প্রথম বিসিএসেই পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হন আলী আশরাফ
মো. আলী আশরাফ ৩৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হন। এটিই ছিল তার প্রথম বিসিএস। তার জন্ম রাজধানীর আজিমপুরে। পড়াশোনা করেছেন বুয়েটের শিল্প ও উৎপাদন প্রকৌশল অনুষদে। ছোটবেলা থেকেই পুলিশের ইউনিফর্মের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল তার। সম্প্রতি তার বিসিএস জয় ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন খালিদ সাইফুল্লাহ্—
জাগো নিউজ: ছোটবেলা ও শিক্ষাজীবন কেমন কেটেছে?
আলী আশরাফ: ঢাকার আজিমপুরে দুর্দান্ত ছোটবেলা কেটেছে আমার। পুরান ঢাকার অলিতেগলিতে শুধু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। আমার আব্বু সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। অবসরের পর এখানেই ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করেন। চার ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে ছোট হওয়ায় আদর-যত্নের কমতি ছিল না। ছোটবেলা থেকেই ভালো স্কুল-কলেজে পড়ার ইচ্ছা ছিল। তাই পড়াশোনায় অবহেলা করতাম না। ভালো গ্রেড পেতাম বলে ক্লাসের সম্মানিত শিক্ষকগণ খুব আদর করতেন এবং অনুপ্রেরণা দিতেন। শিক্ষাজীবনে সুস্থ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছি। আমি খুব ভাগ্যবান যে, আমার বন্ধু-বান্ধব সবাই খুব মিশুক আর সহযোগী মনোভাবসম্পন্ন ছিল। নতুন কিছু শেখা আর জানার ক্ষেত্রে সবাই ছিল উদার। ফলে পাঠ্যবইয়ের বাইরেও নিয়মিত সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন ও অন্য বই পড়ার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠি।
জাগো নিউজ: পড়াশেনায় কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
আলী আশরাফ: আমাদের পরিবারে পড়াশোনার প্রতি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হতো। আব্বু লেখাপড়ার পেছনে অর্থ খরচ করতে কখনো কার্পণ্য করতেন না। বরং ভালো রেজাল্ট করতে না পারলে মন খারাপ করতেন এবং জ্ঞানচর্চায় উদ্বুদ্ধ করতেন। তাই সৃষ্টিকর্তাকে অসংখ্য ধন্যবাদ যে, আমি পড়াশোনা করতে গিয়ে তুলনামূলক কম প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
জাগো নিউজ: বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন বা স্বপ্ন ছিল কখনো?
আলী আশরাফ: কলেজ জীবন থেকে বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন থাকলেও ভার্সিটি পড়াকালীন বিসিএস নিয়ে চিন্তা করিনি কখনো। বরং সিজিপিএ ভালো করাই ছিল মূল টার্গেট। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ বছরে এসে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু করি এবং স্বপ্নজয়ের পেছনে লেগে থাকি।
জাগো নিউজ: পুলিশ হওয়ার ইচ্ছা বা স্বপ্ন ছিল? এর পেছনে জনসেবা না-কি সামাজিক ক্ষমতা কাজ করেছে?
