সফলতার সুনির্দিষ্ট মন্ত্র নেই
কর্মজীবনে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি যে প্রশ্নটির সম্মুখীন হই, তা হলো ‘লাইফে সফল হমু কেমনে কন তো ভাই?’ তাই আজ মনে হলো ‘সফলতা’ নিয়ে কিছু লিখি। সুখী মানুষের যেমন কোনো জামা খুঁজে পাওয়া যায়নি, তেমনি সফল হবারও কোনো সুনির্দিষ্ট মন্ত্র নেই! তবু চারপাশে এত সফল মানুষের ছাড়াছড়ি। কিন্তু কীভাবে? চলুন দেখা যাক-
মানুষের অতৃপ্তি
মানুষের সবচেয়ে বেশি বিস্ময়কর দিক হচ্ছে ‘অতৃপ্তি’। গুহাবাসী মানুষ যদি আগুন আবিষ্কার করে থেমে থাকতো, তবে আজকে প্রযুক্তির এত উৎকর্ষতা আসতো না। মানুষের impatience with the status quo মানুষকে বরফযুগ থেকে কম্পিউটারযুগে নিয়ে এসেছে। তাই সফল মানুষরা কখনোই আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন না। মনে রাখতে হবে, আমাদের আজকের দিনের সাফল্য আগামীকালের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা হতে পারে।
স্বপ্ন না দেখা
আমাদের তরুণ প্রজন্ম স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে। সবাই বিসিএস ক্যাডার হতে চায় অথবা বহুজাতিক কোম্পানিতে নিরাপদ চাকরি। সবাই যদি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয় তবে রবীন্দ্রনাথ, স্টিভ জবস কে হবে? কথায় আছে মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। আমি বলি মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। আর তার জন্য চাই হাল না ছাড়ার মানসিকতা। ই-কমার্স জায়েন্ট ‘আলিবাবা’র প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক মা’র চেয়ে বড় উদাহরণ আর কী হতে পারে! চীনের সর্বোচ্চ ধনী এই ব্যক্তি মাত্র ১২ ডলার বেতনে জীবনের প্রথম চাকরি শুরু করেন। তাও আবার ত্রিশটিরও বেশি জায়গায় সিভি পাঠানোর পর। জ্যাক মা এক ইন্টারভিউতে তাঁর নিজের সম্পর্কে বলেন- ‘When KFC came to China, 24 people went for the job. 23 people were accepted. I was the only guy who wasn’t!’ ভাবা যায়, এ ভদ্রলোক এখন ২৪ বিলিয়নেরও বেশি সম্পত্তির মালিক!
আজ থেকে ৪শ’ বছর পরেও রবীন্দ্রনাথের কবিতা থাকবে, লুথারকিংয়ের ‘I have a dream speech’ বেঁচে থাকবে, আধখানা আপেলের মাঝে স্টিভ জবসও থাকবেন- কিন্তু আমরা ক’জন থাকবো? অন্যের বানানো প্রতিষ্ঠানে ‘চাকর’ না হয়ে উদ্যোক্তা হবার চেষ্টা করা উচিত। এক সময় মনে হতো উদ্যোক্তা হতে টাকা লাগে। এখন সময় বদলেছে। উদ্যোক্তা হতে লাগে বুদ্ধি। আরও সহজ ভাষায় বলা যায় ইউনিক আইডিয়া।
ডুব দিন প্রযুক্তির দুনিয়ায়
এএল (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স)-এর অবিশ্বাস্য অগ্রগতি যুক্তরাষ্ট্রের তরুণ আইনজীবীদের চাকরির বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। আইবিএম ওয়াটসন আপনাকে দেবে সেকেন্ডের মধ্যে লিগ্যাল অ্যাডভাইস; তাও আবার মানুষের চেয়ে ৭০% বেশি শুদ্ধভাবে। তেসলা, অ্যাপল, গুগল- এর মতো টেক কোম্পানিগুলোর গাড়ি বানানোর ঘোষণা হতে পারে টয়োটা, অডি, আর ভক্সওয়াগনের জন্য মৃত্যুঘণ্টা! কেন? টয়োটা তার সর্বোচ্চ প্রযুক্তি দিয়ে কেবল আরেকটু উন্নত মডেলের গাড়িই বানাবে; আর গুগল বানাবে কম্পিউটার অন হুইলস। ২০২০ সালের মধ্যে প্রথাগত গাড়ি বানানো প্রতিষ্ঠানগুলো দেউলিয়া হয়ে যাবে। গুগলের সেলফ-ড্রাইভিং কার টেকনিক, লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর ভাত মারবে; যেখানে ১০ মিলিয়ন কিলোমিটার ড্রাইভিংয়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা মাত্র এক ভাগ! বর্তমান সময়ের ৭০ শতাংশ চাকরি হারিয়ে যাবে সামনের ২০ বছরে; স্টারট্রেকের Tricorder মেডিকেল ডিভাইস medicine specialist চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তা শেষ করে দেবে।
