারণা বস্তুতপক্ষে আমার বা আপনার নিজের তৈরি নয়। এটি সমাজের তৈরি করে দেওয়া কিছু রীতিনীতি। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসার কারণে আপনার ধর্ম, সমাজ ও সংস্কৃতি আপনাকে শেষ পর্যন্ত এটা বোঝাতে সমর্থ হয়েছে যে, এটাই ঠিক। এটাই আপনাকে মেনে চলতে হবে বা এর থেকে আপনি কখনো ভিন্ন পথে যেতে পারবেন না। আপনার অঢেল অর্থ, অপরিসীম ক্ষমতা; তার মানে এই নয় যে, আপনি জীবনে সফল।
ব্যক্তিভেদে আসলে এ সফলতা বা ব্যর্থতার অর্থে ভিন্নতা দেখা যায়। আপনি কী পেলেন আর কী পেলেন না; তার উপরও এ পৃথিবীতে আপনার সফলতা বা ব্যর্থতা নির্ভর করে না। অন্য কারোর চিন্তাধারার দাস হয়ে না ওঠা, নিজের ভালো লাগার কাজটা করা, নিজের সুখের জায়গাটার সঙ্গে প্রতারণা না করা; সেটাই প্রথম ও প্রধান সাফল্য। জীবনে সফল হবেন যখন আপনি জানবেন, কীভাবে আনন্দের সঙ্গে চলতে হয়, যতটুকু আছে তা দিয়েই আপনার সব চাহিদা মেটানো সম্ভব। তা সে নরকের মধ্য দিয়ে হলেও। বলা যায়, কেউ প্রকৃতপক্ষে ব্যর্থ হয় না। হাল ছেড়ে দিলে বা ধৈর্য হারিয়ে ফেললেই শেষ পর্যন্ত হার মেনে নিতে হয়।
ধার করা একটি গল্প বলি, এক কৃষক হতাশ ছিলেন। প্রকৃতি তার ফসলের গুণাগুণ নির্ধারণ করে বলে। একদিন তিনি সৃষ্টিকর্তাকে বললেন, ‘আমি প্রকৃতির নানা উদ্ভট কার্যকলাপে ক্লান্ত। সবকিছু ভুল সময়ে হচ্ছে। আপনি এগুলো আমার হাতে ছেড়ে দিন।’ সৃষ্টিকর্তা বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে, আজ থেকে প্রকৃতি তোমার হাতে।’
তারপর কৃষক তার ফসলের পরিকল্পনা করলেন। তিনি বৃষ্টিকে ডাকলেন, ‘বৃষ্টি আয়!’ আর বৃষ্টি চলে এলো। তিনি জমিতে আঙুল ঢুকিয়ে দেখলেন ঠিক আছে। ছয় ইঞ্চি অবধি মাটি ভিজে গেছে। এরপর বললেন, ‘বন্ধ হয়ে যা!’ তারপর তিনি জমিতে লাঙল চালিয়ে ভুট্টার বীজ বপন করে দুদিন অপেক্ষা করলেন। বৃষ্টি! তারপর রোদ! একদিন তিনি জমিতে কাজ করছিলেন, সব কিছুই
তার ইচ্ছামতো হলো। কৃষক ভাবলেন, হয়তো ভুট্টার ফলন এবার বেশ ভালো হবে। খুবই আনন্দে ছিলেন।
যখন ফসল কাটার সময় এলো, চেয়েছিলেন যাতে কোনো পাখি না আসে। প্রথম থেকেই কোনো পাখি সেখানে ছিল না। তিনি জমিতে গেলেন ফসল কাটতে। যখন ফসলগুলোর দিকে তাকালেন, দেখলেন গাছগুলোর মধ্যে কোনো ফল আসেনি। তখন ভাবলেন, ‘এটা কী উদ্ভট ব্যাপার? আমি কী ভুল করলাম?’ তিনি কিছুই বুঝে উঠতে পারলেন না। কারণ সবকিছুই নিজে নিয়ন্ত্রণ করেছিলেন। বৃষ্টি, জল আর রোদ-সব সঠিক ভাবে।
তিনি সৃষ্টিকর্তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি সবকিছুই ঠিকভাবে করেছি কিন্তু গাছে কোনো ফল আসেনি। আপনি কি আমার ফসল নষ্ট করেছেন?’ সৃষ্টিকর্তা বললেন, ‘আমি সবকিছু দেখেছি; তুমি নিয়ন্ত্রণ করছিলে তাই আমি হস্তক্ষেপ করতে চাইনি। বৃষ্টি ভালো ছিল, রোদ ভালো ছিল, সবকিছুই ভালো ছিল কিন্তু তুমি সব বাতাস বন্ধ করে রেখেছিলে। আমি সব সময় তীব্র ঝড়-বাতাস পাঠাতাম। যা ফসলগুলোকে বিপর্যস্ত করে দিত। তাতে তারা উপড়ে যাওয়ার ভয় পেতো, তাই তাদের শিকড় মাটির আরও গভীরে পাঠাতো। তাই ফসল ফলত। এখন তোমার ভালো ভুট্টা গাছ হয়েছে কিন্তু ফসল আসেনি।’
ব্যর্থতা আছে বলেই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে নিজেদের শক্তিশালী করে নেওয়া যায়। আপনার জীবনে যদি খারাপ সময় না আসে তবে পরিস্থিতি অনেকটা ভুট্টা গাছের মতোই হতে পারে। মাঝে মাঝে হারতে হবে, স্থির হতে হবে। একটু থামার প্রয়োজন আছে; তাতে করে হয়তো কিছু ফুয়েল সঞ্চার করা যাবে পরবর্তী দিনগুলোর জন্য।
লেখক: সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, নড়াইল।
এমআইএইচ/এসইউ/জিকেএস