আলী আশরাফ: ছোটবেলা থেকেই পুলিশ ইউনিফর্মের প্রতি বিশেষ ঝোঁক ছিল। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে পুলিশ একটি অত্যন্ত সুশৃঙ্খল বাহিনী। নিয়মনিষ্ঠা, সময়ানুবর্তিতা, আনুগত্য আর সুশৃঙ্খল চেইন অব কমান্ডই মূলত পুলিশ হওয়ার পেছনে অনুপ্রাণিত করেছিল। অন্যদিকে অন্যায় দমন আর ন্যায় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীকে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া হয়, যার মূল বিষয়বস্তু হলো জনসেবা। পুলিশের এ মহান মিশন আমাকে পুলিশ হওয়ার পেছনে অনুপ্রাণিত করেছে। এ ছাড়াও একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের আত্মত্যাগ আমাকে খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল। বর্তমানে দেশসেবায় আত্মত্যাগী সে পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য হিসেবে তাই খুব গর্ব অনুভব করি।
জাগো নিউজ: আপনার বিসিএস প্রস্তুতি ও যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
আলী আশরাফ: ৩৮তম বিসিএস ছিল আমার জীবনের প্রথম বিসিএস। ভার্সিটির পাঠ চুকিয়েই বিসিএসের সিলেবাস নিয়ে হিসেব মেলাতে বসি। শুরুতে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই আগের তিন বছরের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রশ্ন নিয়ে নিজে নিজে পরীক্ষা দেই। এরপর নিজের দুর্বলতা আর সবলতা খুঁজে বের করতে থাকি। যে বিষয়গুলোয় দুর্বলতা অনুভব করি, তার পেছনে যথেষ্ট সময় দেই। মূল বইয়ের সঙ্গে সাপ্লিমেন্টারি বই সংগ্রহ করি। প্রথমদিকে সিলেবাসের বিশালতা দেখে একটু বিমর্ষ হই। কিছু কিছু বিষয়বস্তুর সাথে পরিচিত হতে সময় লেগেছিল এবং জড়তা কাজ করছিল। এরপর দাগিয়ে দাগিয়ে মূল বই, সহায়ক বই ও সংবাদপত্র-সাময়িকী পড়া শুরু করি। বাংলা, ইংরেজি সাহিত্য, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, মানচিত্র, গণিত ও বিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নোট করে রাখতাম এবং সময় সময় সেগুলোয় চোখ বোলাতাম। এভাবে কিছুদিন পর কঠিন বিষয়সমূহ বোধগম্য হতে লাগলো। এভাবে সিলেবাসের টপিক ধরে ধরে শেষ করতে থাকি। প্রিলিমিনারিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর রিটেন পরীক্ষা নিয়েও একই পরিকল্পনা শুরু করি। আগের বছরের প্রশ্ন যাচাই ও নিজের দুর্বলতা খুঁজে বের করার পাশাপাশি প্রচুর লেখালেখির অভ্যাস করি। কারণ লিখিত পরীক্ষার প্রস্তুতি মানেই সীমিত সময়ের মধ্যে নিজের মেধা-মননকে কাজে লাগিয়ে সঠিক উত্তরটি গুছিয়ে লিখতে পারার সক্ষমতা অর্জন করা। এক্ষেত্রে আমি মূল বই, সহায়ক বই ছাড়াও খবরপত্র, সাময়িকী ও ইন্টারনেট থেকে তথ্য, উপাত্ত, উক্তি, পরিসংখ্যান সংগ্রহ করে নোট করে রাখতাম এবং প্রয়োজন অনুযায়ী লিখিত পরীক্ষায় তা কাজে লাগিয়েছিলাম। এরপরের ধাপ ভাইভার প্রিপারেশন। ভাইভার জন্য আমি আগে যারা ভাইবা দিয়ে সফল হয়েছিলেন, তাদের অভিজ্ঞতা জেনেছিলাম এবং ভাইভা বোর্ড সম্পর্কে ধারণা নিয়েছিলাম। বাসায় নিজে নিজেই বিভিন্ন টপিকের ওপর কথা বলা অনুশীলন করতাম, ক্ষেত্রবিশেষে রেকর্ড করে রাখতাম এবং কোনো বিষয় বোধগম্য না হলে অভিজ্ঞ কারো পরামর্শ নিতাম।
জাগো নিউজ: কততম বিসিএসের কোন ক্যাডারে আছেন?
