নার্সিংয়ে ক্যারিয়ার: কোথায় পড়বেন, কী করবেন?
নার্সিং সেবামূলক একটি পেশা। এ পেশায় একদিকে যেমন মানুষের সেবা করা যায়; তেমনই আছে অনেক কর্মক্ষেত্র। এ পেশার বিভিন্ন বিষয় ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে জাগো নিউজের সাথে কথা বলেছেন নাছিমা আক্তার মুক্তা। যিনি নার্স শিক্ষক হিসেবে মহাখালীর কলেজ অব নার্সিং এবং অতিরিক্ত দায়িত্বে ঢাকার নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তরের শিক্ষা শাখায় কর্মরত। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার জীবনের গল্প শুনতে চাই—
নাছিমা আক্তার মুক্তা: আমার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার মনসা গ্রামে। বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অবসরপ্রাপ্ত বেসরকারি চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। ২০০০ সালে বিজ্ঞান শাখা থেকে ১ম বিভাগ নিয়ে এসএসসি পাস করি। তারপর কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু কিছু কারণে পরে আর এইচএসসি সম্পন্ন করা হয়নি। আবার নতুন করে শুরু করি এগিয়ে চলা। বন্ধুরা পরীক্ষার পরে ভাবতে লাগলো কে কোথায় ভর্তি হবে। তারপর এক বান্ধবী বলল সে নার্সিংয়ে ভর্তি হবে। ভাবলাম আমিও নার্সিংয়ে ভর্তি হবো। তারপর নার্সিংয়ে ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে ২০০২ সালে নার্সিং ইনস্টিটিউট রাঙ্গামাটিতে ভর্তি হই। ২০০৬ সালে সেখান থেকে চার বছরের কোর্স ‘ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি’তে সফলতার সাথে ডিপ্লোমা পাস করি। কিছুদিনের মধ্যে চট্টগ্রামে একটি বেসরকারি ক্লিনিকে চাকরি জীবন শুরু করি। তারপর ২০১০ সালে বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সরকারি চাকরি হয়। তখন নার্সিং নিয়ে আরও পড়াশোনা করার চেষ্টা করি। নার্সিংয়ে স্নাতক করার জন্য ২০১২ সালে চট্টগ্রাম মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফৌজদারহাট নার্সিং কলেজ চট্টগ্রামে পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সে ভর্তি হই। ২০১৪ সালে সফলতার সাথে স্নাতক পাস করি। এরপর ২০১৮ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) থেকে হেলথ সার্ভিস ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড পলিসি বিষয়ে মাস্টার অব পাবলিক হেলথ (এমপিএইচ) পাস করি।
জাগো নিউজ: পেশা হিসেবে নার্সিং কেমন?
নাছিমা আক্তার মুক্তা: পেশা হিসেবে নার্সিং অবশ্যই ভালো। কারণ নার্সিং এমন একটি পেশা, যেখানে খুব কাছে থেকে মানুষের সেবা করা যায়। অসুস্থ অবস্থায় যখন একজন রোগী হাসপাতালে আসেন; তখন আমাদের সেবা-শুশ্রূষায় রোগী সুস্থ হয়ে ওঠেন। বর্তমানে নার্সিংয়ে অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। দেশ ও দেশের বাইরে নার্সদের চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। বর্তমানে যে কেউ নার্সিং কোর্স শেষ করার পর চাকরি পাবেন। দেশে নার্সিংয়ে অনেক কাজের ক্ষেত্র আছে। কেউ যদি সরকারি চাকরি না-ও পান, তাহলে বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, নার্সিং কলেজ ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে কাজ করার সুযোগ পাবেন। বেকার বসে থাকার সুযোগ কম। এ ছাড়া বিদেশে কাজ এবং উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। সে ক্ষেত্রে আমি মনে করি, নার্সিং একটি যুগোপযোগী পেশা।
জাগো নিউজ: বাংলাদেশে নার্সিং পড়াশোনার ধাপগুলো কী কী?
নাছিমা আক্তার মুক্তা: আমাদের দেশে নার্সিংয়ে পড়াশোনায় বিভিন্ন ধাপ আছে। যেমন: ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি (৩ বছর) ও ৬ মাস ইন্টার্নশিপ, বিএসসি ইন নার্সিং (৪ বছর) ও ৬ মাস ইন্টার্নশিপ, মাস্টার অব সায়েন্স ইন নার্সিং (২ বছর)। ২০০৮ সাল থেকে শুরু হয়েছে বিএসসি ইন নার্সিং। বিএসসি ইন নার্সিংয়ের দুটি ধাপ আছে।
এক. বিএসসি ইন নার্সিং (৪ বছর)। এইচএসসি পাস করে সরাসরি করা যায়। তারপর এমএসসি ইন নার্সিং (২ বছর), এমপিএইচ ও অন্যান্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন।
দুই. পোস্ট বেসিক বিএসসি ইন নার্সিং (২ বছর)। যারা ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি (৩ বছর) সম্পন্ন করে তারা এটি করতে পারেন। তারপর এমএসএন, এমপিএইচ ও অন্যান্য বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করতে পারবেন।
জাগো নিউজ: শিক্ষাগত যোগ্যতা কেমন লাগে?
