কর্মক্ষেত্রে নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই
সানজিদা শাহনাজের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথমেটিকসে অনার্স ও মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জনের পর ৩৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তা হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন।
বগুড়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদে যোগদানের পর ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজবাড়ী সদর উপজেলার সহকারী কমিশনার ভূমি (অ্যাসিল্যান্ড) পদে কর্মরত ছিলেন।
২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব পদে নিযুক্ত হন। এরপর ২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর চাঁদপুর সদর উপজেলা নির্বাহী কমকর্তা হিসেবে যোগদান করেন।
নারী দিবস উপলক্ষে সফল এ উপজেলা নির্বাহী কর্মকতা কথা বলেন জাগো নিউজের সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আন্তর্জাতিক নারী দিবস সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
সানজিদা শাহনাজ: নারীর অধিকার নারীর সুরক্ষা নারীর ক্ষমতায়ন—এ বিষয়গুলোর উপর ভিত্তি করেই আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হয়। তবে নারীর অধিকার নিয়ে বছরে শুধু একটি দিন কথা বললেই হবে না। সব সময় নারীর অধিকার নিয়ে কথা বলতে হবে।
বছরের একটি দিন নারী দিবস হিসেবে পাওয়া অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। আমরা অনেক বছর ধরেই দিবসটি পালন করে আসছি। এ দিবসের মাধ্যমে সমাজের মানুষ সচেতন হচ্ছে। পাশাপাশি নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। কিন্তু এখনো আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা রয়ে গেছে। রাস্তা-ঘাটে চলাচলের জন্য নারীরা বাসের সামনে সিটে বসেন। অনেকে নারীর এ সুবিধার বিষয়টিকে বাঁকা চোখে দেখেন। কিন্তু নারীরা যখন পেছনের সিটে বসবেন, তখন পুরুষরাই তাকে নানাভাবে ডিস্টার্ব করবেন। সমাজ নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছে না। যখন একজন নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে; তখন তারা চাইবে না বাসের সামনের সিটটা দেওয়া হোক। তাই সমাজে বসবাসের জন্য সবার আগে নারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে।
জাগো নিউজ: বর্তমানের প্রেক্ষিতে নারী ক্ষমতায়নের বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখেন?
সানজিদা শাহনাজ: বর্তমানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সহায়তায় সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন যথেষ্ট গুরুত্ব পেয়েছে। সরকার নারী নীতির বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েছে। দেখুন আমাদের চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক একজন নারী। চাঁদপুরে জেলার আটটি উপজেলার পাঁচজন ইউএনও নারী এবং অ্যাসিল্যান্ডরাও নারী আছেন। বর্তমানে নারীরা কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে আসছে এবং সরকার তাদের যথাসম্ভব সহযোগিতা করছে। তাই আমি বলব, আগের তুলনায় নারীরা এখন ভালো অবস্থানে আছেন।
জাগো নিউজ: নারী হিসেবে কর্মক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হয়েছেন কি?
সানজিদা শাহনাজ: সমাজে নারীদের নানা প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। নারী কমকর্তা হিসেবে বলি, আর একজন সাধারণ নারী হিসেবে বলি। ছোটবেলা থেকেই নারীদের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়। অনেক সময় আমাদের প্রটোকল টিউটি বা মিটিংয়ে থাকতে হয়। সেখানে অনেক মানুষের ধাক্কাধাক্কি থাকে, এগুলো আমাদের ফেস করতে হয়। এ ছাড়াও ছোটখাটো কিছু প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। সাধারণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীদের কিছু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়। তবে আমি যদি নিজের কথা বলি। নারী কমকর্তা হিসেবে আমাকে তেমন প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হয়নি। আমি একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত ও মতামত প্রকাশ করতে পারছি। পাশাপাশি সরকারি কাজগুলোও করতে পারছি। এ অবস্থানে থেকে আমাকে তেমন কোন চ্যালেঞ্জ ফেস করতে হয়নি।
জাগো নিউজ: কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। কিন্তু কর্মপরিবেশ কতটা নারীবান্ধব?
সানজিদা শাহনাজ: নারীদের কর্মপরিবেশ ততটা সন্তোষজনক নয়। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে আগের তুলনায় কর্মপরিবেশ ভালোর দিকে যাচ্ছে। বিভিন্ন অফিসে সেবা প্রত্যাশী মায়েদের জন্য আলাদা রুম রাখা হচ্ছে। সন্তানকে দুধ খাওয়ানোর জন্য ল্যাক্টেটিং দুধ রাখা হয়। অফিসের নারী কর্মকর্তারা যাতে তাদের সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারে। সেজন্য আলাদা রুম করে দেওয়া হচ্ছে। নারীদের জন্য আলাদা নামাজের রুম ও ওয়াশরুম করা হচ্ছে। বিষয়গুলো দিন দিন উন্নতি হচ্ছে। আগে নারীরা তেমন সরকারি চাকরিতে আসতো না। যার কারণে অফিসগুলোয় আলাদা করে নারীদের রুম থাকতো না। কিন্তু এখন নারীরা কর্মক্ষেত্রে আসছে, যার কারণে দিন দিন নারীদের কর্মপরিবেশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
জাগো নিউজ: নারী উন্নয়নে পুরুষের ভূমিকা নিয়ে আপনি কী বলবেন?