আলী আশরাফ: ৩৮তম বিসিএসে সহকারী পুলিশ সুপার (প্রবি) হিসেবে কর্মরত আছি।
জাগো নিউজ: কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
আলী আশরাফ: অনুপ্রেরণার গল্প বললে শেষ হবে না। পরিবারের সদস্য, শ্রদ্ধেয় শিক্ষকমণ্ডলী, সহপাঠী এমনকি কিছু কিছু জুনিয়রের কাছ থেকেও বিভিন্ন বিষয়ে অনুপ্রাণিত হয়েছি। যাদের কাছে আমি আজীবন ঋণী। কিন্তু বিসিএসে আসার পেছনে মূল অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন আমার শ্রদ্ধেয় পিতা। যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষের দেশপ্রেমের কাহিনি নিয়মিতভাবে আমাদের ভাই-বোনদের সাথে আলোচনা করেতেন। কর্মজীবনে সততা আর নিষ্ঠা যে একান্ত প্রয়োজন, তা আমি পরিবার থেকেই শিখেছি। যা ক্যারিয়ার বিষয়ক সিদ্ধান্ত নিতেও সাহয্য করেছিল।
জাগো নিউজ: বিসিএস পরীক্ষা দিতে ইচ্ছুকদের প্রতি আপনার পরামর্শ—
আলী আশরাফ: বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির কৌশল ব্যক্তিনির্ভর। পরীক্ষার্থীদের প্রতি আমার পরামর্শ হলো আগের বছরের প্রশ্ন আর সিলেবাস সংগ্রহ করে নিজের সবলতা ও দুর্বলতা খুঁজে বের করুন। দুর্বল বিষয়ে বেশি শ্রম আর সময় ব্যয় করুন। কোন বিষয়টি রিডিং পড়ে মনে রাখবেন, কোন বিষয়টি নোট করবেন আর কোনটি বাদ দেবেন; সেটা নিজে নিজে অধ্যয়ন করে বের করুন। নিয়মিত অনুশীলন সফলতার চাবিকাঠি। পড়ার মাঝে যেন গ্যাপ না আসে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রস্তুতির এ সময়ে অনেক হতাশা কাজ করতে পারে। মনে রাখতে হবে, আপনার জন্য যা মঙ্গল, সৃষ্টিকর্তা সেটাই আপনাকে দেবেন। কিন্তু প্রস্তুতিতে কোনো অবহেলা করা যাবে না। আপনার সামর্থ্যের ওপর ভিত্তি করে দৈনিক নির্ধারিত প্ল্যান করুন এবং যত কষ্টই হোক না কেন প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন শেষ করুন। ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মেলে এমন কয়েকজন মিলে গ্রুপ করতে পারেন এবং আলোচনার মাধ্যমে নিজের পড়া ঝালিয়ে নিতে পারেন। পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে এবং পরিমিত বিশ্রাম নিতে হবে। ভিটামিনসমৃদ্ধ পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে এবং সাধ্যের অতিরিক্ত প্রেসার নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।
জাগো নিউজ: পুলিশ হিসেবে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বা লক্ষ্য কী?
আলী আশরাফ: বর্তমানে আমি বাংলাদেশ পুলিশের কনিষ্ঠতম ক্যাডার ব্যাচের একজন সদস্য। পুলিশ হিসেবে এখন আমার লক্ষ্য যাবতীয় প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন করা। উন্নত বাংলাদেশের পুলিশ হিসেবে নিজেকে যোগ্য করে গড়ে তোলা। পুলিশে যোগদানের প্রথমদিন থেকেই এ বাহিনীর নিয়মশৃঙ্খলা দেখে আমি মুগ্ধ। পুলিশ একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। যত দিন যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে অপরাধের ধরন, তার সাথে সাথে বদলাচ্ছে অপরাধ দমনের কৌশল। উপনিবেশিক আমলের মত পুলিশ এখন কোনো লাঠিয়াল বাহিনী নয় বরং সব সময়ই জনগণের সেবায় নিয়োজিত। পুলিশের বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টে আছে কাজের বৈচিত্র্য। বলা হয়, একজন পুলিশ কর্মকর্তার যেকোনো দুদিন একই রকম কাটে না। অর্থাৎ এ পেশায় একঘেয়েমির কোনো অবকাশই নেই। মামলা অনুসন্ধান কিংবা অপরাধীকে বিচারের মুখোমুখি করার পাশাপাশি নিজের বুদ্ধিমত্তার প্রকাশ ঘটিয়ে প্রশাসনিক দক্ষতা অর্জনের সুযোগ রয়েছে এ পেশায়। তাই যারা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য পুলিশ একটি চমৎকার পেশা বলে আমি মনে করি।
জাগো নিউজ: সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?
আলী আশরাফ: মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশ পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। সম্মানিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের অনেক পুলিশ সদস্যের প্রাণহানি ঘটেছে। বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের টিকার আওতায় আনা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমি নিজে দুই ডোজ টিকা নিয়েছি এবং পরিবারের সদস্যদের ও পরিচিতদের টিকা নিতে ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে উদ্ধুদ্ধ করেছি। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ যেন বাইরে না যান, সে বিষয়ে সতর্ক করেছি। সেন্ট্রাল পুলিশ হাসপাতাল করোনা সেবায় সাফল্য অর্জন করেছে। আমি নিয়মিত সেখানকার খবর রেখেছি এবং যেকোনো প্রয়োজনে সম্মানিত স্যারদের নির্দেশ পালনে সচেষ্ট হয়েছি।
এসইউ/জিকেএস