নাছিমা আক্তার মুক্তা: ডিপ্লোমা ইন নার্সিং সায়েন্স অ্যান্ড মিডওয়াইফারি কোর্সটি করতে এসএসসি এবং এইচএসসি সনদ লাগবে। যে কোনো বিভাগ থেকে কোর্সটি করা যাবে। সে ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় মিলে ৬.০০ সর্বনিম্ন থাকতে হবে। আর বিএসসি ইন নার্সিং কোর্সটি শুধু বিজ্ঞান বিভাগ থেকে করা যাবে। সে ক্ষেত্রে এসএসসি ও এইচএসসি উভয় মিলে ৭.০০ সর্বনিম্ন এবং আলাদাভাবে জীববিজ্ঞান বিষয়ে ৩.০০ পয়েন্ট থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: কোথায় কোথায় ভর্তি হওয়া যায়?
নাছিমা আক্তার মুক্তা: নার্সিং পড়ার জন্য বাংলাদেশে সরকারিভাবে সবমিলিয়ে ৬৮টি প্রতিষ্ঠান আছে। এ ছাড়াও বেসরকারি অনেক নার্সিং কলেজ ও ইনস্টিটিউট আছে। ঢাকায় জাতীয় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান আছে, সেখান থেকে এমএসসি নার্সিং কোর্স করা হয়।
নার্সিং কোর্সসমূহ করার জন্য অবশ্যই ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। সাধারণত নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর, বাংলাদেশ নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল (বিএনএমসি) ও সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় পত্রিকা ও ওয়েবসাইটে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে। তারপর অনলাইনে ফরম পূরণ ও প্রবেশপত্র ডাউনলোড করতে হয়। ভর্তি পরীক্ষায় ১০০ নম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা হয়। সারাদেশে একযোগে ভর্তি পরীক্ষা হয়ে থাকে। এরপর মেধাক্রম ও পছন্দ অনুযায়ী সরকারি নার্সিং কলেজের নির্ধারিত আসনে ভর্তি হতে পারবেন। কেউ সরকারিতে চান্স না পেলে বেসরকারি কলেজ ও বিভিন্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকবে। তা ছাড়া সরকারি নার্সিং কলেজে পড়ার জন্য তেমন টাকা লাগে না। শুধু ভর্তির সময় নির্ধারিত ফি ও পরীক্ষার ফি দিতে হয়। উপরন্তু এখানে শিক্ষার্থীদের প্রতিমাসে মাসিক বৃত্তি দেওয়া হয়। তবে বেসরকারি পর্যায়ের কলেজ ও ইনস্টিটিউটগুলোয় খরচ প্রতিষ্ঠানভেদে একটু কমবেশি হয়ে থাকে।
জাগো নিউজ: দেশে নার্সিংয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ-সুবিধা কেমন?
নাছিমা আক্তার মুক্তা: আমাদের দেশে নার্সিং পেশাটি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আগে সুযোগ-সুবিধা কিছুটা কম থাকলেও বর্তমানে উচ্চশিক্ষার অনেক সুযোগ আছে। আগে স্নাতকোত্তর করার জন্য কোনো নার্সিং কলেজ ছিল না। বর্তমানে জাতীয় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (নিয়ানার), কুমুদিনী নার্সিং কলেজ থেকে এমএসসি নার্সিং কোর্স করা যায়। সম্প্রতি সরকারিভাবে উচ্চশিক্ষার জন্য আরও নয়টি কলেজ ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেক নার্সিং কলেজে এমএসসি কোর্স চালু করার প্রশাসনিক অনুমোদন হয়েছে। নার্সিংয়ে জাতীয় নার্সিং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে (নিয়ানার) মাস্টার্স করার পাশাপাশি নার্সরা বিএসএমএমইউর অধীনে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব প্রিভেন্টিভ অ্যান্ড সোশ্যাল মেডিসিন (নিপসম) থেকেও সরকারিভাবে পাবলিক হেলথের ওপর চারটি বিষয়ে মাস্টার্স করতে পারেন। নিপসমই শুধু এমন একটি প্রতিষ্ঠান, যেখান থেকে ডাক্তার এবং নার্স একই সাথে একই ক্লাসরুম শেয়ার করার সুযোগ পান। তা ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নার্সিং সংশ্লিষ্ট কিছু বিষয়ে নার্সরা তাদের স্নাতকোত্তর করার সুযোগ পান। জেরোন্টোলজি অ্যান্ড জেরিয়াট্রিক ওয়েলফেয়ার, ক্লিনিক্যাল অ্যান্ড সোশ্যাল ওয়ার্ক, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। বর্তমানের সাথে তাল মিলিয়ে এ বিষয়গুলোর চাহিদা দেশে-বিদেশে সমান হারে বাড়ছে।
জাগো নিউজ: নার্সদের বিদেশে কী কী উচ্চশিক্ষা নেওয়ার সুযোগ আছে?
