শত বাধার পরও বিসিএসের আশা ছাড়েননি ইমা
ইমা ইসলাম হালিমা ৩৮তম বিসিএসের শিক্ষা ক্যাডারে (ইংরেজি) উত্তীর্ণ হন। তার জন্ম কুমিল্লার বুড়িচং হলেও বেড়ে ওঠা কুমিল্লা শহরে। বাবা মরহুম হাজী মফিজুল ইসলাম ছিলেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী। মা হাজেরা বেগম গৃহিণী। ইমা কুমিল্লার পুলিশ লাইন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও কুমিল্লা ভিক্টেরিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। পরে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে সম্মান ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
বর্তমানে তিনি লাকসামের নবাব ফয়েজুন্নেছা সরকারি কলেজের ইংরেজি প্রভাষক হিসেবে কর্মরত। সম্প্রতি তার বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আনিসুল ইসলাম নাঈম—
জাগো নিউজ: আপনার ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
ইমা ইসলাম হালিমা: ছোটবেলা থেকে খুব প্রাণবন্ত, উচ্ছ্ল ও স্বপ্নবিলাসী ছিলাম। তখন থেকেই মনের কোণে মানবিকতা কাজ করতো। অসহায় মানুষ ও পথশিশুদের জন্য কিছু করার চেষ্টা থাকতো। ভালো কাজের প্রতি ঝোক ছিল। ছোট থেকেই সামরিক বাহিনীতে চাকরি করার চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত। কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে বড় হয়ে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়ার স্বপ্ন চলে যায়। সবাই সাধারণত পরীক্ষার সময় বেশি পড়াশোনা করে। আমি সাধারণত সারাবছর পড়তাম আর পরীক্ষার সময় ঘুরতাম।
জাগো নিউজ: পড়াশোনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
ইমা ইসলাম হালিমা: পড়াশোনায় তেমন প্রতিবন্ধকতা ছিল না। ২০০৮ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগে ভর্তি হই। তারপর বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর সন্তান এবং নিজের শারীরিক অসুস্থতার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে হয়। পরের সেশনে আবার জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেওয়া হয়। সম্মানে ইংরেরি বিষয় আসে। সবকিছু ব্যালেন্স করে পড়াশোনা করার চেষ্টা করতাম। ছেলে যখন ঘুমাতো বা যখন স্কুলে থাকতো এ সময়ে পড়ার সুযোগ হতো।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
ইমা ইসলাম হালিমা: ৩৭তম বিসিএসে আমার এক বন্ধু এএসপি হয়। তাছাড়া আরও বন্ধু নন-ক্যাডারে জব পায়। তখনও আমি বিসিএস দেওয়ার চিন্তা করিনি। আমার বন্ধুদের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। তখন থেকে বিসিএস দেওয়ার স্বপ্ন দেখি।
জাগো নিউজ: বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
ইমা ইসলাম হালিমা: বিসিএস যাত্রা সহজ ছিল না। বাচ্চা থাকার কারণে কোচিং ফুল টাইম করতে পারিনি। তাছাড়া স্বামী বাইরে থাকার ফলে সবকিছু নিজেকেই করতে হতো। নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সাজেশন তৈরি করা ও বইপড়া চালিয়ে যাই। পাশাপাশি বন্ধু-বান্ধব থেকে সাজেশন নিয়েছি। কোচিংয়ে শুধু মডেল টেস্ট দেওয়া হতো। কোনো ক্লাস করা হতো না। তবে আমি অনেক পড়েছি। প্রথমে ৩৭তম প্রিলিতে ফেল করি। আমার বন্ধুরা যখন ৩৭তমর ভাইবা দেয়; তখন আমার চোখ খোলে। তখন থেকে ভাবি, আমারও কিছু করা দরকার। একজন স্যার ছিলেন, খুব আদর করতেন এবং অনুপ্ররণা দিতেন। তখন ভাবি, স্যারের মতো একজন শিক্ষক হবো। তারপর ৩৮তমর জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। সিলেবাস দেখা, প্রশ্ন অ্যানালাইসিস করা এবং সব ক্লিয়ার করে পড়া শুরু করলাম। কখনো ৯-৫টা পর্যন্ত কোচিং করতে পারিনি। মডেল টেস্ট দিয়েছি ও বন্ধুদের সহযোগিতা নিয়েছি।
একসঙ্গে সংসার সামলানো, বাচ্চাকে খাওয়ানো ও নিজের চলতে হতো। সব সময় সাহসী ও স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করতাম। কখনো ভয় পেতাম না। বন্ধুদের (৩৭তম দিয়েছিল) সঙ্গে ৩৮তমর প্রিলির আগে একটি মডেল টেস্ট দিয়েছিলাম। পরীক্ষায় তাদের হারাই। তখন কনফিডেন্স বেড়ে যায়। যাই হোক, ৩৮তমর প্রিলি পাস করি। তারপর দিনে ১০-১২ ঘণ্টা পড়েছি। সারাদিন পড়ার ওপর ছিলাম। রিটেন পরীক্ষা ভালোই হয়েছে। টিকেও গেলাম। বিসিএসে একমাত্র চয়েস ছিল ইংরেজি। বিষয়ভিত্তিক পদের মধ্যে ইংরেজিতে বেশি প্রতিযোগিতা হয় জেনেও চয়েস দিয়েছিলাম। ভাইবায় জামদানি শাড়ি পরে গিয়েছিলাম। তখন শিক্ষা ক্যাডারে একজনই নিয়েছিল, সেটা আমি ছিলাম এবং চতুর্থ হয়েছিলাম।
জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
ইমা ইসলাম হালিমা: শিক্ষা ক্যাডার হওয়ার পেছনে স্যারের অনুপ্রেরণা ছিল। আর বিসিএস দেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধুদের অনুপ্রেরণা ছিল।
জাগো নিউজ: বিসিএস প্রস্তুতি কিভাবে নিতে হয়? ভাইবার ধরন সম্পর্কে কিছু পরামর্শ দেবেন?
