বিসিএস ক্যাডার কামাল একসময় পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছিলেন
মোহাম্মদ কামাল হোসেন ৩৬তম বিসিএসের মাধ্যমে পরিসংখ্যান ক্যাডারে প্রথম স্থান অর্জন করেন। বর্তমানে তিনি পরিসংখ্যান ক্যাডারে কর্মরত। তার বাবা মো. আবদুল কাদির, মা মারুফা বেগম। জন্ম ১৯৮৯ সালে চাঁদপুর জেলার হাইমচর উপজেলার ছোট লক্ষ্মীপুর গ্রামে। আলগী বাজার আলিম মাদ্রাসা থেকে দাখিল, পুরান বাজার বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ থেকে এইচএসসি, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
সম্প্রতি তার বিসিএস জয়, ভবিষ্যৎ স্বপ্ন ও সফলতার গল্প শুনিয়েছেন জাগো নিউজকে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মো. সাঈদ মাহাদী সেকেন্দার—
ছোটবেলা কেমন কেটেছে?
মোহাম্মদ কামাল হোসেন: স্বপ্নবাজ ছিলাম। স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসতাম। অনেক কিছুই করতে পারতাম না। কিন্তু মন বলতো, চেষ্টা করলে সবই পারব। খুব স্বাধীনচেতা ছিলাম। যখন যা ভালো লাগতো, তা-ই করতাম। বাবা-মাও তেমন কিছুতে বাধ্য করতেন না। বন্ধুদের সঙ্গ অনেক ভালোবাসতাম। খেলাধুলায় মত্ত হয়ে মাঠে মাঠে অনেক সময় কেটে যেত। শিক্ষকরা খুব আদর করতেন বলে পড়াশোনায়ও মনোযোগী হওয়ার চেষ্টা করেছি। এভাবেই আমার বেড়ে ওঠা।
পড়াশোনায় কোন প্রতিবন্ধকতা ছিল কি?
মোহাম্মদ কামাল হোসেন: পড়াশোনায় মারাত্মক প্রতিবন্ধকতা ছিল বলা যায়। একদিকে অর্থ সংকট, অন্যদিকে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়া। গ্রামের অধিকাংশ কাজিন এবং বাল্যবন্ধুদের পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যোগদানের প্রভাব পড়েছিল আমার শিক্ষাজীবনে। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে বাবা-মার মতামত ছাড়াই পড়াশোনা ছেড়ে কাজে যোগ দিয়েছিলাম। বাবা-মা বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি। পরিবারে অর্থ সংকট থাকলেও বাবা-মা সব সময় অবিচল থাকতেন আমার পড়াশোনার বিষয়ে। তাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল আমার পড়াশোনা। জন্মেছি স্বচ্ছল পরিবারে। কিন্তু বড় হয়েছি অস্বচ্ছল পরিবারে। পরিবারের অর্থ সংকট যখন শুরু হয়; তখন আমার বয়স ১০-১২ বছর। আর্থিক ভিত ভেঙে দেওয়া সেই ঝড় রুখে দেওয়া সম্ভব হয়নি তখন। তবে জীবন সংগ্রামকে উপলব্ধি করা শুরু করেছি তখন থেকেই। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াও খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছিল। কিন্তু সংকট মোকাবেলায় বাবা-মার দৃঢ়তা আমাকে পথ হারাতে দেয়নি। কিছুদিন কর্মজীবন কাটিয়ে আবার পড়াশোনায় ফিরে আসি। এ ক্ষেত্রে আমার ছোটবেলার শিক্ষকদের অবদানও অসীম। আমার সৌভাগ্য হলো, যেখানেই পড়েছি; অসাধারণ কিছু শিক্ষক পেয়েছি। ক্লাস, ক্লাসের বাইরে, শিক্ষক মিলনায়তনে যেখানেই যে শিক্ষকের কাছে গিয়েছি, যা বুঝিনি তা দায়িত্ব নিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন। ধৈর্যসহ সব প্রশ্ন শুনেছেন এবং উত্তর দিয়েছেন। তাদের দরজা সব সময় আমার জন্য খোলা ছিল। আজও আছে। শিক্ষকদের অনুপ্রেরণা ও সহযোগিতা আমার কণ্টকময় চলার পথকে মসৃণ করে দিয়েছিল।
বিসিএসের স্বপ্ন দেখেছিলেন কখন থেকে?