৫ বছর পর মাত্র ১০ শতাংশ লোক উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবে। অনলাইন এডুকেশনের অগ্রগতি, শিক্ষকতা পেশার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকবে। সস্তা শ্রমকে পুঁজি করে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের আরএমজি শিল্প কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে; ১০ বছরেরও কম সময়ে পোশাক বানানো হবে অনেকটা রুটিমেকার দিয়ে রুটি বানানোর মতো। মেশিনের একপ্রান্ত দিয়ে সুতো ঢুকবে, অন্যপ্রান্তে পাওয়া যাবে পূর্ণাঙ্গ পোশাক! নিটিং-ডাইং-কাটিং-স্যুইং-প্রিন্টিং-ফিনিশিং একই মেশিনে! স্বাগত সবাইকে চতুর্থ প্রজন্মের শিল্পবিপ্লব যুগে! যেখানে হার্ড ওয়ার্কের চেয়ে স্মার্ট ওয়ার্ক বেশি জরুরি। প্রযুক্তির এই মাতাল হাওয়ায় গা ভাসানো ছাড়া তরুণদের আর কোনো উপায় নেই। একমাত্র ক্ষেত্র যার সাথে সম্পর্কিত পেশার মৃত্যু নেই তা হলো তথ্যপ্রযুক্তি।
সফল মানুষদের জানুন
একজন সফল মানুষের গল্প বলি। নাম মারিসা মায়ার। ইয়াহুর প্রেসিডেন্ট এবং সিইও। ভদ্রমহিলার একপৃষ্ঠার বায়োডাটার চুম্বক অংশ এখানে দিলাম। মারিসার জীবনদর্শন হলো- ‘if you don’t have any shadows, you’re not standing in the light!’ আরও মজার বিষয় তিনি লিখেছেন ‘সাহসের’ জায়গায়- ‘To take a sinking ship and try to make it float!’ সফলদের সাথে সাধারণের পার্থক্য এখানেই। তাঁরা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালোবাসেন।
কৌশলী হোন
সব সফলতার পেছনে থাকে মানসিক দৃঢ়তা এবং প্রতিপক্ষের মনস্তত্ত্ব বোঝার দুর্দান্ত কৌশল। একটি যুদ্ধের গল্প বলি। প্রায় ১০ হাজার অশ্বারোহী, ৩০ হাজার পদাতিক এবং অসংখ্য কামান-গোলাবারুদসহ বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে পলাশীর ময়দানে এসেছিলেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তার বিপরীতে লর্ড ক্লাইভের সৈন্যসংখ্যা ছিলো মাত্র ৩ হাজার। যার মধ্যে ৯শ’ জনই হাতে-পায়ে ধরে নিয়ে আসা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শৌখিন অফিসিয়াল সদস্য। এতো কিছু জেনেও রবার্ট ক্লাইভ যুদ্ধে নেমেছিলন এবং জিতবে জেনেই নেমেছিলেন। তিনি যুদ্ধে এসেছিলেন বাঙালির মানসিকতাকে নিখুঁতভাবে আন্দাজ করে। লর্ড ক্লাইভ তার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে লিখেছিলেন- ‘পরাজিত নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে যখন ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল অপমান করতে করতে, তখন দাঁড়িয়ে থেকে যারা এসব প্রত্যক্ষ করেছিলেন তারা যদি একটি করেও ঢিল ছুড়তেন তবে ইংরেজদের করুণ পরাজয় বরণ করতে হতো।’ কিন্তু তা হয়নি। বাঙালির মনস্তত্ত্ব ক্লাইভ কতটা রপ্ত করেছিলেন তা সহজেই অনুমেয়।
সফলতার মন্ত্র
১৯৮৫ সালে অ্যাপলের জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। মাত্র ত্রিশ বছর বয়সী স্টিভ জবস তখন গ্লোবাল সেলিব্রেটি। ঠিক সেই সময় নিজের গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে জবসকে চলে যেতে বলা হলো। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে সেই দুঃসহ সময়ের স্মৃতিচারণ করে স্টিভ জবস বলেন, ‘What had been the focus of my entire adult life was gone and it was devastating.’ জবসের জায়গায় অন্য কেউ হলে হয়তো আত্মহত্যা করতেন। কিন্তু তিনি প্রতিষ্ঠা করলেন পিক্সার- যা অ্যানিমেশন মুভি তৈরির পথিকৃৎ। ১৯৯৬ সালে তিনি আবারও নিজের প্রতিষ্ঠানে ফিরে আসেন। ২০১৬ সালের ফোর্বস ম্যাগাজিনের তথ্য অনুযায়ী অ্যাপলের ব্র্যান্ড ভ্যালু ১৫৪ বিলিয়ন ইউএস ডলার যা পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। একজন উদ্যোক্তার মানসিক দৃঢ়তা আর কৌশল কীভাবে প্রতিষ্ঠানকে শীর্ষে নিয়ে যায় অ্যাপল তার অনন্য দৃষ্টান্ত। সুতরাং এতক্ষণে হয়তো আপনারা নিশ্চয়ই বুঝে গেছেন সাফল্যের কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই।
লেখক: ম্যানেজার, এইচআর, এ্যাসরোটেক্স গ্রুপ। ই-মেইল: [email protected]
এসইউ/এবিএস