নারীর জন্য তানহার সাইকেল শেখানোর উদ্যোগ
রাজধানীতে কর্মস্থল কিংবা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে বেশিরভাগ মানুষেরই প্রধান ভরসা গণপরিবহন। কিন্তু গণপরিবহনে নারীরা প্রায়ই যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এছাড়া সময়মতো বাস-টেম্পো-অটো রিকশা পাওয়ার অনিশ্চয়তা, অতিরিক্ত ভাড়া এসব তো আছেই। তাই বলে তো আর কাজ থেমে থাকে না! এসব উপেক্ষা করেই ছুটে চলতে হয় নারীদের।
ব্যস্ততার নগরী ঢাকায় সব মানুষের কাছেই প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্মস্থল কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার ক্ষেত্রে যানজটসহ সবধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা এড়াতে চান সবাই। গণপরিবহনের বিকল্প হিসেবে যাতায়াতের নতুন মাধ্যম হিসেবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বাংলাদেশের পরিবহন ব্যবস্থায় যুক্ত হয়েছে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং সার্ভিস। কিন্তু সেক্ষেত্রেও রয়ে যায় নারীদের নিরাপত্তা আর সময়মতো গাড়ি পাওয়ার প্রশ্ন। সেইসঙ্গে বাড়তি খরচ তো আছেই।
এই যখন অবস্থা; তখন নিজের একটি বাহন থাকলে নিশ্চয়ই মন্দ হয় না! আর নিজের সেই যানটি সাইকেল বা স্কুটির মতো দ্বি-চক্রযান হলে খরচও অপেক্ষাকৃত কমে আসে। একইসঙ্গে যথাসম্ভব জ্যাম আর গণপরিবহনের হয়রানি এড়িয়ে চলতে পারেন নারীরা।
এসব ভাবনা থেকেই নারীদের সাইকেল শেখানোর উদ্যোগ নেন লালমাটিয়া মহিলা কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী হালিমা তুস সাদিয়া তানহা। নিজের প্রতিষ্ঠিত সাইকেল প্রশিক্ষণ একাডেমির নাম দেন ‘সাইকেলিকা’। আগেও তিনি নারীদের সাইকেল-স্কুটি প্রশিক্ষণ দেয় এমন একটি সংগঠনে যুক্ত ছিলেন।
প্রশিক্ষণের জায়গা হিসেবে আপাতত বেছে নিয়েছেন মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান বেড়িবাঁধ এলাকাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পেরে দু’একজন করে নারী আসতে শুরু করেন। বেশি আগ্রহ দেখা যায় কর্মজীবী নারীদের মধ্যে। ২০২১ সালের প্রথম দিন শুরু হয় সাইকেলিকার পথচলা। এখন পর্যন্ত তানহার কাছে সাইকেল শিখেছেন প্রায় ৪০ নারী। শিশুদেরও সাইকেল চালাতে শেখান তিনি।
আজকাল নারীদের মধ্যে অনেকেই যাতায়াতের জন্য স্কুটি কিনতে আগ্রহী হচ্ছেন। আগে থেকে সাইকেল চালাতে জানলে স্কুটি বা মোটরসাইকেল চালানো সহজ হয়। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) লেকচারার তাসমিয়া তাবাসসুম। সাইকেলিকায় যখন তিনি প্রথমবারের মতো এসেছিলেন; তখন থাকতেন চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিতে। কাজের ফাঁকে সময় পেলেই ঢাকায় চলে আসতেন। তখনই সময় বের করে একটু একটু করে শিখে নিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘আসলে কোনো কিছু শেখার সত্যিকার আগ্রহ থাকলে পারিপার্শ্বিক সমস্যাগুলো তখন আর ব্যাপার না। শেখার আগ্রহই মানুষকে এতদূর নিয়ে আসে। উদ্যম নিয়ে কাজ করতে সাহায্য করে। সাইকেল অনেকটাই আবেগের জায়গা। স্কুলে থাকতে খুব চালাতে ইচ্ছে হতো স্বাভাবিকভাবেই। কিন্তু বাবা-মা কিনে দেননি কোথায় চালাব, রাস্তাঘাট নিরাপদ না, অ্যাক্সিডেন্ট হয়ে যাবে এসব ভেবে।’