সানজিদা শাহনাজ: কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’
নারী উন্নয়নে পুরুষের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুরুষদের সাপোর্ট ছাড়া নারীদের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই আমি মনে করি, নারীর উন্নয়নে পুরুষদের অবদান রাখা উচিত। পুরুষের স্বতঃস্ফূর্ত ভূমিকা ছাড়া নারী উন্নয়ন সম্ভব নয়।
জাগো নিউজ: আমাদের সমাজে গৃহিণীদের ভূমিকা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
সানজিদা শাহনাজ: আমাদের সমাজে যারা গৃহিণী আছেন। তাদের কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করা হয় না। কারণ গৃহিণীরা ঘরে থেকে অনেক কাজ করেন। একজন মা সন্তানকে লালন-পালন, তাকে স্কুলে আনা-নেওয়া ও বাসায় পড়াশোনা করাচ্ছেন। পাশাপাশি রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সমস্ত কাজ দেখাশোনা করছেন। তিনি যদি কাজগুলো না করতেন, তাহলে এগুলো করার জন্য লোক রাখতে হতো। বাচ্চাকে পড়াশোনার জন্য একজন টিচার রাখতে হতো। বাসার কাজের জন্য বুয়া ও সন্তান পড়াশোনার জন্য টিচার রাখলে তাদের টাকা দিতে হতো। একজন গৃহিণী কিন্তু একাই কাজগুলো করেন। ফলে অর্থনৈতিকভাবে কিছু টাকা সেভ হচ্ছে। একজন গৃহিণী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত কাজ করেন। কিন্তু তাদের কাজগুলোর যথাযথ মূল্যায়ন করা হচ্ছে না। এজন্য আমাদের সমাজের সবাইকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনি কাকে একজন সফল নারী বলবেন?
সানজিদা শাহনাজ: প্রতিটি নারীর আলাদা আলাদা চাহিদা রয়েছে। একেকজন নারীর স্বপ্ন একেক রকম। কেউ যদি স্বপ্ন দেখে ডাক্তার হবে এবং সে যদি ডাক্তার হতে পারে। তাহলে তার দিক থেকে সে সফল। আবার কেউ যদি স্বপ্ন দেখে একজন আর্দশ মা হবে এবং তার সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। সে যদি তা করতে পারে তবে সে সফল। বিষয়টি হচ্ছে, একজন নারী যেটা হতে চায় সে যদি তার লক্ষ্যে পৌঁছতে পারে, তবে সে সফল। কেউ যদি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে না পৌঁছেও তার বর্তমান অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট থাকে, সে ক্ষেত্রে সেও সফল নারী হিসেবে বিবেচিত হবে। আমার স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু আমি ইঞ্জিনিয়ার হতে পারিনি। তাই বলে আমি কিন্তু ব্যর্থ নই। আল্লাহর রহমতে আমি আমার বর্তমান অবস্থান নিয়ে সন্তুষ্ট। তবে বাল্যবিবাহের কারণে অনেক মেধাবী নারীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে তার ভবিষ্যৎ নষ্টের জন্য অবশ্যই সমাজ দ্বায়ী থাকবে। নারীদের এ ধরনের প্রতিবন্ধকতার জন্য পরিবার ও সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি পরিবার ও সমাজের সচেতনতা জরুরি। এ ছাড়াও পারিবারিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। স্কুলের শিক্ষকরা অভিভাবক সম্মেলন করে তাদের সচেতন করতে পারেন। দেখা যায়, শহরের তুলনায় গ্রামের অভিভাবকরা এসব বিষয় নিয়ে কম সচেতন। এ ছাড়াও গ্রামে বাল্যবিবাহের পরিমাণও বেশি। তাই গ্রামের পরিবার ও অভিভাবকদের সচেতন জরুরি।
জাগো নিউজ: যেসব নারী সমাজে এগিয়ে আসতে ভয় পান, তাদের উদ্দেশ্যে আপনি কী বলবেন?
সানজিদা শাহনাজ: বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশ। অতীতের তুলনায় দিন দিন দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। নারীর ক্ষমতায়নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যথেষ্ট আন্তরিক। বর্তমানে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেয়েরা এগিয়ে থাকে। পাশাপাশি বিভিন্ন পরীক্ষায়ও মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় রেজাল্ট ভালো করছে। আগে বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের তেমন অংশগ্রহণ দেখা যায়নি। কিন্তু বর্তমানে বিসিএসেও নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে এবং অনেকে ক্যাডার হচ্ছেন। নারী কোটার পাশাপাশি মেধাক্রমেও নারীরা দিন দিন উন্নতি করছে। তাই আমি বলব, নারীরা এখন আর পিছিয়ে নেই।
এসইউ/জিকেএস