আনসার ক্যাডারে প্রথম হন রাইড শেয়ার করা জুয়েল
মো. জুয়েল রানা ৩৮তম বিসিএসে আনসার ক্যাডারে প্রথম স্থান অধিকার করেন। তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা রংপুর জেলার পীরগঞ্জ উপজেলায়। ছয় ভাই-বোনের মধ্যে জুয়েল পঞ্চম। বাবা মো. বকস আলী কৃষক, মা আছমা বেগম গৃহিণী। জুয়েল ২০০৮ সালে পানবাজার ডি এম উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং ২০১০ সালে রংপুরের শাহ আব্দুর রউফ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
বর্তমানে তিনি সহকারী পরিচালক, ১ আনসার ব্যাটালিয়ন, ঠাকুরগাঁওয়ে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই—
জুয়েল রানা: শৈশবটা আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, পাওয়া না পাওয়ার মধ্যদিয়েই কেটেছে। পড়ার প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল বিশেষ করে নতুন বই পড়তে খুব ভালো লাগতো। এখন মনে হলে খুব হাসি পায়। আমি প্রাথমিকে পড়ার সময় অনেক স্কুল পরিবর্তন করেছি। বিশেষ করে ওই এলাকার কোনো ছেলের সঙ্গে মারামারি করে আর ওই স্কুলে যেতাম না। ফলে আমার বাসা থেকে চার-পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে যে কয়টি স্কুল আছে, সবগুলোয় ছয় মাস হলেও পড়েছি, যা-ই হোক, সে সময়ে জীবনের কঠিন বাস্তবতাগুলো বুঝতাম না। তবে একটি ঘটনা আমার মনে খুব ভাবনার সৃষ্টি করে, যখন আমার বাবা ৫ম শ্রেণির বৃত্তির একটি গাইড কিনে দিতে পারছিলেন না; তখন অভাবের বিষয়টি বুঝতে পারি। তখনই মনে মনে কঠিন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, কখনো অভাবের কাছে মাথা নত করবো না। মাধ্যমিক স্কুল আমার বাসা থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার দূরে ছিল। বেশিরভাগ সময়ই হেঁটে স্কুলে যেতাম। হালচাষ থেকে জমির সব ধরনের কাজ করতাম আব্বাকে সাহায্য করার জন্য। মনে আছে, আমার কলেজ লাইফে আমার বাবা একটি নতুন সাইকেল লোন করে কিনে দিয়েছিলেন। সাতদিনের মধ্যে সেটাও হারিয়ে ফেলি। শৈশবে এরকম নানা স্মৃতি আছে।
জাগো নিউজ: আপনার পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল?
জুয়েল রানা: আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। তার ওপর আমার ভাই-বোনের সংখ্যা বেশি। সুতরাং অভাবটাই বড় প্রতিবন্ধকতা ছিল। পুরো বংশে আমি প্রথম ইন্টারমিডিয়েট পাস করি। জীবনে দিকনির্দেশনা দেওয়ার মতো কেউ ছিলেন না। সব সময় নিজে কিছু করার চেষ্টা করতাম। বাড়ি থেকে তেমন সাপোর্ট নিতে পারিনি। অনার্সে থাকাকালীন তিন-চারটি টিউশনি করিয়েছি। প্রকাশনীতে প্রথমে লিফলেট বিতরণ করেছি। এরপর প্রুফ রিডার হিসেবে কিছুদিন কাজ করেছি। পড়াশোনা শেষ করে দীর্ঘদিন বসে ছিলাম। এসময় উবার, পাঠাওয়ের মাধ্যমে যাত্রী আনা-নেওয়া করতাম। এসময় রাত ৩-৪টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল ড্রাইভ করেছি। সব সময় বিশ্বাস করতাম, জীবনে বড় কিছু করতে হলে ভয়, লজ্জা ও ঘৃণা মুছে ফেলতে হবে। ভার্সিটির হলে ২৬টি রুম পরিবর্তন করতে হয়েছিল। এমনকি ৩৮তম বিসিএস লিখিত পরীক্ষা দেওয়ার সময়ও আমার হলের রুম তালাবদ্ধ ছিল। এভাবে লাইফে অনেক প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আসলে প্রতিবন্ধকতাই জীবনের সত্যিকার সৌন্দর্য। আপনি জীবনে যত বেশি প্রতিবন্ধকতা ফেস করবেন, সামনে এগিয়ে যাওয়ার তত বেশি সুযোগ তৈরি হবে বলে আমি বিশ্বাস করি।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
জুয়েল রানা: অনার্স প্রথম বর্ষে প্রথম বিসিএসের কথা শুনি। তখন মনে করতাম, এসব আমার দ্বারা হবে না। পরক্ষণে ভাবতাম, আমার মতোই তো কারও না কারও বিসিএস হয়।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই, প্রস্তুতি কীভাবে নিয়েছেন?