তাসমিয়া বলেন, ‘ইউনিভার্সিটি অবধি একই চিন্তায় চলেছে। চাকরিতে ঢুকে পোস্টিংয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। শিখতে হবে হবে করেও শিখলাম না। তারপর এখন না করলে আর কখনো হবে না ভেবেই একদিন রেজিস্ট্রেশন করে ফেললাম। একটু চালিয়ে অভ্যস্ত হয়ে গেলে যাতায়াত সাইকেল নির্ভর করে ফেলা যাবে আস্তে আস্তে। শরীরের জন্যও ভালো হবে। যানজটের এ শহরে সাইকেল পরিবেশবান্ধব অপশন। অনেকেই সাইকেলে দূরে কোথাও ঘুরে আসেন, ভালো লাগে ব্যাপারগুলো।’
প্রতিবন্ধকতার কথা জানিয়ে এ শিক্ষক বলেন, ‘একটি সামাজিক বাধা অনুভব করা হয় প্রায়ই। আমার বাবা এখনো সাইকেল ব্যাপারটা পছন্দ করেন না। আমি চালাচ্ছি এটাও নিতে পারবেন না। অনেকটা ভয়ও পান নিরাপত্তাজনিত কারণে। নিজে এখনো বড় রাস্তায় চালানোর মত পটু হইনি। সেই চ্যালেঞ্জ নিয়ে কিছু বলতে পারছি না। এখন যে এলাকায় থাকি; সেখানেও সাইকেল নিয়ে বের হলাম তো একটা দর্শনীয় বস্তু হয়ে গেলাম এরকম অবস্থা! এসব প্রতিবন্ধকতা ট্যাকল করা অনেকটাই নিজের ওপরে। লোকে দেখুক, দেখে দেখেই অভ্যস্ত হোক।’
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক আয়েশা ফেরদৌসি থাকেন কুষ্টিয়ায়। তিনিও ছুটি পেলে ঢাকায় স্বজনদের কাছে আসেন। বাইসাইকেল চালানো শেখার শখ অনেক আগে থেকে। কিন্তু সুযোগ হচ্ছিল না। একসময় সাইকেলিকার কথা জানতে পেরে যোগাযোগ করেন। তবে ডায়াবেটিস, হাই ব্লাড প্রেশার আর বাম হাঁটুতে ব্যথা থাকায় শিখতে পারবেন কি-না তা নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাত্র তিন দিনের মাথায় প্যাডেলিং শিখে ফেললেন আয়েশা।
এ ছাড়াও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু জাবিরকেও সাইকেল চালানো শিখিয়েছে সাইকেলিকা। এ ব্যাপারে তানহা বলেন, ‘এই পথচলা একেবারেই মসৃণ নয়। রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা। প্রধান সমস্যা হলো প্রশিক্ষণের জায়গা নিয়ে। আর রাস্তার ঝুট-ঝামেলা? সে তো নৈমিত্তিক ঘটনা।’
সাইকেলিকার কর্ণধার তানহা জানান, বিভিন্ন ধরনের বাজে ইঙ্গিত, পুরুষ বাইকারদের অশোভন আচরণের পাশাপাশি ‘মেয়েদের সাইকেল বা স্কুটি চালানোর দরকার কী?’ ধরনের মন্তব্য তো আছেই। এমনকি বিভিন্ন সময় বয়োজ্যেষ্ঠ নারীরাও কটু মন্তব্য করতে ছাড়েন না। আছে বিপরীত চিত্রও। চলার পথে সৌহার্দপূর্ণ আচরণও পেয়েছেন অনেকের কাছ থেকে।
তানহা বলেন, ‘ধীরে ধীরে এ প্রচেষ্টার পরিধি বাড়ানোর ইচ্ছা আছে। ৬৪ জেলায় সাইকেলিকার কার্যক্রম থাকবে। প্রতিটি নারী যাতে সাইক্লিং করতে পারে। শিখিয়ে দেওয়ার জন্য কেউ নেই, এই প্রশ্ন যাতে না থাকে। সাইকেলিকা সব সময় পরিবেশ দূষণ থেকে দূরে ছিল। এখন পরিবেশ দূষণ রোধেও কাজ করে যাবে।’
তিনি মনে করেন, শুধু যানজট এড়ানো বা দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতেই নয়। সাইক্লিং শরীরকে ফিট রাখতেও বেশ কার্যকর। আর এটা নিজের মধ্যে একধরনের আত্মবিশ্বাস আর নতুন অনুপ্রেরণার জন্ম দেয়।
এসইউ/এএসএম