অসহায় আবু বক্করের সফলতার গল্প
ডান পা কোমরের নিচ থেকে কাটা। হাতের নিচে ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে হয় তাকে। কিন্তু শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গে তাকালে বোঝার উপায় থাকে না যে স্বাভাবিক মানুষের মতো সে দু’পায়ে দাঁড়িয়ে নেই। কিংবা যখন ক্রাচটাকে ক্যারিয়ারে বেঁধে রেখে এক পায়ে নিজের সাইকেলটি চালিয়ে কাজের প্রয়োজনে এ-গ্রাম ও-গ্রাম করেন, তখনো বোঝার উপায় থাকে না যে তার একটা পা কেড়ে নিয়েছে রাইস মিলের ঘূর্ণায়মান চাকা আর কুষ্টিয়া সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের অবহেলা।
তার চোখের দৃষ্টিতে কোনো মালিন্য নেই, নেই কোনো হীনম্মন্যতা। আছে আত্মবিশ্বাসের দৃপ্ত ছাপ আর কালো শরীরজুড়ে ঋজু বলিষ্ঠ গড়ন। তিনি ক্রাচে ভর দিয়ে হেঁটে হেঁটে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কুঠিবাড়ি চত্বরে বেড়াতে আসা মানুষদের স্মৃতিকে ক্যামেরায় ধরে দেন। নাম তার আবু বক্কর।
কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহ গ্রামেরই মানুষ আবু বক্কর। স্থানীয় এক রাইস মিলে কুলির কাজ করতেন। এক যুগ আগের ঘটনা। ১৯৯১ সালে একদিন দুর্ঘটনা ঘটে। তাতে তার ডান পা ভয়াবহ ক্ষতবিক্ষত হল। নেয়া হলো কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে। পাঁচদিন সেখানে পড়ে থাকলেন চিকিৎসকদের অযত্ন আর অবহেলায়। দিনে দিনে অবস্থার অবনতি হতে থাকলো। পায়ে পচন ধরে গেল। সবার পরামর্শে তখন তাকে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলো। আশা, যদি পা রক্ষা করা যায়।
কিন্তু হতাশ করলেন দায়িত্বরত চিকিৎসক এস আর খান। বক্কর জানান, চিকিৎসক বলেছিলেন, আর ৮ ঘণ্টা আগেও যদি নিয়ে আসতেন তবু পা-টা রক্ষা করা যেত। কোমরের নিচে থেকে ডান পা শরীর থেকে বিছিন্ন করে চিকিৎসকরা হাসপাতালের বিছানায় শুইয়ে দিলেন। দরিদ্র যুবক কুল-কিনারাহীন ভাবনায় ডুবে থাকেন। এখন উপায়?
হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শুয়ে এক রাতে মাথায় ঝিলিক দিয়ে ওঠে একটা বুদ্ধি। একটা পরিকল্পনা মগজের মধ্যে ঘুরতে থাকে। ছোটবেলা থেকেই তো রবি ঠাকুরের কুঠিবাড়িতে তিনি খেলেছেন, ঘুরেছেন। দেখেছেন অনেক পর্যটকের আনাগোনা। তাদের কেউ কেউ সাথে ক্যামেরা নিয়ে আসেন। ঠাকুর বাড়ির সাথে নিজেদের স্মৃতি নিয়ে যান ক্যামেরাবন্দি করে। কিন্তু যারা নিজস্ব ক্যামেরা নিয়ে আসার মত সৌভাগ্যবান আর সচ্ছল নন? তাদের সংখ্যাই তো বেশি। তাদের কি ইচ্ছে করে না স্মৃতিকে সাথে নিয়ে ঘরে ফিরতে? নিশ্চয়ই করে। যদি তাদের পছন্দের জায়গার ছবি উঠিয়ে ডাকযোগে তাদের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়া যায়, তবে কী জীবিকার একটা সুযোগ হবে না? ভাবলেন আবু বক্কর।
