বিসিএসকে কখনোই জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য ভাবেননি ইমরান
মো. ইমরান আহম্মেদের জন্ম পটুয়াখালীর রাঙ্গাবালী উপজেলার চরমন্তাজ ইউনিয়নের চরমন্তাজ গ্রামে। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোয় উচ্চতর ডিগ্রির জন্য পড়াশোনা করছেন। তিনি বাংলাদেশ পুলিশের মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি শাখার সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (সিনিয়র এএসপি) হিসেবে কর্মরত। ৩৪তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে যোগ দেন।
সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খালিদ সাইফুল্লাহ্—
জাগো নিউজ: প্রথমেই আপনার ছোটবেলা ও শিক্ষাজীবন সম্পর্কে জানতে চাই—
মো. ইমরান আহম্মেদ: ছোটবেলা কেটেছে চরমন্তাজে। ভৌগলিক অবস্থানের দিক বিবেচনায় চরমন্তাজ চারদিক থেকেই নদী ও বঙ্গোপসাগরে ঘেরা। সেখানকার চরমন্তাজ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, চরমন্তাজ এ সাত্তার মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা লাভ করেছি। চরমন্তাজের প্রথম কোনো শিক্ষার্থী হিসেবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে বৃত্তি, এসএসসিতে এ-প্লাস পেয়েছি। গলাচিপা ডিগ্রি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হই। সেখান থেকে আমি বিএসএস (সম্মান) ও এমএসএস ডিগ্রি অর্জন করি। বাংলাদেশ পুলিশে চাকরির সুবাদে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ থেকে মাস্টার্স অব পুলিশ সায়েন্স (এমপিএস) ডিগ্রি অর্জন করেছি। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপের অধীনে যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগোয় ‘মাস্টার্স অব ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম, জাস্টিস অ্যান্ড সিকিউরিটি’ বিষয়ে অধ্যয়ন করছি।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
মো. ইমরান আহম্মেদ: এখনকার চরমন্তাজের সাথে ১৫-২০ বছর আগের চরমন্তাজকে মেলানো কঠিন। আমরা যখন প্রাথমিকে পড়তাম, যতটুকু মনে পড়ে আমাদের বিদ্যালয়ই ইউনিয়নের একমাত্র মরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। আমাদের দু’জন শিক্ষক ছিলেন। তারাই প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত সব ক্লাস নিতেন। তারা মনে করতেন, আমি পড়াশোনায় ভালো। তাই মাঝেমধ্যে তাদের সহযোগিতা করতাম। যেমন চতুর্থ শ্রেণিতে থাকাকালে নিয়মিতই দ্বিতীয় শ্রেণির অঙ্ক করাতে হতো। যতদিন সেখানে ছিলাম, আমার শিক্ষকদের সহযোগিতার চেষ্টা করেছি। মাধ্যমিক পর্যায়েও শিক্ষকের সংখ্যা অপ্রতুল ছিল। আমি বিজ্ঞান বিভাগে পড়তাম, কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগের কোনো সুবিধাই আমাদের ছিল না। একজন কৃষি বিষয়ে শিক্ষক ছিলেন, তিনিই বিজ্ঞান বিভাগের বিষয়গুলো পড়াতেন। ল্যাবরেটরি কী জিনিস, তা মাধ্যমিক পর্যায়ে কখনোই দেখিনি। তবে কলেজ পর্যায়ে পড়াশোনার ভালো ব্যবস্থা ছিল।
জাগো নিউজ: কততম বিসিএসের কোন ক্যাডারে আছেন?
মো. ইমরান আহম্মেদ: আমি ৩৪তম বিসিএসের মাধ্যমে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করি। সেটিই আমার প্রথম বিসিএস। বাংলাদেশ পুলিশে যোগদানের পর সারদার বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমি থেকে মৌলিক প্রশিক্ষণ শেষ করেছি। প্রথম কর্মস্থল ছিল ঝালকাঠি জেলা পুলিশ। এরপর বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশে কাজ করেছি। এরপর থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে কর্মরত আছি। এখানকার মিডিয়া শাখায় কাজ করেছি। বর্তমানে মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি শাখার সিনিয়র সহকারি পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত।
জাগো নিউজ: কখন বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন?
মো. ইমরান আহম্মেদ: সত্যি বলতে কী, আমরা যারা কলেজ পর্যায়ে ক্লাসে ফার্স্ট ছিলাম; তাদের মোটামুটি সবাই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পথ বেছে নিয়েছেন। আমি সম্ভবত ব্যতিক্রম পথে এসেছি। স্বপ্ন ছিল সরকারের বড় কর্মকর্তা হওয়ার। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করার পর একসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকও হতে চেয়েছিলাম। যা-ই হোক, আল্লাহ শেষপর্যন্ত পুলিশ বানিয়ে দিয়েছেন। এটি তারই ইচ্ছা ও দয়া।
জাগো নিউজ: পুলিশ হলেন কেন? পুলিশ হওয়ার পেছনে কী উদ্দেশ্য কাজ করেছে?