ইমা ইসলাম হালিমা: প্রথমে মন স্থির করতে হবে। ক্যাডার হওয়ার এবং ক্যাডার সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকতে হবে। সিলেবাস সম্পর্কে ধারণা, প্রশ্ন অ্যানালাইসিস করতে জানতে হবে। এ দুটো বিষয়ের পর মেধা অনুযায়ী তার বিষয়ে জোর দিতে হবে। যার যে বিষয়ে দুর্বলতা, সে বিষয়ে জোর দেওয়া উচিত। প্রথম থেকেই ভাবতে হবে প্রিলি পাস নয়, প্রথম শ্রেণির অফিসার হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান ও বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলে রিটেন ও ভাইবায় প্রস্তুতি এগিয়ে যাবে। এ তিনটি জিনিস প্রিলি থেকেই গুরুত্ব দিয়ে পড়া উচিত। প্রিলিমিনারিতে কোনো হেলাফেলা করা যাবে না, যেহেতু এখানে প্রচুর শিক্ষার্থী আছে। প্রিলিমিনারি পরীক্ষা গুরুত্ব সহকারে দেওয়া উচিত এবং সিরিয়াসলি পড়া উচিত। মিনিমাম প্রতিদিন ১০-১২ ঘণ্টা পড়া উচিত। রিটেনের ক্ষেত্রে যা লিখবেন, তা-ই নম্বর দেবে। প্রচুর পত্রিকা পড়তে হবে এবং লেখার দক্ষতা বাড়াতে হবে। ভাইবা অনেকটা ভাগ্যের ব্যাপার। নিজেকে অনেক পরিশ্রমী হতে হবে। নিজ জেলা সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখতে হবে। বন্ধুদের সঙ্গে ভাইবা প্র্যাকটিস করতে পারেন। তাছাড়া নিজের আঞ্চলিকতা পরিহার করা, শুদ্ধ বলা ও পরিপাটি হওয়া জরুরি। ভাইবায় ছেলেরা প্যান্ট, কোট এবং মেয়েরা জামদানি বা তাঁতের শাড়ি পরে যেতে পারেন। সঙ্গে সুন্দর একটি ঘড়ি পরা যায়।
জাগো নিউজ: একজন শিক্ষক হিসেবে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
ইমা ইসলাম হালিমা: এমন একজন শিক্ষক হতে চাই, সেখানে আমার ছাত্রদের বিশ্ব মানবিক বানাতে চাই। ছাত্ররা প্রচলিত জ্ঞানের বাইরে একজন আদর্শ, মূল্যবোধসম্পন্ন ও দেশপ্রেমিক হবে। শুধু পড়াশোনা নয়; সামাজিক, রাজনৈতিক, নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সব বিষয় সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করবো। তারা পুরো পৃথিবীকে জানতে পারবে, কোনো সংকীর্ণতা থাকবে না। একজন ভালো মানুষের শিক্ষক হতে চাই। তাছাড়া অসহায় ও ছিন্নমূল মানুষকে সহযোগিতা করার ইচ্ছা আছে।
জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?
ইমা ইসলাম হালিমা: করোনার প্রথমদিকে ফেসবুকের মাধ্যমে বন্ধু-বান্ধব ও পরিজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এ অর্থ দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে অসহায় মানুষের মাঝে দেওয়া হয়। তাছাড়া মাস্ক বিতরণ ও করোনা প্রতিরোধে মানুষকে বিভিন্নভাবে সচেতন করি। ভবিষ্যতে করোনা কমে গেলে সমাজের উপেক্ষিত মানুষের জন্য ভালো কিছু করার চিন্তা আছে।
এসইউ/এএসএম