নাছিমা আক্তার মুক্তা: বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য নার্সদের অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে। সাধারণত শিক্ষার্থীরা এমএসসি, পিএইচডি ও অন্যান্য ডিগ্রি নিতে বিদেশ যান। বিদেশে পড়ার ক্ষেত্রে যে দেশে যাবেন, সে দেশের প্রতিষ্ঠানের শর্ত পূরণের মাধ্যমে স্কলারশিপ নিয়ে যেতে পারবেন। তা ছাড়া বিভিন্ন কলেজে স্কলারশিপ দিলে শর্ত পূরণের মাধ্যমে সরকারিভাবেও উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়া য়ায়। বর্তমানে বাংলাদেশিরা যুক্তরাজ্য, কানাডা, থাইল্যান্ড, কোরিয়া ও চীনকে উচ্চশিক্ষার জন্য বেছে নেন।
জাগো নিউজ: স্বাস্থ্যখাতে নার্সদের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। আপনারা কতটুকু মূল্যায়ন পাচ্ছেন?
নাছিমা আক্তার মুক্তা: অবশ্যই স্বাস্থ্যখাতে নার্সদের ভূমিকা আছে। আমাদের দেশে হেলথ কেয়ার প্রোভাইডারের চেয়ে রোগীর সংখ্যা তুলনামূলক বেশি। তারপরও নার্সরা সার্বক্ষণিক রোগীদের পাশে থাকেন। তাদের সেবা দিয়ে সুস্থ করে তোলেন। এমনকি কেউ দুর্গম এলাকায় কোনো হাসপাতালে গেলে, সেখানে কাউকে না পেলেও কিন্তু একজন নার্সকে অবশ্যই পাবেন।
মূল্যায়ন বলতে, আগে নার্সরা ৩য় শ্রেণির কর্মকতা ছিলেন। বর্তমান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নার্সিং পেশাকে ২য় শ্রেণিতে উন্নীত করেছে। তা ছাড়া ১ম শ্রেণিতে প্রমোশনের সুযোগ আছে। শিক্ষার মানও আগের থেকে উন্নত হয়েছে। সে ক্ষেত্রে মূল্যায়নটা আগের চেয়ে বেড়েছে। তবে এখনো কিছু কিছু জায়গায় নার্সদের সামাজিকভাবে অন্য চোখে দেখা হয়। অনেকে ভালোভাবে নিতে চান না। কিন্তু নার্সরা যে সমাজে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ, তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাই। জনগণ যেন নার্সদের সম্মান করেন এবং আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেন, সেই প্রত্যাশা থাকবে।
জাগো নিউজ: যারা নার্সিংয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ—
নাছিমা আক্তার মুক্তা: নার্সিংয়ে ভালো ক্যারিয়ার গঠনের সুযোগ আছে। আগে সুযোগ-সুবিধা কম থাকলেও বর্তমানে দেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ আছে। তা ছাড়া বর্তমানে নার্সিং পেশায় প্রচুর কর্মক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। দিন দিন হাসপাতালের সংখ্যা বাড়ছে। সেইসাথে দেশ ও দেশের বাইরে কাজের চাহিদা বাড়ছে। নার্সিং একটি আন্তর্জাতিক মানের ভার্সেটাইল পেশা। এ বিষয়ে পড়ে যে কেউ যেমন নার্স হতে পারবেন, পাশাপাশি অন্য পেশায়ও সুইচ করতে পারবেন। কেউ যদি গ্রাজুয়েট নার্স হন, তিনি চাইলেই জেনারেল বিসিএস দিয়ে একজন ১ম শ্রেণির গেজেটেড অফিসার হতে পারবেন। আবার একজন পুলিশের এসআই এবং ব্যাংকের এক্স ক্যাডার নার্সিং অফিসার হতে পারবেন। তখন কর্মক্ষেত্র হবে বিশাল। কেউ চাইলে ফাইভ স্টার হোটেল ও গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে ভূমিকা রাখতে পারবেন। বাংলাদেশে থেকেও আকাশ ছোঁয়া বেতন পেতে পারেন আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোয় যোগদান করে। এ ছাড়া যোগদান করতে পারবেন বিভিন্ন দূতাবাসে, যেখানে আছে উন্নত সব সুযোগ-সুবিধা। তাই আমি বলবো, তরুণরা নার্সিং পেশায় আসুক। দেশ ও মানব সেবাসহ অর্থনৈতিক উন্নয়নের কাজে এগিয়ে আসুক।
এসইউ/জিকেএস