মো. ইমরান আহম্মেদ: দেখুন, নির্দিষ্ট করে কী হব, তা নির্ধারিত ছিল না। তবে পুলিশে যোগদানের পর পুলিশকে ঘিরেই আমার স্বপ্ন ও কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেছি। যেহেতু না চাইতেও পুলিশ হয়েছি; তাই সব সময় মনে করি আল্লাহ নিজে থেকে আমাকে চাকরিটি দিয়েছেন। এতেই তিনি আমার জন্য মঙ্গল রেখেছেন। তাই সর্বোতভাবে আল্লাহর দেওয়া এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে যত বেশি সম্ভব মানুষের সেবা করে যেতে চাই।
জাগো নিউজ: মিডিয়ার সঙ্গে কাজ কেমন উপভোগ করেন? কী কী চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়?
মো. ইমরান আহম্মেদ: আগে বাংলাদেশ পুলিশের মিডিয়া শাখায় কর্মরত ছিলাম। বর্তমানে মাল্টিমিডিয়া অ্যান্ড পাবলিসিটি শাখায় কর্মরত। জনগণের সেবা সহজ ও দ্রুত সময়ের মধ্যে নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ পুলিশের সার্বিক প্রচারের কাজের সঙ্গে যুক্ত আছি। বিশেষ করে বাংলাদেশ পুলিশের ভিজ্যুয়াল কন্টেন্ট তৈরি ও পাবলিসিটি সংক্রান্ত কাজগুলো আমার শাখা থেকে হয়ে থাকে। একসময়ে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের স্টাফ রিপোর্টার ছিলাম। কাজেই মিডিয়ার সঙ্গে কাজ ভালোভাবেই উপভোগ করি। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে বাংলাদেশ পুলিশ ও মিডিয়ার কাজের উদ্দেশ্য একই মনে হয়। এজন্য খুব বেশি চ্যালেঞ্জে হয়তো পড়তে হয়নি।
জাগো নিউজ: বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ ও প্রস্তুতির গল্প শুনতে চাই—
মো. ইমরান আহম্মেদ: অনার্স শেষ করেই অ্যাপিয়ার্ড (অস্থায়ী) সার্টিফিকেট দিয়ে বিসিএস পরীক্ষা দিয়েছি। কাজেই সে সময়ে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার মধ্যেই ছিলাম। তাই ভিন্ন করে বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। তবে আমার বিষয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান থাকায় বিসিএসের অনেক বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষয়গুলোর সঙ্গে মিল ছিল। এজন্য হয়তো এক প্রস্তুতিতে দুটি হয়ে গেছে। তবে আমার কাছে মনে হয়, বিসিএস একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। নিয়মিত বিষয়গুলোর সাথে পত্রপত্রিকা পড়লে, নতুন নতুন বিষয় জানার আগ্রহ থাকলে এবং যে কোন বিষয়ে গভীরভাবে জানলে বিসিএস সহজ হয়ে যায়। এরজন্য নির্ধারিত কিছু নোট বইয়ের বাইরে গিয়ে বিভিন্ন টপিক সম্পর্কে ইনডেপথ জ্ঞান অর্জনে দীর্ঘমেয়াদে যে কোনো ধরনের চাকরিতেই সুফল অর্জন সম্ভব।
জাগো নিউজ: কার কার কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন?
মো: ইমরান আহম্মেদ: নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের অনেকেই বিসিএস ক্যাডার হয়েছিলেন। যেহেতু তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় বিতর্ক করে জিতেছিলাম, অ্যাকাডেমিক রেজাল্টও ভালো ছিল, তাই নিজের মধ্যে একটি কনফিডেন্স ছিল। তবে এটি ঠিক, বিসিএসকে কখনোই আমার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করিনি। কারণ জীবন সব সময় অনেক বড় কিছু।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মো. ইমরান আহম্মেদ: সরকার যে বেতন ও সুযোগ-সুবিধা দেয়, তার শত-সহস্রগুণ দেশকে ফেরত দিতে চাই। দেশের এমন কোনো অর্জন এনে দিতে চাই বা শরীক হতে চাই, যা আগে কেউ অর্জন করে দিতে পারেনি। বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তিতে পরিণত করতে প্রত্যক্ষভাবে অংশীদার হতে চাই।
জাগো নিউজ: বিসিএস ইচ্ছুকদের প্রতি আপনার পরামর্শ—
মো. ইমরান আহম্মেদ: আগে ভাবুন, আপনি সত্যিই বিসিএস ক্যাডার হতে চান কি না? নিজেকে প্রশ্ন করুন, বারবার প্রশ্ন করুন। ভেবে দেখুন, চাকরিটি উপভোগ করবেন কি না? জীবনের লক্ষ্যের সঙ্গে চাকরিটির সামঞ্জস্য আছে কি না? দুঃসময়ে-দুর্দিনে চাকরিটি করতে পারবেন কি না? এসব ভাবার পরও যদি মনে করেন, আপনার বিসিএস ক্যাডার হওয়া উচিত। তাহলে একমুহূর্ত দেরী না করে ঝাঁপিয়ে পড়ুন। এক, দুই, তিন কিংবা চারবার ব্যর্থ হতে পারেন, তবুও পজিটিভ থাকুন। হাল ছাড়বেন না। আর যদি এক-দুই বারের ব্যর্থতায় মুষরে পড়েন, তাহলে ভাববেন, বিসিএস আপনার জন্য নয়। মুখস্থ নয়, বুঝে পড়ুন। পড়ার বা লেখার আগে পরিকল্পনা করুন। পজিটিভ মেন্টালিটি রাখুন আর সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস রাখুন সব সময়।
এসইউ/জিকেএস