মোহাম্মদ কামাল হোসেন: শুরু থেকে আমার স্বপ্নগুলো ছিল উন্মুক্ত। একটু বেশিই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। ছোট ছোট স্বপ্ন দেখিনি কখনো। আবার বড় হওয়ার সেই স্বপ্ন বিসিএস, ব্যাংক, শিক্ষকতা, ব্যবসা বা অন্য কোনো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে সীমাবদ্ধও ছিল না। প্রায় সব পেশাই ভালো লাগে আমার। তবে ছাত্রজীবনে শিক্ষকতা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করতাম। বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, অ্যাকাডেমিক কোচিং ইত্যাদিতে ক্লাস নিতাম। টিউশনও ছিল অনেক। পড়ানোর একটা সুবিধা হলো- আপনি যা শিখেছেন, তা ভুলে যাওয়ার সুযোগ পাবেন না। ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর ব্যস্ততায় ভালোই সময় কাটছিল। মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার পর স্বপ্নটা বিসিএসে আটকে যায়। এরপর শুরু হয় প্রস্তুতি গ্রহণ। তবে ব্যাংকসহ অন্য কিছু চাকরির পরীক্ষায়ও অংশগ্রহণ করেছি। কিছুদিন ব্যাংকে চাকরিও করেছি।
বিসিএস যাত্রার গল্প শুনতে চাই—
মোহাম্মদ কামাল হোসেন: অনার্স ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ডিপার্টমেন্টের স্যারদের কাছ থেকে ক্যারিয়ার বিষয়ক পরামর্শ নেওয়া শুরু করি। সেখান থেকেই বিসিএসের জন্য মাইন্ডসেট করি। তারপর থেকে পরিকল্পিতভাবে সময় কাটিয়েছি। প্রস্তুতির চেয়ে কোনো কিছুকে অগ্রাধিকার দেইনি। সমান্তরালভাবে মাস্টার্স, বিসিএস প্রস্তুতি এবং টিউশন চলতে থাকে। কমপক্ষে ৮টি টিউশনে সময় দিতাম। প্রতি শিক্ষার্থীকে সপ্তাহে ৩ দিন পড়াতাম। মাস্টার্সের ক্লাসেও অংশগ্রহণ করতে হতো। ফলে সময় বের করা কঠিন বিষয় ছিল। প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। যখন যেখানে সময় পেতাম বই বা শিট থেকে একটি পৃষ্ঠা পড়ে নিতাম। অন্তত হ্যান্ডসেটে সংরক্ষিত তথ্যগুলো থেকে কিছু তথ্য পড়ে নিতাম। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সময়গুলো খেয়াল রেখে কাজে লাগিয়েছি। আমার কাছে তা বেশ কার্যকর মনে হয়েছে। ব্যস্ততার মাঝে প্রস্তুতি নিয়েছি বলে সময় কম পেয়েছি। কিন্তু যতটুকু পেয়েছি, নষ্ট করিনি। নিজের দুর্বলতাগুলো খুঁজে বের করে তা নিয়ে কাজ করেছি। সিনিয়র, জুনিয়র যে পারে, তার কাছে নির্দ্বিধায় শিখতে গিয়েছি। গ্রুপ স্টাডি করেছি। যা কিছু বারবার ভুলে যেতাম যেমন- অর্থনৈতিক সমীক্ষার প্রয়োজনীয় তথ্যসমূহ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের বাছাইকৃত অনুচ্ছেদসমূহ, এসডিজি থেকে কিছু অভীষ্ট, বিখ্যাত ব্যক্তিদের আলোচিত উক্তি, সাম্প্রতিক গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষাসমূহের রেজাল্ট ইত্যাদি পৃথক নোট রেখে বারবার চর্চা করেছি। আমার পক্ষে সিলেবাস কীভাবে আয়ত্তে আনা সম্ভব, শুরুতেই তা ভেবে-চিন্তে পরিকল্পনা করে নিয়েছি। আমার মনে হয়, আত্মবিশ্বাস এবং বেসিক ভালো থাকলে এ পথে হাঁটা সহজ হয়।
কারো কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন কি?
মোহাম্মদ কামাল হোসেন: আমি স্বপ্রেরণায় বিশ্বাসী। তবে এটা শিখিয়েছেন আমার ছোটবেলার শিক্ষকরা। আর নিজ সত্তার বাইরে আমার অনুপ্রেরণার সবচেয়ে বড় উৎস হলো আমার পরিবার। আমার বাবা-মা এবং ভাই-বোনরা সব ক্ষেত্রে পাশে থেকে উৎসাহিত করেন। কিন্তু এ সফলতার পেছনে আরও একজনের অনেক বড় অবদান রয়েছে। তিনি আমার স্ত্রী। এ পথ চলার প্রতিটি মুহূর্তে তিনি আমাকে অনুপ্রেরণা, পরামর্শ দিয়েছেন এবং পড়াশোনায় সহযোগিতা করেছেন। মূলত পুরো পরিবারের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলাফলই আমার নামে প্রকাশিত হয়েছে। আমি শুধু পড়াশোনায় লেগে থাকার দায়িত্বটা ঠিকমত পালন করে গেছি। আমি বিশ্বাস করি, আপনি যখন মন থেকে কোনো কিছু চাইবেন এবং তা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় সব পরিশ্রম করতে প্রস্তুত থাকবেন, আপনার চারপাশ তখন নিজ থেকেই আপনার স্বপ্নপূরণে ব্যস্ত হয়ে উঠবে। আমার ক্ষেত্রেও তা ঘটেছিল। এর সুফল হিসাবে আমি পরপর চারটি চাকরির জন্য মনোনীত হই। ইসলামী ব্যাংকের প্রবেশনারি অফিসার (২৩তম ব্যাচ), কৃষি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার, ৩৬তম বিসিএসে পরিসংখ্যান ক্যাডার এবং ৩৭তম বিসিএসে সমবায় ক্যাডার।
আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী?
মোহাম্মদ কামাল হোসেন: সুখী, সমৃদ্ধ ও নৈতিক বাংলাদেশ গড়তে উল্লেখ করার মতো অবদান রাখতে চাই। সম্ভাবনাময় কিন্তু পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য কাজ করতে চাই। সার্ভিসে দক্ষদের একজন হতে চাই। সব সময় সৎ ও ন্যায়ের পথে থাকতে চাই৷
সাম্প্রতিক করোনা দুর্যোগে আপনার ভূমিকা কী?
মোহাম্মদ কামাল হোসেন: নিজে সচেতন থেকেছি এবং মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করেছি। ব্যক্তিগতভাবে চারপাশের বিপদগ্রস্ত মানুষদের পাশে থেকেছি। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনের মাধ্যমেও করোনা দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্থ ও খাদ্য সহায়তার ব্যবস্থা করেছি।
এসইউ/এএ/এমকেএইচ