জীবনের প্রয়োজনে তখনই ক্যামেরা চালানোর কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও ভাড়াটিয়া ক্যামেরাম্যান হওয়ার দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিলেন আবু বক্কর। একটা পা হাসপাতালে রেখে দুই মাস বাদে গ্রামে ফিরলেন আবু বক্কর। হাতে একটা পয়সাও নেই। রাইস মিলের মালিক দূর সম্পর্কের আত্মীয় হতেন। তার কাছেই হাত পাতলেন। ৫০০ টাকা ধার করে কিনে ফেললেন একটা কাজ চালানোর মতো পুরনো ক্যামেরা। সে ১৯৯১ সালের ঘটনা। ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠলেন একজন পেশাদার ফটোগ্রাফার।
এখানেই গল্পের শেষ নয়। পর্যটকদের ফরমায়েশ অনুযায়ী তিনি ছবি তোলেন। তাদের ঠিকানা রেখে দেন। ছবি ওয়াশ করিয়ে নেগেটিভসহ পাঠিয়ে দেন সেই ঠিকানায়। বিনিময়ে প্রতি ছবির জন্য অগ্রিম ৩০ টাকা চার্জ নেন। অনেকেই উৎসাহ দিলেন তার এই প্রচেষ্টায়। লাভ ভালোই হত। আর তাই দেখে ১৯৯২ সালেই জুটে গেল বেশ কয়েকজন প্রতিযোগী। তারাও আবু বক্করের মতো পর্যটকদের ছবি তুলে দিতে লাগলেন। আবু বক্কর জাগো নিউজকে বলেন, ‘১৯৯২ সালেই ওরা ক্যামেরা নেয়। খুবই হতাশ হলাম। তবু ধরেই থাকি।’
পাশাপাশি উপার্জনের অন্য পথের কথাও ভাবতে থাকেন তিনি। এসময় কুঠিবাড়িতে ডাব বিক্রি করাও শুরু করেন। আশপাশের গ্রাম থেকে ডাব কিনতেন। ৫০-৬০টা ডাব সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে অতি কষ্টে এক পায়ে সাইকেল চালিয়ে নিয়ে আসতেন কুঠিবাড়িতে।
প্রতিযোগীদের কাছে হেরে যাননি আবু বক্কর। বরং অন্য সবার চেয়ে বেশি সাফল্য তারই। ডাব বিক্রি করে দুর্দিন ঘুচেছে। গত পাঁচ বছর কক্সবাজার থেকে ঝিনুক, বার্মার নানা শোপিস, ভ্যানিটি ব্যাগ ইত্যাদি নিয়ে এসে বিক্রি করেন তিনি। নিজেই বছরে দু’তিনবার কক্সবাজার চলে যান।
তবে ছবি তোলায় আবু বক্কর সবাইকে ছাড়িয়ে উঠে গেছেন অনেক উপরে। শিলাইদহ বাজারে বড় মেয়ের নামে গড়ে তুলেছেন ‘হালিমা স্টুডিও’। এখন তার স্টুডিওতে ১৭টি ক্যামেরা। নিজের উপার্জনের টাকায় কিনেছেন। গর্ব করে বললেন, ‘৭২টা ছবি হয় এমন ক্যামেরাও একটা আছে।’ একটা দিয়ে নিজে ছবি তোলেন। বাকিগুলো ভাড়া দেন। ব্যাটারিসহ ক্যামেরা ভাড়া দেন ১৮০ টাকা। ২০০১ সালে কিনে ফেলেছেন একটা সেলুলার ফোন। সেটাও ব্যবসার কাজে খাটান। শিলাইদহে ৫ কাঠা জমি কিনেছেন। এখন স্বপ্ন সেই জমিতে একটা দোতলা বাড়ি করার। নিজেরা থাকবেন উপরে আর নিচতলা ভাড়া দেবেন।
অবসরেও আবু বক্কর ৩২ বিঘা জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত শিলাইদহ কুঠিবাড়ির নানা দিকের ছবি তুলে রাখেন। তার বিশ্বাস, একদিন তার এসব ছবি ইতিহাসের অংশ হবে। তার স্ত্রী ফাতেমা জাগো নিউজকে বলেন, ‘শারীরিকভাবে পঙ্গু হলিও সে একজন সৎ ও কর্মঠ মানুষ। ভিক্ষে না করে পরিশ্রমের মাধ্যমে আমাদের বাঁচায়ে রাখিছেন। এতিই আমরা খুশি।’
৩৭ বছর বয়সী আবু বক্কর হালিমা, রহিমা, সিমা নামের তিন মেয়ের জনক। বড় মেয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ছে। ১০ বছর ধরে প্রাণান্তকর পরিশ্রম আর বুদ্ধিরবলে এভাবেই এগিয়ে চলেছেন আবু বক্কর। কখনো হাল ছেড়ে দেননি। এগিয়ে চলেছেন জীবন সংগ্রামের পথে। আজ তিনি সফল একজন মানুষ।
এসইউ/এমএস