জুয়েল রানা: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সূর্যসেন হলের বিভিন্ন রুমে আমাকে শিফট করা হয়েছিল। এটি আমার জীবনের অন্যরকম অভিজ্ঞতা দিয়েছিল। হলে বড় ভাইদের খুব কাছ থেকে দেখতাম পড়াশোনা করছেন এবং বিসিএস দিচ্ছেন। তখন তাদের থেকে অনুপ্রেরণা পাই। পাশাপাশি তাদের দিকনির্দেশনায় অনার্স প্রথম বর্ষের শেষ নাগাদ পড়াশোনা শুরু করি। আমি কতটা পড়েছি, হলের বড় ভাই, ছোট ভাই ও বন্ধুরা বলতে পারবেন। একটি বই শেষ করে আরেকটি বই ধরতাম। অনেক পরিশ্রম ও ধৈর্য রেখে পড়াশোনা চালিয়ে গেছি। প্রথমে ৩৭তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি দেই। কিন্তু ভালো প্রস্তুতি না থাকায় ফলাফল নেগেটিভ আসে। ফাইনালি ৩৮তম বিসিএসে ক্যাডার পাই।
জাগো নিউজ: পর্দার আড়াল থেকে কেউ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে?
জুয়েল রানা: হলে থাকা অবস্থায় রুমমেট ও বড় ভাইদের কাছে বেশি অনুপ্রেরণা পাই। কারণ হলে একসঙ্গে একই টেবিলে পড়েছেন, এমন অনেকেই ক্যাডার হয়ে গেছেন। তাদের মধ্যে রুমমেট গোলাম রাব্বানী ৩৬তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার পেয়েছেন। তিনি আমাকে শিক্ষকের মতো পড়াতেন। খাতা কেটে দেওয়া এবং সার্বিক নির্দেশনা দিতেন। এছাড়াও জামিল আক্তার (এএসপি) এবং মোনাব্বেরুল হক মোনা (শিক্ষা ক্যাডার) ভাইদের কাছে সব সময় অনুপ্রেরণা পেয়েছি।
জাগো নিউজ: নতুনরা বিসিএস প্রিলির জন্য কীভাবে প্রস্তুতি শুরু করবেন?
জুয়েল রানা: বিসিএস ক্যাডার হওয়ার প্রাথমিক ধাপ হচ্ছে প্রিলিমিনারি। সর্বপ্রথম ক্যাডার হওয়ার গোল সেটআপ করতে হবে। প্রিলির সিলেবাস ও প্রশ্ন সম্পর্কে যথাযথ ধারণা নিয়ে প্রস্তুতি শুরু করতে হবে। যে কোনো এক বা দুই সেট বই কিনে পড়া শুরু করতে হবে। দুর্বল জায়গাগুলো শক্তিশালী করতে হবে। নিয়মিত বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকা পড়তে হবে।
জাগো নিউজ: প্রিলি শেষ করার পর বিসিএস লিখিত প্রস্তুতি নিয়ে আপনার পরামর্শ কী?
জুয়েল রানা: ক্যাডার হওয়ার দৌড়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো লিখিত পরীক্ষা। লিখিত পরীক্ষার সিলেবাস সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা রাখতে হবে। বিগত বছরের প্রশ্নগুলো বিশ্লেষণ করতে হবে। নিয়মিত পত্রপত্রিকা পড়া ও নিজেকে আপডেট রাখতে হবে। হাতের লেখা দ্রুত ও স্পষ্ট হতে হবে।
জাগো নিউজ: বিসিএস ভাইবার প্রস্তুতি কেমন হতে হয়?
জুয়েল রানা: ভাইবা অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাইবায় ভালো করতে হলে নিজের পরিশ্রম, মেধা, টেকনিক এবং আত্মবিশ্বাসের সমন্বয় জরুরি। পাশাপাশি ভাগ্যের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। নিজের এলাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, বিখ্যাত ব্যক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে হবে। পঠিত বিষয় সম্পর্কে ভালো ধারণা রাখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রতিক ঘটনা সম্পর্কে জানতে হবে।
জাগো নিউজ: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
জুয়েল রানা: ভবিষ্যৎ বিপুল সম্ভাবনাময়। তবে সব সময় নিজেকে সুনাগরিক হিসেবে গডে তোলার পাশাপাশি দেশমাতৃকা তথা সাধারণ মানুষের জন্য কিছু করতে চাই। তাছাড়া দরিদ্র ও অসহায় শিক্ষার্থীদের আর্থিকভাবে সাহায্য করতে চাই। ভবিষ্যত নিয়ে আরও কিছু ভালো পরিকল্পনা আছে; সেগুলো না বলাই থাক, সময়ই বলে দেবে।
এসইউ/জিকেএস